জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সিগারেটে মূল্য বৃদ্ধি ও আমাদের করণীয়
৩১ মে ২০২১ ২৩:৫১
আজ ৩১ মে, বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। বাংলাদেশে প্রতিদিন ঠিক কতগুলো বিড়ি ও সিগারেট পান করা হয়, তার সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। যে তথ্যটি পাওয়া যায় তা হলো— এই সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ সব তামাকপণ্যের কারণে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এই মুহূর্তে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ তামাকজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে কঠিন সময় পার করছেন। দেশে পুরুষদের মধ্যে বিড়ি-সিগারেট ব্যবহারের সংখ্যা বেশি, নারীরা এগিয়ে আছেন ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য ব্যবহারে। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি একপাশে রেখে দিলে আমরা দেখতে পাই— তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে আছে অর্থনীতিতে, কৃষি খাতে, সামাজিক ও সার্বিক উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে। এমন অবস্থায় তামাক নিয়ন্ত্রণে আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাই আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সেই সুযোগটা আমরা নিতেই পারি। তাতে করে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি তামাকের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইটাও দৃঢ় হবে।
জনস্বাস্থ্যের ওপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবের চিত্র
বাংলাদেশে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। আর দেশে তামাকজনিত মৃত্যুর সংখ্যাটি আগেই উল্লেখ করেছি। যেটি উল্লেখ করিনি তা হলো— বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যুর প্রায় ৭১ শতাংশ ঘটে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে। বাংলাদেশে এর অনুপাত ৬৭ শতাংশ। এসব রোগের তালিকায় বিশেষত রয়েছে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ, শ্বাসরোগ, ফুসফুসের ক্যানসার ইত্যাদির মতো অসংক্রামক রোগ; যার সবগুলোই ঘটে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ক্যানসারের অন্যতম কারণ তামাক। এর কারণে ঝুঁকি বাড়ে ১০৯ শতাংশ পর্যন্ত। সংক্রামক করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গেও তামাকের প্রভাবের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, ধূমপায়ীদের মধ্যে করোনা পরবর্তী জটিলতা ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
তাই তামাক নিয়ন্ত্রণে যদি আমরা সঠিকভাবে গুরুত্বারোপ না করি, তাহলে এই মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। বাজেটে তামাকপণ্যের ওপর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্য বৃদ্ধি করা এক্ষেত্রে একটি কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে। কারণ কেবল রাজস্ব আয়ের জন্যই নয়, বরং স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নেও তামাকের ওপর কর বাড়ানো জরুরি। এ থেকে অর্জিত রাজস্ব একাংশ জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজে লাগানো যেতে পারে।
বাজেটে সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি কেন জরুরি
তামাক সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বারবার তামাক থেকে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আয়ের বিষয়টিকে সামনে আনেন। কিন্তু বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণা জানান দিচ্ছে, তামাক থেকে রাজস্ব আয় আসে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, যেখানে তামাকজনিত চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস বাবদ খরচ হয় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ আমরা এখানেই ৮ হাজার কোটি টাকার ঋণাত্মক অবস্থানে রয়েছি। একটু বলে রাখি, সিগারেটসহ সব ধরনের তামাকপণ্যের পেছনে আমাদের পরিবারগুলো যা খরচ করছে তার অঙ্ক আমাদের সর্বশেষ জাতীয় বাজেটের ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং জিডিপির শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ ধূমপান করেন (গ্যাটস, ২০১৭)। গত চার বছরে এটি আরও বেড়েছে। এ কারণেই বাংলাদেশে তামাকপণ্য নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধূমপান নিয়ন্ত্রণ।
সরকারের নানা উদ্যোগ ও তামাকবিরোধী সংস্থাগুলোর তৎপরতায় প্রতিনিয়ত তামাক নিয়ন্ত্রণসহ ধূমপান নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হচ্ছে। বছরে বছরে কর বাড়ানোর মাধ্যমে সিগারেটের করও বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু মোটা দাগে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমলেও ধূমপায়ীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। উল্টো ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ সিগারেট ও বিড়ির ওপর বিদ্যমান জটিল স্তরভিত্তিক কর পদ্ধতি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ৪ স্তরের কর ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে— প্রিমিয়াম, উচ্চস্তর, মধ্যম ও নিম্নস্তর। সাধারণত প্রতি বছর বাজেটে যখন সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়, তখন প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের দাম বাড়ে। প্রিমিয়াম স্তরের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি, যে কারণে দাম বাড়লেও খুব একটা প্রভাব পড়ে না। অন্যদিকে, উচ্চস্তরের সিগারেটে কিছুটা মূল্য বাড়লেও মধ্যম ও নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম প্রায় বাড়ে না বললেই চলে। অর্থাৎ, স্তরভিত্তিক মূল্য সমন্বয় না থাকার কারণে দাম বাড়লেই ধূমপায়ীরা নিচু স্তরের সিগারেটের মুখাপেক্ষী হয়। কিন্তু ধূমপান থামে না। ফলে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সঠিকভাবে সচেতনতা তৈরি না করতে পারা, নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছতে না পারা এবং করারোপের মাত্রা যথেষ্ট না হওয়ার কারণে আমরা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাচ্ছি না।
তাই সবার আগে সিগারেট ও বিড়ির স্তরভিত্তিক করপদ্ধতি বাতিল করা জরুরি। প্রথম দফায় সেটি সম্ভব না হলে ৪ থেকে কমিয়ে ২ স্তরে নামিয়ে আনা যেতে পারে। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট কর পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে সব স্তরের খুচরা মূল্য বাড়াতে হবে। এছাড়াও ৫ বছর মেয়াদি কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে তামাকের ব্যবহার কমাতে এবং রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। আগের মতো ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রাখতে হবে। যথাযতভাবে কর বাড়ানো সম্ভব হলে একদিকে যেমন এর ব্যবহার কমবে, অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়বে।
প্রশ্ন হলো— বাজেটে প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়িত হলে কী ধরনের সাফল্য অর্জিত হবে? প্রথমত, অতিরিক্ত ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় সম্ভব হবে কেবল সিগারেট থেকেই। কর থেকে রাজস্ব বাড়বে ১২ শতাংশ। সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ হবে। ৮ লাখ তরুণকে নতুন করে ধূমপায়ী হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে। ৪ লাখ ধূমপায়ীকে ভবিষ্যৎ মৃত্যু থেকে রক্ষা করা যাবে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ সংসদ সদস্যদের ভাবনা ও সুপারিশ
প্রধানমন্ত্রী তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত হয়ে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের সবার মতো আইনপ্রণেতা হিসেবে আমরাও তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি।
সম্প্রতি আমরা, বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িংয়ের পক্ষ থেকে তামাকের ওপর কর বাড়ানোর বিষয়ে একটি ভার্চুয়াল সেমিনারের আয়োজন করেছিলাম। যেখানে বিশেষজ্ঞসহ ১৬ জন সংসদ সদস্য যোগ দিয়েছিলেন। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও করোনা পরবর্তী অর্থনীতি মোকাবিলায় তামাকপণ্যে করারোপের বিষয়টি উঠে আসে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। উপস্থিত ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক, সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা, ফোরামের সদস্যরা, এনবিআর চেয়ারম্যান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ও অন্যান্য তামাকবিরোধী সংস্থার প্রতিনিধিরা। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
সেমিনার থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ পেয়েছি। তবে সবাই একমত হয়েছেন যে আসন্ন বাজেটে তামাকের ওপর কর বাড়ানোটা জরুরি। ডেপুটি স্পিকার মহোদয় এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তারা এটাও উল্লেখ করেছেন, তামাক উৎপাদনে যারা জড়িত, তারা শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে এই লড়াই করতে আমাদের বিভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হবে। আরও বেশি প্রচার ও প্রচারণা চালাতে হবে। কাজগুলো কঠিন হলেও বিভিন্ন পক্ষকে আমরা পাশে পাচ্ছি যেগুলো আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
আমরা অর্থমন্ত্রীর কাছে তামাকের ওপর বাড়তি কর চেয়ে ৫২ সংসদ সদস্যের সই করা একটি চিঠি দিয়েছি। বিষয়টি সম্পর্কে সবাই এরই মধ্যে অবগত রয়েছেন। আমাদের ডেপুটি স্পিকার মহোদয় এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। তার ভাষায়, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে আমরা কতটা আগ্রহী, তার প্রমাণ দিচ্ছে আপনাদের উদ্যোগ। আপনারা বলছেন অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু এতেই কাজ হবে না। আপনারা সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলুন। তাকে বুঝিয়ে বলুন। তাকে বলতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর কমিটমেন্টকে তিনি সমর্থন করেন কি না। যদি করেন, তাহলে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে।’
সেমিনারে অনেকে অনেক বক্তব্য রেখেছেন। নানা সুপারিশ দিয়েছেন। তামাক নিয়ন্ত্রণে বাজেটে কর বাড়াতে সার্বিকভাবে সুপারিশগুলো তুলে ধরছি—
- বিড়ি ও সিগারেটে বিদ্যমান স্তরভিত্তিক করপদ্ধতি বাতিল করা ও খুচরা মূল্য বাড়ানো;
- তামাকের ওপর কর বাড়িয়ে অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের পথ তৈরি করা;
- ৫ বছর মেয়াদি কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা;
- কর ফাঁকির বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া এবং বিদ্যমান তামাক কর ব্যবস্থাকে সহজ করা;
- এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানো;
- তামাক উৎপাদনে সাথে জড়িতদের সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ তৈরি করা; এবং
- জাতীয় সংসদ অধিবেশনে তামাকের কর বাড়ানোর ওপর সংসদ সদস্যদের প্রস্তাবনা পেশ করা।
আন্তর্জাতিকভাবেই তামাকের ওপর কর বাড়ানো তামাক নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পথ হিসেবে স্বীকৃত। তাই আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সেই বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা দরকার। সংসদ সদস্য হিসেবে আমরা আমাদের কাজটুকু করার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি, নীতিনির্ধারকরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে সমর্থন করবেন এবং সে অনুযায়ী উদ্যোগ নেবেন।
লেখক: সংসদ সদস্য; প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িং
সারাবাংলা/টিআর
অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত ডা. হাবিবে মিল্লাত তামাক জাতীয় পণ্য তামাকপণ্য তামাকপণ্যে কর তামাকমুক্ত দিবস