করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা নীতির সীমাবদ্ধতা ও করণীয়
৮ জুন ২০২১ ১৯:৫৮
প্রায় দেড় বছর হলো পুরো বিশ্ব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এই ভাইরাস মোকাবিলার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাকে একটি কৌশল হিসেবে অনুসরণ করছে। ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণের সর্বোচ্চ মাত্রার সময়ে ১৯০টিরও বেশি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এতে ১৬০ কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা পৃথিবীর মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৯৪ শতাংশ। আর সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে ২৩টির মতো দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ ২০২০ সালের মার্চ মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। ইউনেস্কোর তথ্য মতে বাংলাদেশ সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা দেশগুলোর মধ্যে একটি। টানা একবছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রায় চার কোটির মতো শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে বড় যুক্তি ছিল— শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সমাগম হলে করোনা ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গত একবছরের বেশি সময় ধরে কী ঘটেছে? শিক্ষার্থীরা কি সারাদিন নিজেদের বাড়িতে বা বাসায় আবদ্ধ রেখেছে?
দেখা গেছে, অনেকেই তাদের বন্ধুদের বাড়িতে, কাছাকাছি মাঠে বা অন্য কোথাও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেছে বা একসঙ্গে খেলেছে; বলাবাহুল্য, সেটি আবার বেশিরভাগ সময়ই মাস্কবিহীন অবস্থায়। অনেকে আবার দূরে কোথাও বা আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে গেছে। আর যেসব পরিবারের সামর্থ্য আছে, তাদের বাসায় তো প্রাইভেট শিক্ষকের যাতায়াতের প্রথা অনেক দিনের। করোনাকালে এই প্রথার চল তো কমেইনি, বরং সম্প্রতি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এ সময় দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যেও প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে, যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই সময়ে তাদের বাচ্চাদের শিখন প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও চলমান থাকে।
এ পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অন্যদের থেকে সামাজিক দূরত্বে রাখার যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, তা কিন্তু সেভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্য শিক্ষার্থীর বা প্রাইভেট শিক্ষকদের প্রতিনিয়তই দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। এ ধরনের আচরণ যেকোনো পরিবারের সব সদস্যদেরই করোনার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
অন্যদিকে, শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সময় কাটাত তাহলে কী হতো তা সন্দেহাতীতভাবে বলা মুশকিল, যেহেতু এ সম্পর্কিত পরিস্থিতি ও সংশ্লিষ্ট গবেষণা বাংলাদেশে এখনো হয়নি। তবে অন্য দেশের সংশ্লিষ্ট গবেষণাগুলো থেকে এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা মিলতে পারে। আমেরিকা, ইতালি, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানিতে পরিচালিত গবেষণায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে করোনা সংক্রমণের মাত্রার জোরালো কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। কেবল ইসরাইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফের খোলার পর করোনার সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছিল। কিন্তু এ কারণে হাসপাতালে রুগী ভর্তি হওয়া বা মৃত্যুর হারের কোনোটাই বাড়েনি। এসব তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সঙ্গে করোনা ছড়ানোর সম্পর্ক নিয়ে গবেষণাভিত্তিক পর্যাপ্ত প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
এখন দেখা দরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো কী। বিশ্বব্যাপী করোনাকালীন যে গবেষণাগুলো হয়েছে, সেগুলোতে সুস্পষ্ট— শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন-ক্ষতি (learning loss) হয়ে যাচ্ছে বা শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। ৮ থেকে ১০ সপ্তাহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রভাব নিয়ে এ গবেষণাগুলো হয়েছে মূলত উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশে, যে দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে— অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। গবেষণাগুলো থেকে করোনাকালে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত সব স্তরেই শিখন-ক্ষতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর এই শিখন-ক্ষতি যে অসমভাবে হচ্ছে, অর্থাৎ বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটছে, তার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
এখান থেকে কিছুটা হলেও ধারণা করা সম্ভব যে বাংলাদেশে একবছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিখন-ক্ষতি বা পিছিয়ে পড়ার পরিমাণ কেমন হবে এবং যারা বিভিন্ন কারণে সুবিধাবঞ্চিত, তাদের কী অবস্থা হবে।
বাংলাদেশেও সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। ওই গবেষণায় উঠে এসেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকায় শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়ালেখায় আগ্রহ হারাচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী রয়েছে শিখতে না পারার ঝুঁকিতে। শহুরে অঞ্চলের মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি— ছেলেদের মধ্যে ৩০ শতাংশ, মেয়েদের মধ্যে ২৬ শতাংশ। এর মধ্যে আবার অতিদরিদ্র পরিবার থেকে আসা ছেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই হার সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
এর বাইরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার অন্যান্য প্রভাব নিয়ে অনেকেই অনেক অনুমান করছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে— এমন একটি অনুমান আলোচনার দাবি রাখে। ইউনেস্কোর ধারণা অনুযায়, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা স্তর পর্যন্ত ঝরে পড়ার (dropout) ঝুঁকিতে রয়েছে। নিঃসন্দেহে এর বড় অংশই উন্নয়নশীল দেশে ঘটবে। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকির বিষয়টিও উঠে এসেছে পিপিআরসি ও বিআইজিডি’র ওই গবেষণাতেও।
আমরা জানি, গত এক দশকে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য দেখালেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। করোনা সংক্রমণের আগের সময়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর শেষ করার আগেই প্রতি পাঁচ জনে প্রায় একজন ঝরে পড়ত। এ হার নিশ্চয়ই এখন আরও বেড়ে যাবে। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যেতে পারে মূলত ছেলে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কাজে যুক্ত হওয়ার কারণে, আর মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অল্প বয়সে বিয়ে বেড়ে যাওয়ার কারণে। পাশাপাশি দরিদ্র, প্রত্যন্ত/দুর্গম অঞ্চল, মাইনরিটি এথনিক, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, রিফিউজি ও বস্তির শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন ফের চালু হবে, তখন ঝরে পড়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি আলাদা করে নজর দিতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার আরও অনেক প্রভাব আছে। শিক্ষার্থীদের সামাজিক দক্ষতা তৈরি এবং অনুশীলনের সুযোগ একদমই বন্ধ হয়ে যায়। যে বাড়িতে মা-বাবা দু’জনেই কাজ করেন, সে শিক্ষার্থীর দিনের বেলা একদম একা একা কাটে। শিশু শিক্ষার্থীর সঠিক বিকাশের জন্য এটি মোটেও উপযুক্ত নয়। এদিকে, ৩৭টি দেশে সেভ দ্য চিলড্রেন পরিচালিত এক জরিপে পাওয়া গেছে, বাড়িতে বেশি সময় ধরে থাকার কারণে শিশু লাঞ্ছনার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন বাসায় থাকা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না যাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক কল্যাণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার মোবাইল ও অন্যান্য ডিজিটাল গ্যাজেটম, গেমস, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদির প্রতি আসক্তি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।
সবদিক বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাড়াতাড়ি খুলে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কীভাবে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা যায়, সে বিষয়েও কাজ শুরু করা দরকার। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশেই অনেক দিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। সরকার ওই সব দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের উপযোগী কিছু কৌশল নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারে।
পেশাগত কাজে হংকংয়ের বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখেছি— সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মীদের জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। এখানকার সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের (এবং সব অধিবাসীদের) বিনামূল্যে মাস্ক দেওয়া হয়েছে, যেটি প্রায় ৬০ বারের মতো ধুয়ে ধুয়ে ব্যবহার করা যায়। সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য মাস্ক দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারেরও রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। এখানকার বিদ্যালয়ে গিয়ে আরও দেখেছি, বিদ্যালয়ে প্রবেশের মূল ফটকে শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়। কারও শরীরের তাপমাত্রা একটু বেশি থাকলে বা জ্বর থাকলে আর প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। শ্রেণিকক্ষে দেখেছি, সাধারণত দরজা-জানালা সব খোলা রাখা হয় যেন পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে। আর শিক্ষার্থীদের প্রতিটি ডেস্কে একটি করে সহজে অপসারণযোগ্য প্লাস্টিকের আচ্ছাদন থাকে। মাস্ক ও এই প্লাস্টিকের আচ্ছাদন মিলে সুরক্ষা বলয় অনেক শক্তিশালী হয়।
নিশ্চিতভাবে, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেও কিছু কিছু কৌশল পাওয়া যাবে যেগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাজ করবে অথবা কিছুটা পরিবর্তন করে উপযোগী করে নেওয়া সম্ভব। মনে রাখা দরকার, আমাদের শিক্ষার্থীদের এরই মধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তাই অবিলম্বে সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো এবং গ্রহণযোগ্য সমাধান।
বিদ্যালয় যখন পুনরায় খুলবে, প্রথম দিকে ক্লাস অল্প অল্প করে শুরু করতে হবে। যেমন— কয়েকটি শ্রেণি একদিনে আর অন্য শ্রেণিগুলো অন্যদিনে বিদ্যালয়ে আসবে। পরে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়ার পরিমাণ বাড়ানো যাবে। প্রথমদিকে শিক্ষার্থীদের কিছুটা সময় দেওয়া দরকার যেন তারা বিদ্যালয়ের নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। খাওয়ার সময় যেহেতু সবার মাস্ক খোলা থাকে, তাই ওই সময় দু’জনের মধ্যে সঠিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলার সময়ও যেন সবার মুখে মাস্ক থাকে, এটিটা নিশ্চিত করতে হবে। আর শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের মনোসামাজিক কল্যাণের দিকে নজর দিতে হবে। এভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে।
সহকারী অধ্যাপক, দ্য এডুকেশন ইউনিভার্সিটি অব হংকং
সারাবাংলা/টিআর