Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাঙালির সকল গৌরবময় অর্জন আওয়ামী লীগের হাত ধরেই

ড. মো. রায়হান সরকার রেজভী
২৩ জুন ২০২১ ০১:২৮

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা হারায় বাংলা। বাঙালির অধিকার আদায় ও হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ আবার রোপিত হয় আওয়ামী লীগের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো, বৃহৎ ও ইতিহাস-সমৃদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের। ঐতিহাসিক ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত এই দলটির রয়েছে স্বর্ণোজ্জ্বল অতীত—যার হাত ধরেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে পৃথিবীর মানচিত্রে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিষ্ঠাকালে দলটির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এবং কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন নতুন এই দলটির নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে কাউন্সিলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে ‘মুসলিম’ শব্দটিকে বাদ দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক গণমানুষের দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দলটি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর থেকে সব কাগজপত্রে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নাম ব্যবহার শুরু করে প্রবাসী সরকার।

বিজ্ঞাপন

বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি বাঙালিদের পৃথক রাষ্ট্র গঠন চিন্তার উন্মেষ ঘটায়। যার প্রতিফলন দেখা যায় আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে। জন্মলগ্নেই বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দলটি ৪২দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। তার মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি দাবি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন, দুই প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, বেসামরিক ও সামরিক চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর, শিল্পায়ন ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং সংসদীয় সরকার পদ্ধতির প্রণয়ন ছিল অন্যতম।

ভাষা আন্দোলনে (১৯৪৮ থেকে ১৯৫২) আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন এবং আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার জন্য বঙ্গবন্ধুকে কারাভোগ ও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে।

তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৫২ সালে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৩ সালে ১৪-১৫ নভেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে মুসলিম লীগকে (হারিকেন প্রতীক) শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। গোপালগঞ্জ আসন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের প্রার্থীকে প্রায় ১০ হাজার ভোটে পরাজিত করে প্রাদেশিক আইনসভার (এমএলএ) সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের মে মাসে যুক্তফ্রন্ট পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে— তার মধ্যে ছিল শহিদ মিনার নির্মাণ, ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস ও ছুটি পালন, বর্ধমান হাউজকে বাংলা একাডেমিতে রূপান্তর ইত্যাদি।

পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ৩১ মে জরুরি অবস্থা জারি করে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত মন্ত্রিসভা করে দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আবার গ্রেফতার করা হয়। প্রায় ৭ মাস বন্দী থাকার পর ১৯৫৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পান। অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে, নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হওয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসে।

আওয়ামী লীগের উদ্যোগেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা আনুষ্ঠানিক মর্যাদা লাভ করে। ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস’ ঘোষিত হয় জাতীয় ছুটির দিন। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগেই ১৯৫৭ সালের নভেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনগণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনকে গড়ে তোলার জন্য মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন। এরকম নজির শুধু বাংলাদেশ নয় উপমহাদেশে বিরল।

আওয়ামী লীগ মাত্র ১ বছর ৮ মাসের সরকার পরিচালনার সুযোগ পেয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সফলতা অর্জন করে তাতে বাঙালির কাছে দলটির জনপ্রিয়তা অনেক গুণ বেড়ে যায়। সাফল্যের মধ্যে অন্যতম ছিল চরম দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাব থেকে মানুষকে রক্ষা করা। এর পরেই পাকিস্তানে এক দশকব্যাপী সামরিক শাসনের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসন জারি করেন। তিন সপ্তাহের মাজে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সামরিক বাহিনীর তৎকালীন প্রধান আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের কঠোর দমননীতি, গ্রেফতার, মামলা, হয়রানি, নির্যাতন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হতে থাকে— এতে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ৬২-এর ঐক্যবদ্ধ দুর্বার শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, সারাদেশের সচেতন ছাত্র সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে— যা পরবর্তীতে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

১৯৬৪ সালে বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু ও মুসলিমদের মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। আইয়ুব সরকার এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে তাতে আরও উস্কানি দেয়। ঠিক সেই সময় বিভিন্ন দাঙ্গা উপদ্রুত অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগ দাঙ্গা ‘প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করে এবং শান্তি ফিরিয়ে আনে। এভাবেই বারবার আঘাত আসে বাঙালিদের ওপর, আর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে যায়।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালের কাউন্সিলে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে সভাপতি করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলটির সাধারণ সম্পাদক থেকে যান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে ছয় দফা কর্মসূচী পেশ করেন—যা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান প্রধান। তিনি একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম’। (সূত্র: স্বাধীনতা যেভাবে আমাদের হলো, অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, কালের কণ্ঠ উপসম্পাদকীয়, ২৬ মার্চ ২০২০)।

এক দফা মানে ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তাব বা স্বাধীনতা। ১৯৬৬ সালে বাঙালির ‘স্বাধীনতার সনদ’ ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করার পর মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ অনেকেই ছয় দফার বিরোধিতা শুরু করেন। পরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই অধিবেশনে ৬ দফা গ্রহণ ও ব্যাপকভাবে প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ছয় দফা দাবি ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। জনসমর্থন দাবিয়ে রাখতে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে পড়ে। তীব্র আন্দোলন মধ্যে অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি স্বৈরশাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে এক আড়ম্বরপূর্ণ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে আইয়ুব খান একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে। এরপর সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান আবার সামরিক শাসন জারি করেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অবিভক্ত পাকিস্তানের শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সেই নির্বাচনী প্রচারণায় ছয় দফা ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান অবলম্বন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালির জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে নানা রকম টালবাহানা শুরু করে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত সেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

স্বাধীনতার পর দেশ ছিল যুদ্ধবিপর্যস্ত। অর্থনীতি, যোগাযোগব্যবস্থা, খাদ্য গুদাম, শিল্প কারখানা, স্কুল, কলেজ, পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বর্বর সেনারা। ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি শরণার্থী ফিরিয়ে আনা, শহিদ পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন করা, সেই সঙ্গে ১৯৭২ সালের ভয়াবহ খরা, ১৯৭৩ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিসমুহের নানাবিধ ষড়যন্ত্র সার্বিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে নবগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠনের কাজে সম্পূর্ণরূপে আত্ম নিয়োগ করেন। দেশি-বিদেশি নানা বাধা বিপত্তি, ষড়যন্ত্র ও  চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে আবার নতুন করে গঠনে কাজ শুরু করেন।

বঙ্গবন্ধু অল্প কিছুদিনের মধ্যে অর্থনীতিকে চাঙ্গার পাশাপাশি, রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭২ সালে খরাজনিত দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ সরকার সাফল্য দেখায়। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে একটি সংবিধান উপহার দেয়। মাত্র ৩ বছরে (১৯৭২-৭৫), যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যা করেছিল তা ছিল এককথায় বিস্ময়কর। তার মধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন, জাতীয় পতাকা চূড়ান্তকরণ, জাতীয় সংগীত চূড়ান্তকরণ, নির্বাচন কমিশন আদেশ জারি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩, বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক (জাতীয়করণ) আদেশ পাস, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল, বেতবুনিয়া উপকেন্দ্র স্থাপন, বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন, যৌথ নদী কমিশন, শিল্পকলা একাডেমি, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য নির্দেশ, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো গঠন ছিল অন্যতম। (সূত্র: মুনতাসীর মামুনের ‘আওয়ামী লীগ কী করেছে আমাদের জন্য’ শীর্ষক প্রবন্ধ)।

স্বাধীন বাংলাদেশের এমন উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে দেশিবিদেশি নানা ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। বাঙালির অগ্রগতির স্বপ্ন থেমে যায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। ১৫ আগস্ট ঘটে যায় ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ড। সপরিবারে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তারপরই এদেশের অন্ধকার ও উল্টোপথে যাত্রার শুরু। সেদিন ভাগ্যক্রমে আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের দীর্ঘ নয় বছরের তীব্র আন্দোলনে স্বৈরাচারের পতন হয়। এর পরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বহুবার আওয়ামী লীগ আন্দোলন করে। ১৯৯৬ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ কর্মীদের দীর্ঘ ২১ বছরের কঠোর সংগ্রাম, ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই, ত্যাগ তিতিক্ষার শেষে ১৯৯৬ সালে জনগণের রায় নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন করে কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার অর্থনীতি, শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন দিগন্তের সূচনা করে— যা এ দেশের অসাম্প্রদায়িক, শান্তিপ্রিয় মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে।

একসময় বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র সঙ্গে তুলনা করত— কিন্তু শেখ হাসিনা তার দক্ষ নেতৃত্বে এই দুর্নামটি দূর করতে সক্ষম হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) অবদানের মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধী ভাতা, দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, ইনডেমনিটি আইন বাতিল, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, আশ্রয়ণ প্রকল্প, গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি স্বাক্ষর, দারিদ্র্য হ্রাসকরণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতাসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শেখ হাসিনা সবসময়ই আপসহীন। কিন্তু সেই অগ্রযাত্রা আবার থমকে যায় ২০০১ সালে। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত নেতাকর্মীদের উপর ব্যাপক অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, গ্রেফতারের পরও আওয়ামী লীগ টিকে থাকে শুধু জনগণের সমর্থন উপর। বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির চলমান আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-২০০৮) প্রায় এক বছর কারাগারে বন্দী করে রাখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। একদিকে শেখ হাসিনার আপসহীন, সুদৃঢ় মনোবল ও দেশপ্রেম, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের ঐক্য, মনোবল, ত্যাগ তিতিক্ষা, কঠোর আন্দোলন ও সংগ্রাম, শুধু শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য করেনি, সঙ্গে দেশে একটি অবাধ নির্বাচন দিতে বাধ্য করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে। সে সময় ছাত্রলীগের একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত থাকতে পেরে নিজেকে সবসময়ই খুব গর্বিত মনে হয়।

আবার নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তৃতীয় এবং ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি চতুর্থ মেয়াদে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে জনগণের রায়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। গত ১২ বছর অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা তার কারিগর। শিক্ষা, কৃষি, ডিজিটাল বাংলাদেশ, সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্য হ্রাস, অর্থনীতি, বাণিজ্য, জনশক্তি রফতানি, শিল্প, বিদ্যুৎ গ্যাস, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য সেবা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, যুব, ক্রীড়া, নারী উন্নয়ন, মাথাপিছু আয়, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মেট্রোরেল, পদ্মাসেতু, কমিউনিটি ক্লিনিক, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, রফতানি আয়, রেমিট্যান্স, খাদ্য উৎপাদন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ মানব সম্পদসহ নানা ক্ষেত্রে গত এক যুগে বাংলাদেশ দারুণ উন্নতি করেছে। কৃষির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে আজ আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছি। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস সহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। আমরা আজ নিজ অর্থায়নে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মাসেতু করতে পেরেছি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করতে পেরেছি। মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ আওয়ামী লীগ সরকারের আরও একটি বড় সাফল্য। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা পৃথিবী যখন বিপর্যস্ত ও দিশেহারা— তখন বাংলাদেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে, জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠন অসহায় ও দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ায় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।

বাংলাদেশের ও বাঙালি জাতির যা কিছু ভালো অর্জন তার সবই আওয়ামী লীগের হাত ধরেই এসেছে। প্রতিষ্ঠার ৭২ বছরের মধ্যে খুব অল্প সময়ই আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল, বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছে বিরোধী দল হিসেবে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। এই দলটি জন্মলগ্ন থেকেই সবসময় শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত-নিপীড়িত মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছে। যে কোনো দুর্যোগে এবং সংগ্রামে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগই। আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দেশরত্ন শেখ হাসিনাসহ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের সকল নেতাকর্মী ও সমর্থকদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;  কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

আওয়ামী লীগ

বিজ্ঞাপন

উপস্থাপনায় জায়েদ খান
২৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:৪৪

আরো

সম্পর্কিত খবর