চিরঘুমের সন্তানদের ঘুমহীন মায়েরা
২৯ মার্চ ২০১৮ ১৩:৩৫
।। শাবনাজ পারভীন ।।
গল্পটা দুইজন মায়ের। একজন প্রৌঢ় আর অন্যজন নতুন প্রজন্মের। এই দুই মা গত ১২ মার্চ তাদের জীবনের সব হরিয়েছেন নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। হিমালয়কন্যাকে দেখতে গিয়ে বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসস্তুপ থেকে কেবল লাশ হয়ে ফিরে এসেছে এই মায়েদের সন্তানেরা। দুঃখসাগর কাকে বলে তা জেনে গেছেন ফিরোজা বেগম ও আলমুন নাহার অ্যানি নামের এ দুই মা।
বিমান দুর্ঘটনায় ফিরোজা হারিয়েছেন একমাত্র সন্তান চিত্রগ্রাহক এফএইচ প্রিয়ককে আর অ্যানি হারিয়েছেন আড়াই বছরের একমাত্র মেয়ে প্রিয়ন্ময়ীকে।
প্রিয় জানালা, কৌনিক ঝুল বারান্দা, ফুল বাগান সবই আছে। শখের ছাদ এখনও মাথার ওপর দাঁড়িয়ে। শুধু প্রিয় মানুষগুলোই নেই। পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখা প্রিয়ন্ময়ীতো এমন চুপ থাকার মেয়ে না। অথচ বাবা-মা দুজনেরই প্রিয় এই মেয়েটি কি না শেষ মুহূর্তে মা’কে ভুল প্রমাণ করল! বিধ্বস্ত বিমানের ভেতরে শেষবার চিৎকার করে ‘বাবা’ বলে ডেকেছিল প্রিয়ন্ময়ী।
মেয়ের ডাক শুনেই জীবনবাজি রেখে প্রিয়ক গিয়েছিলেন অগ্নিকুণ্ডে। আর এখন বাবা-মেয়ে পাশাপাশি চিরঘুমে নিজের আঙ্গিনায়। আর এই চিরঘুমে থাকা সন্তানদের হারিয়ে দুই মায়ের ঘুমহীন রাত কাটে এখন।
গত ১৯ মার্চ এক অন্যরকম সন্ধ্যা নেমেছিল গাজীপুর সদর উপজেলার নগরহাওলা গ্রামে। এক ভয়ংকর বিষন্ন সন্ধ্যা নেমে এসেছিল গ্রামটিতে যেন। শতশত মানুষ মহাসড়কে চোখ পেতে বসেছিল মরদেহ আসবে বলে। স্বজনেরা ঘরের টিভি পর্দায় চোখ রেখেছিল ঢাকা শহরের কোথায় জানাজা হচ্ছে, কখনইবা লাশ রওনা দিবে। বিছানায় নির্বাক দুই মা।
ঘড়ির কাঁটায় রাত পৌনে আটটায় বাদামী রঙের দুটি কফিন গাড়িবন্দী হয়ে নগরহাওলা গ্রামে এসে থামলো। সব বিষাদ যেন নেমে এলো যেন শান্ত নিবিড় গ্রামটিতে। কান্নার রোল পড়ে যায় আশপাশে। বুক ফাটা কান্নায় দুজন মা ফিরে পেল তাদের প্রাণহীন সন্তানকে। এমনই আরেক সোমবার মা ফিরোজা নেপাল ভ্রমনে যাওয়া পাঁচজনকে চুমু দিয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন।
নিহত প্রিয়কের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এই সম্ভাবনায় চিত্রগ্রাহক ছিলেন বৈচিত্রপূর্ণ স্বভাবের। বন্ধুরা জানান, প্রিয়ক ছিল চুপচাপ ও দূরদৃষ্টির এক তরুণ। তার কথা বলা, চিন্তা করা আর জীবনযাপন, সবকিছুই ছিল বৈচিত্রে ভরা। চোখের কোনে চিকচিক করা অশ্রুবিন্দু হঠাৎ গাল বেয়ে পড়ে যাওয়া ঠেকিয়ে বন্ধুরা বারবার বলছিলেন, এতো তাড়াতাড়ি তো চলে যাওয়ার কথা ছিল না সম্ভাবনাময় এই মানুষটির!
নেপালের হাসপাতাল থেকে শুরু করে ঢাকার বার্ণ ইউনিট কোথাও একা থাকার কথা নয় অ্যানির। ভিনদেশে গিয়েছিলেন প্রিয় স্বামী, সন্তান আর স্বজনকে নিয়ে। সেই সন্তান যে কিনা এক মুহুর্ত মাকে না দেখলেই, ‘আমার আম্মু কোথায়’ বলে কান্না জুড়ে দিতো সেই প্রিয়ন্ময়ীকে তিনি দেখছেন না অনেক দিন হয়। এমন প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণ কি করে সয় এই মা! বাক্সবন্দী মেয়েটা আর কোন দিন ছাদে যাওয়ার বায়না ধরবে না। কখনই বারান্দায় একা একা হাঁটতে গিয়ে মায়ের সাবধানবাণী শুনতে হবে না তাকে!
প্রিয়কের অন্য বন্ধুরাও জানান, প্রিয়ক সবসময় কেমন যেন মগ্ন থাকতেন। হঠাৎ কিছু একটা বলে ফেললে তা হতো চীরাচরিতের ব্যতিক্রম। খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সব কিছুতেই ছিল একটু অন্যরকম ব্যপার। মানুষের ভেতরটা তিনি দেখতে পেতেন বোধহয়। একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে খুশি হতে পারে, ঠিক ততটাই ভালোবাসতে পারতেন তিনি।
ছবি তোলা যার চিন্তার অধিকাংশ দখল করে ছিল সেই প্রিয়কই একমুহুর্তে হয়ে গেলেন সাদাকালো ছবি। চিরঘুমে চলে গেলেন কন্যা প্রিয়ন্ময়ীকে নিয়ে। সেখানে প্রিয়ক হয়তো ভালোই আছেন। ভালো আছে শিশু প্রিয়ন্ময়ীও। কিন্তু এই মায়েদের তা বোঝাবে কে!
লেখক : শাবনাজ পারভীন, শিক্ষক
সারাবাংলা/ এসবি