Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমাদের লজ্জা ও বিউটির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা


২৯ মার্চ ২০১৮ ১৫:০৭

।। মিঠুন মোস্তাফিজ ।।

লাল-সবুজেই আমাদের অস্তিত্ব। পরিচয়। সবুজের বুকে লাল এই বিজয় কেতন পেতে তিরিশ লাখ মানুষের জীবন লেগেছে। রক্তে ভিজেছে ৫৫ হাজার বর্গ মাইলের বঙ্গীয় ব-দ্বীপ। খুইয়েছি দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম। নজিরবিহীন ত্যাগে যে জাতি রাষ্ট্র পেলাম সেই প্রাপ্তির ৪৮তম বর্ষ উদযাপন করলাম মাত্র দু’দিন আগে। এমন এক সময় এবার স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করলাম যখন হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ তকমার বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায়। বিচিত্র্য ভূমিরূপের প্রাণ শক্তি ভরা সোনার বাংলা এখন এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশও।

বিজ্ঞাপন

এই সুসময় যেন উদযাপন করা গেলো না প্রাণভরে। কালো ছয়া নেমে এলো অর্জনগুলোর ওপর। চোখ আটকে গেলো। বিবেকবান মানুষ অশ্রুসিক্ত হলো ষোল বছরের কিশোরী বিউটির নিথর দেহ দেখে। হ্যাঁ, বিউটির কথাই বলছি। হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জের ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের সায়েদ আলীর কন্যা ও স্থানীয় একটি উচ্চবিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেনীর ছাত্রী বিউটি আক্তার। গত ২১ জানুয়ারি তাকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে একই গ্রামের বাবুল। এ ঘটনায় গত পহেলা মার্চ সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল ও তার মা ইউপি সদস্য কলম চাঁনের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা করে। মামলাটি গত ৪ মার্চ শায়েস্তাগঞ্জ থানায় প্রেরণ করা হয়।

মামলা করার পর সায়েদ আলীকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হলে তিনি গত ১৬ মার্চ বিউটি আক্তারকে লাখাই উপজেলার গুনিপুর গ্রামে তার নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ওই রাতেই বিউটি আক্তার নানার বাড়ি থেকে আবারো নিখোঁজ হয়। কেননা, দুস্কৃতিকারী তাঁর পিছু ছাড়েনি। অনেক স্থানে খোঁজাখুঁজির পর কোথাও না পেয়ে পরদিন ১৭ মার্চ সকালে শায়েস্তাগঞ্জ হাওরে বিউটি আক্তারের লাশ মেলে। এই ঘটনার পর থেকেই ধর্ষক বাবুল আত্মগোপন করে। বিউটির বাবা সায়েদ আলীর অভিযোগ, ধর্ষণ মামলার আসামিই তাঁর মেয়েকে পুনরায় ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

বিজ্ঞাপন

বিউটির লাশটা যেখানে পড়ে ছিল তার চারপাশে সবুজ ঘাস, আর বিউটির গায়ে লাল জামা। সবুজের বুকে লাল। যেন প্রিয় স্বদেশের প্রতিচ্ছবি! ধর্ষিতা বিউটি বিচার পায়নি, তাই তাকে পুনরায় ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে। তারাই মেরে ফেলেছে এই সমাজে যাদের ক্ষমতা ও দাপট আছে, শক্তি আছে। ধর্ষক বাবুলের মা ইউপি সদস্য। তাই বাবুলই তো পারে বিউটিকে যথেচ্ছা ব্যবহার করতে এমনকি ইচ্ছে হলো যে কাউকে মেরে ফেলতে! কে কি করতে পারে এদের?

ঘটনাটি যে কতোটা মর্মান্তিক তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আবার এমন ঘটনা যে একেবারে নতুন তাও কিন্তু নয়। ধর্ষণের বিচার বিলম্বের এই অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। কেননা, ধর্ষকের থাকে ক্ষমতা অথবা ক্ষমতার সাথে বাঁধা থাকে তাদের গাঁটছড়া। সেই প্রভাবেই পার পেয়ে যায় ধর্ষক। প্রথমবার ধর্ষণের শিকার হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিউটি। কিন্তু বিচার পাননি। বরঞ্চ ধর্ষক হয়েছে আরো শক্তিশালী ও প্রতিহিংসা পরায়ন। এর প্রতিশোধ হিসেবে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হতে হয় বিউটিকে। ক্ষান্ত হয়নি তাতেও। বিউটিকে নির্মমভাবে হত্যা করে অপরাধীরা। ওদের বুক একবারো কেঁপে ওঠেনি ষোল বছরের বিউটির শেষ নিঃশ্বাসে।

বলাই যায় বিউটির মৃত্যুর জন্য দায়ী বিচারহীনতার সংস্কৃতি। তাছাড়া তো ধর্ষণের বিচার চেয়ে আইনের আশ্রয় প্রার্থনা করে বিউটিকে খুন হতে হতো না। বিবেকবান মানুষ এমন নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে পারে না। লক্ষ্য করলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি নানা প্রশ্ন আর ক্ষোভ প্রকাশিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, টুইটারে।

স্বাধীনতার মাসে শত অর্জনের মুখে যে নরপশু এমন নৃসংশতা উপহার দিতে পারে তাকে সমাজ থেকে উপরে ফেলে স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সরকারের, আমাদের। অপরাধীর কোনো গোত্র নেই, রং নেই। অপরাধী কেবলই অপরাধী। দ্রুত বিচারে মাধ্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই এখন একমাত্র প্রত্যাশা। ‘বিউটির আত্মদান’ বিবেককে নাড়া দিয়েছে। আমরা লজ্জিত। আমাদের ক্ষমা চাইবার ভাষা নেই বিউটি কাছে। শোষণ- নিপীড়নের বিরুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদরাও হয়তো ধিক্কার দিচ্ছেন আমাদের।

মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি পক্ষ ধর্ষণ করেছে। যারা চায়নি বাংলাদেশের জন্ম হোক। এখনো একটি পক্ষ ধর্ষণ করছে যারা চায়না আইনের শাসনে সমৃদ্ধ, স্বপ্নের সোনার বাংলা একটি কার্যকর ও অর্থপূর্ণ রাষ্ট্র হোক। অপরাধীদের উদ্দেশ্যে মিল থাকে। এখানেও সেই মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

সমালোচনাও হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধর্ষককে গ্রেপ্তার করেনি। বিউটির জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি, তাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আসামী গ্রেপ্তার হলে বিউটিকে অন্তত জীবনটা দিতে হতো না। এসবই সত্য যে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও গ্রাম্য মোড়লদের কথায় পুলিশ ওই মামলা হওয়ার পরও আসামি গ্রেপ্তার করেনি। এমন কালক্ষেপণের কারণেই বিউটি হত্যাকান্ড ত্বরান্বিত হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে দায়িত্বে অবহেলায় দায়ি পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া বিচার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

স্বাধীনতার মাসে উন্নয়নশীলতার উৎসবে বিউটির নিথর দেহ মেনে নিতে পারিনা। মানা যায় না। নারীর ক্ষমতায়নের উদাহরণের বাংলাদেশে বিউটির এমন মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সিরাজগঞ্জের আশানবাড়ির রূপা হত্যার ঘটনার পর দেশজুড়ে দাবি উঠেছিলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে সেই হত্যার দ্রুত বিচার হয়েছে। ধর্ষকরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেয়েছে। বিউটির ধর্ষক-খুনিদের বিচারে তেমনই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হোক দ্রুততার চেয়েও যথা দ্রুত গতিতে।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও খন্ডকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর