Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লকডাউনে আপডাউন, আওয়াজে শাটডাউন

মোস্তফা কামাল
২৭ জুন ২০২১ ১৯:৫৯

‘লক’ কিংবা ‘শাট’— যে নামেই হোক, করোনার ভয়াবহতায় ডাউন নেই। মৃত্যু, আক্রান্ত, শনাক্তের হার ‘আপ’ই হচ্ছে। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় লকডাউন আর না দিয়ে শাটডাউনের গরম আওয়াজ ছিল। পরে এলো লকডাউনের সিদ্ধান্তই। সেখানেও রকমফের। সোমবার থেকে লকডাউন হবে সীমিত। আর বৃহস্পতি থেকে সর্বাত্মক।

শনিবার (২৬ জুন) সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকের বরাতে জানানো হয়  সিদ্ধান্তটি। এর আগে শুক্রবার (২৫ জুন) রাতে প্রধান তথ্য কর্মকর্তার সই করা তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছিল, সোমবার (২৮ জুন) থেকে পরবর্তী সাত দিন কঠোর লকডাউন পালন করা হবে। শনিবার রাতে এ সংক্রান্ত আদেশের বিস্তারিত আসার কথা থাকলেও তার বদলে এলো নতুন সিদ্ধান্ত।

বিজ্ঞাপন

লকডাউন কখনো কোমল হয়? লকডাউন-শাটডাউন কঠোরই বিষয়। পাকা, আধাপাকা, সেমি-পাকার মতো বিষয় নয়। এক সময় হরতাল-ধর্মঘটের সঙ্গে সর্বাত্মক, কঠোর, তীব্র, কড়া, ঢিলেঢালা, গা-ছাড়া ইত্যাদি বিশেষায়িত শব্দ যোগ হতো। দই-মিষ্টি, মধু, ঘি ইত্যাদিতে পিওর, অরজিনাল, খাঁটি, ফরমালিনমুক্ত, হালাল, ইত্যাদির চল আছে। সিটিং সার্ভিস, অররিজিনাল সিটিং সার্ভিস, একদম গেটলক ধরনের কথাও রাজধানীর বাসে লেখা থাকে। হালাল বৌ,  মানবিক বিয়ে, শিওর ক্যাশ, পিওর মধু, খাঁটি ঘি টাইপের দাবিও ব্যাপক। এখন সিরিয়াস, কঠোর, কড়া, সর্বাত্মক, সীমিত ইত্যাদি বিশেষণ এসে ঠেকলো লকডাউনেও।

এ ধরনের ‘তিন কসম’ মার্কা কথাবার্তা বা সিদ্ধান্ত কি জরুরি ছিল? করোনা নামের এই মহামারি দুনিয়ার বকলমকেও কোয়ারেনটাইন, আইসোলেশন, পিপিই, ভেন্টিলেশন, রেডজোন, ভ্যারিয়েন্ট— এমন কত ইংরেজি শিখিয়ে ছেড়েছে! শাটডাউন-লকডাউনও মুখস্থ করিয়ে ফেলেছে। মুখে মুখে লকডাউন এখন বহুল প্রচলিত হলেও এর আভিধানিক ও প্রায়োগিক দুই অর্থই অন্ধকারে। ‘কঠোর’ শব্দটি করোনাকালের গোড়া থেকেই বহুল উচ্চারিত। যখন যত কঠোরতার কথা বলা হয়েছে, কার্যকারিতা তত কোমল হয়েছে। এতে কঠোরতার বসন খুলে গেছে। কঠোরতার হুংকারের পরপরই সীমিত পরিসরের বিশাল ছাড়। কাউকেই আটকে রাখা যাচ্ছে না। লেজেগোবরে অবস্থা চারদিকে। বিমান চলাচল খোলা রেখে বাস, ট্রেন, লঞ্চের মতো গণপরিবহন খোলা। কখনো আবার এর উল্টোটা। সামাজিক দূরত্বের বদলে আরো নৈকট্য, গাদাগাদি।

বিজ্ঞাপন

মানুক, না মানুক— কে না জানে করোনার ভয়াবহতা রুখতে শাটডাউন-লকডাউনের চেয়েও কঠোর কোনো সিদ্ধান্তের বিকল্প নেই। সরকারের পদক্ষেপের সমান্তরালে মানুষও বেপরোয়া। ‘ড্যাম কেয়ার’ ভাব প্রায় সর্বত্র। জীবন-জীবিকার সঙ্গে মোজ-মাস্তির সংঘর্ষ! লকডাউন দিলেই ক্ষেপন-চেতন। শোরগোল। মানুষ মরে যাচ্ছে, তাদের হাত খালি, পেট খালি। খাবার দাও, লঙ্গরখানা খোলো।

গেল বছরের শেষ দিক থেকে মাস কয়েক করোনার প্রকোপ কিছুটা কমেছিল। তবে এ বছরের মার্চ থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় ৫ এপ্রিল থেকে আবার বিধিনিষেধের আওতায় আসে দেশ। সেখানেও অটল রাখা গেল না। প্রথমে সাত দিনের জন্য গণপরিবহন চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। পরে তা আরও দুই দিন বাড়ানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আরও কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শুরু হয়। পরে তা আরও বাড়িয়ে ১৫ জুলাই পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু দেশে এখন সংক্রমণ পরিস্থিতি এপ্রিলের মতো ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে।

এবার করোনার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয় গত ঈদুল ফিতরের পরপরই। ভারত সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে রোগী দ্রুত বাড়তে থাকে। পরে তা আশপাশের জেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। একমাসের ব্যবধানে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা, মৃত্যু ও শনাক্তের হার কয়েক গুণ বেড়েছে। সবশেষ আজ তো এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ডই হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে নতুন করে পুরনো কঠোরতার পর্ব।

পরিস্থিতি ভয়াবহ হলেও অভিজ্ঞতাটা বড় খারাপ। এর আগে কঠোরতায় কিছু ছাড়সহ দোকানপাট খোলামাত্রই কেনাকাটার ধুম। কথার সঙ্গে কী নির্মম বাস্তবতা? জীবনের বদলে জীবিকার সমস্যাটা যেন বড় হয়ে গেছে। যে কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে সচেতনতা এলো না। সামাজিক আন্দোলনও হলো না। মিডিয়া, শিক্ষিত নাগরিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বির কেউই এগিয়ে এলেন না। স্বাভাবিকভাবেই  জীবনের চেয়ে কেনাকাটা বড় হলে গেছে। হাসপাতালে বেড বা আইসিইউ আছে কি না— তার চেয়ে জরুরি মার্কেট-শপিং মলে পছন্দের কালেকশন আছে তো? নতুন পোশাক বা গিফট না কিনলে যেন মরতে হবে!

বিশেষজ্ঞরা কবে থেকেই বলে আসছেন, সামনে আরও কঠিন দিন আসছে। আগের বিধিনিষেধ তুলে দোকানপাট ও শপিং মল খোলার সিদ্ধান্তকে তারা জেনেশুনে বিষ পানের সঙ্গে তুলনা করছেন। কে শোনে কার কথা! দেশে শিল্পের উৎপাদন গতিশীল রাখা, অর্থনীতি সচল রাখার স্বার্থেই কি আসলে এমন আয়োজন? জবাব দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। সবকিছু খুলে-মেলে করোনার চাষ করলে ‘বাম্পার ফলন’ রুখবে কে? অদৃশ্য অণুজীব প্রতিরোধ, টেস্ট, হাসপাতাল সেবা, টিকা কেনা, স্বাস্থ্যবিধি, লকডাউন-শাটডাউন— সবকিছুতে কঠোর আওয়াজের অন্তরালে সরল-গরল আমাদের কত বিপর্যস্ত করছে, অন্য কারও বুঝিয়ে দিতে হবে?

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/টিআর

করোনা সংক্রমণ বিধিনিষেধ মোস্তফা কামাল লকডাউন শাটডাউন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর