কম দামি সিগারেটে দামি অসুখ
৩০ জুন ২০২১ ১২:৪০
এবার জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনার আগে থেকে দু’টি বিষয় নিয়ে বারবার আলোচনা হয়েছে— একটি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলা, আরেকটি তামাক নিয়ন্ত্রণ। গত বছরের মতো এ বছরেও দেশের স্বাস্থ্য বাজেটের ওপর নজর ছিল সবার। করোনা পরবর্তী অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে আমাদের বাড়তি আয়ের দরকার ছিল। তাছাড়া দেশে চলমান একাধিক মেগা প্রজেক্টের জন্যেও অর্থ প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ ও আইন প্রণেতারা বারবার বলে আসছিলেন, সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব না ফেলেই সরকারের আয় বাড়াতে হবে। সেখান থেকেই তামাকের ওপর যুক্তিযুক্ত করারোপের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। উদ্দেশ্য দু’টি বিষয়ের উন্নতি— তামাক থেকে অতিরিক্ত ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব, যা মোটের ওপর এই খাত থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা আয়ের সুযোগ। দ্বিতীয়টি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এগিয়ে থাকা।
গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে যখন বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তখন খেয়াল করলাম— তামাকের ওপর করারোপ হয়েছে গতানুগতিক ধারায়। উচ্চ স্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হচ্ছে, কিন্তু নিম্ন স্তরের ক্ষেত্রে যা ছিল তাই রয়েছে। অর্থাৎ, আমাদের নিম্নবিত্তরা তামাকের করাল গ্রাস থেকে বের হতে পারছেন না। কম দামি সিগারেট বা বিড়ি তাদের দামি অসুখের কারণ হয়ে দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে চলেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে। আইন প্রণেতাদের সঙ্গে সঙ্গে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো সেই লক্ষ্যে কাজ করেছে। এ বছর এগুলো খুব কাছ থেকে দেখার ও সঙ্গে থাকার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে সবাই কতটা আন্তরিক। আমরা তামাকের ওপর কর বাড়ানোর দাবি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে গিয়েছি, সংসদ সদস্যদের কাছে গিয়েছি। নানা সুপারিশ ও পরামর্শ দিয়েছি। আমাদের আশা ছিল, এর সঠিক প্রতিফলন বাজেটে আসবে। তা হয়নি। প্রতি শলাকা প্রিমিয়াম ও উচ্চ স্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে ৭০ পয়সা ও ৫০ পয়সা। সম্পূরক শুল্ক রাখা হয়েছে চলতি অর্থবছরের মতোই। তাতে মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। আমরা বলেছিলাম, উঁচু স্তরের সিগারেটের সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়াতে হবে নিম্ন স্তরের সিগারেটের দাম। প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি। তাতে নিম্নবিত্তদের জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণের পথে আমরা আরও পিছিয়ে গেলাম।
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতি বছরে দেশে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায় (গ্লোবাল টোব্যাকো অ্যাটলাস)। এর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, কমছে উৎপাদনশীলতা। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে নিম্নবিত্ত মানুষ। তামাকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় তাদেরকে তামাক গ্রহণের পথ থেকে ফেরানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সে কারণে নানান উদ্যোগের পাশাপাশি তামাকদ্রব্যে কর বৃদ্ধি আমাদের লক্ষ্য অর্জনের পথে একটি কার্যকর পদ্ধতি। বিশ্বজুড়েই এই পদ্ধতি অনুসৃত। আমরা সেভাবেই এগিয়েছিলাম। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তামাকদ্রব্যে যেভাবে করারোপ করা হয়েছে, তা সত্যিকার অর্থে ফলপ্রসূ নয় বলে বিবেচিত হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় দেশের মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। সেই হিসাবে বলতে গেলে সিগারেটের দাম বাড়েইনি। একইভাবে বিড়ির করপদ্ধতিও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এমনকি ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য যেমন— জর্দা, গুলের করপদ্ধতিও রয়েছে আগের মতোই। আমরা বলেছিলাম স্তরভিত্তিক কর পদ্ধতি বাতিল করতে। অন্তত ৪ স্তর থেকে কমিয়ে ২ স্তরে নিয়ে আসার অনুরোধ রেখেছিলাম। সেটাও হয়নি। আমরা পরোক্ষভাবে তামাক কোম্পানিগুলোকে বাড়তি লাভের সুযোগ করে দিতে চলেছি। অথচ করোনাকালে দরিদ্র মানুষের জন্য চলমান সামাজিক কর্মসূচির পরিধি বাড়াতে তামাকের ওপর কর বাড়ানোটা ছিল সময়ের দাবি।
বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের সবচেয়ে বড় অংশটি, তথা নিম্নবিত্তরা আর্থিকভাবে দরিদ্র। এই গোষ্ঠী আগে নানান কারণেই স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যে কারণে অসুস্থ অবস্থায় তাদের চিকিৎসা ব্যয় মেটানো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তামাকজনিত রোগ যেমন— স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, শ্বাসরোগ ইত্যাদির চিকিৎসা সার্বিকভাবেই ব্যয়বহুল হওয়ায় চিকিৎসাসেবা পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের তামাক গ্রহণের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে তামাকের দাম বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
২০১৬ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী তামাক নির্মূলের ঘোষণা দিলেন, তখন একটি শুল্কনীতি প্রণয়নের কথাও বলেছিলেন। এজন্য তিনি বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ চেয়েছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত বিষয়টি আলোর মুখ দেখেনি। অথচ বছরের পর বছর তামাক নিয়ন্ত্রণে নানা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও করারোপের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো খুব একটা কার্যকর না হওয়ায় ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথটা যেন বন্ধুর হতে চলেছে।
আমরা আশার ভেলায় চড়ে এগুতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, অর্থমন্ত্রী সংশোধিত বাজেটে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন এবং তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশীদার হবেন।
লেখক: সংসদ সদস্য; প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন
সারাবাংলা/টিআর