Tuesday 15 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শহীদ শাফী ইমাম রুমী, জন্মদিনে তোমাকে সালাম


২৯ মার্চ ২০১৮ ২১:৪৭ | আপডেট: ৬ নভেম্বর ২০১৮ ২২:৪৬
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রহমান রা’আদ ।। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এক আতংকের অন্য নাম ছিল গেরিলা দল ক্র্যাকপ্লাটুন। এই ক্র্যাকপ্লাটুনের অন্যতম সদস্য শহীদ শাফী ইমাম রুমীর মতো তারছিঁড়া বা ক্র্যাকপিপল কনভেনশনাল আর্মিতে সচরাচর দেখা যায় না। কেননা আর্মি মানেই শৃঙ্খলা, কঠোর নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ একদল মানুষ। একাত্তরে পাকিস্তানি আর্মি থেকে বিদ্রোহ করে আসা বাঙালি অফিসাররা সাধারণ গণযোদ্ধাদের নিয়ে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলেন, তারাও কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলতেন আর ছিল সুনিয়ন্ত্রিত।

কিন্তু এদের পাশাপাশিই ছিলেন কয়েকজন যুবক যারা দেশমাতাকে শত্রুসেনার হাত থেকে রক্ষা করতে এমনই মরিয়া ছিলেন যে আমি তাদের বিচিত্র ধরণের তারছিঁড়াই বলব। তবে সেটা ভালোবেসে বলব। পাগলাটে না হলে কি কেউ সমগ্রের কল্যাণে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে!

বিজ্ঞাপন

তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম সেরা আর দুর্ধর্ষ পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে নেমে যেখানে বুক কাঁপাটাই ছিল স্বাভাবিক, সেখানে ক্র্যাকপ্লাটুনের একদল অনভিজ্ঞ তরুণদের আচরণ ছিল একদম উল্টো। পাকিস্তানিরা ছিল এদের কাছে শিকারের বস্তু। ভয় পাওয়া তো দূরে থাক, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় তাদের চোখ চকচক করতো শত্রু শিকারের আনন্দে!

জুন ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী গেরিলাদের প্রশিক্ষণ তখন প্রায় শেষ দিকে। এক সকালে ভারতের মেলাঘরের ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে হুট করে দারোগাবাগিচায় হাজির হলেন রুমী। চিকিৎসক, মেজর আখতারের নেতৃত্বে দুই নম্বর সেক্টরের ফিল্ড হাসপাতাল তখন দারোগাবাগিচায় স্থানান্তরিত হয়েছে। মেজর আখতার ছিলেন রুমীর ভীষণই প্রিয় একজন মানুষ। যুদ্ধের সেই ভয়াবহতার মাঝে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে এসে সারাদিন বহু হইচই করে কাটল। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করেই রুমী প্রস্তাব দিলেন, ‘চলেন আখতার ভাই, কিছু পাইক্কা মাইরা আসি!’

যেকোনো বিচারেই প্রস্তাবটা বিচিত্র রকমের ভয়ংকর। যুদ্ধের সেই ভয়াবহ সময়ে যে কেউই প্রস্তাবটা শুনে অদ্ভুত অবিশ্বাসের চোখে তাকাবে। কিন্তু কি আশ্চর্য! সেখানে উপস্থিত দলের বাকি সবাইও হৈ হৈ করে তাতে সম্মতি দিল। রুমীটা যেমন ক্র্যাক, তার চেয়েও বেশি ক্র্যাক তার সঙ্গীগুলো। দেখো দেখি কান্ড!

ঠিক হলো মেজর আখতার, রুমী, বাহার, জামাল, তাহের আর অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার জাহেদ আলী যাবে সেদিনের অপারেশনে। হুট করেই শামসুদ্দিন গোঁ ধরে বসল, তাকেও সাথে নিতে হবে সেদিন। আরে কি মুশকিল! যে কোনদিন গোলাগুলির সম্মুখীন হয়নি, সরাসরি যুদ্ধ দেখেনি, মোটা ফ্রেমের চশমার শান্তশিষ্ট পড়ুয়া ছেলে হিসেবেই পরিচিতি যার, সে কীভাবে যুদ্ধে যাবে? কিন্তু তার এক জিদ। এই অপারেশনে তাকে সাথে নিতেই হবে। অগত্যা কি আর করা। রাজি হলেন মেজর আখতার। তবে একটা শর্তে। তিনি যা বলবেন, অপারেশন চলাকালীন সেই অনুযায়ীই চলতে হবে আখতারকে। যুদ্ধে যাবার অনুমতি পেয়ে আকাশে উড়ছে ছেলেটা, মেজরের শর্ত শোনার সময় কই তার?

রাত এগারোটায় বেরোল দলটি। দুটো করে চাইনিজ এসএমজি, ভারতীয় এসএমজি আর একটা চাইনিজ রাইফেল সম্বল পুরো দলটার। নিশুতি রাত। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত পেরিয়ে ত্রিপুরা সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকল ছোট্ট গেরিলা দলটি। অনেকক্ষণ হাঁটার পর দূরে একটা আলোর রেখা দেখা গেল। একটা বড়সড় বেড়ার ঘর, ভিতরে আলো জ্বলছে। তাহেরকে পাঠানো হল রেকি করতে। জানা গেল অনেকগুলো লোক ভেতরে জুয়া খেলছে। স্মাগলার হবে হয়ত ভাবল তারা। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের যোগসাজশ না থাকলে এই সময় এই জায়গায় বসে জুয়া খেলার প্রশ্নই ওঠে না। আখতার বললেন, ‘ব্যাটাদের একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার।’

ক্রল করে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ করেই লাথি মেরে দরজা ভেঙে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলতে বলতে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে গেল গেরিলা দলটি। মুহূর্তের মাঝে ঘরটার ভেতরে যেন টর্নেডো বয়ে গেল। পরনের শার্ট, চাদর, টাকাপয়সা যা যেখানে ছিল, সেখানে সেভাবেই পড়ে রইল। হুটপাট করে বেড়া ভেঙ্গে এতগুলো মানুষ সব হাওয়া। একেবারে যেন ভোজবাজির মত উড়ে গেল এতগুলো মানুষ। পাকিস্তানি মারতে এসে এহেন সার্কাস দেখে সবার তো হাসতে হাসতে দমবন্ধ হওয়ার যোগাড়।

যাই হোক সেযাত্রা ফিরে এল সবাই। ফেরার একটু পরই নামল ঝরঝর বর্ষার বৃষ্টি। কিন্তু দলটার মনের ভেতর খচখচানিটা বাড়তেই থাকল। অপারেশনে বের হয়ে একটাও শত্রুসেনা যে মারা হলো না। সবাই যেন সবার মনের কথা পড়তে পারল। ভোর চারটা বাজতেই তাই দেখা গেল বৃষ্টি মাথায় বের হয়েছে দলটা। কয়েকটা পাকিস্তানি সৈন্য মেরে না আসলে যেন চলছেই না!

এবার একটু বর্ডার ঘেঁষে বিবির বাজারের কাছাকাছি বাংকারগুলোর দিকে এগোল ওরা। নদীর ওপারে সারি সারি পাকিস্তানি বাংকার দেখা যাচ্ছে। তখন সবে ভোর হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে প্যাঁচপ্যাঁচে কাঁদাভরা রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে আবছা দেখা যাচ্ছে বাংকারগুলো। নদীর পশ্চিম দিকের বাঁকের মুখে পজিশন নিয়ে দাঁড়ালেন রুমী, বাহার আর জাহেদ আলী। বাকিরা নদীর বাঁক ঘুরে পরের আরেকটা বাংকারের সামনে দাঁড়ালেন। আস্তে আস্তে আলো ফুটতে শুরু করল। আর এদিকে দেশমাতাকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে তৎপর একদল ক্র্যাকপিপল বৃষ্টিতে ভিজে অপেক্ষায় আছে কখন পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের কেউ বাংকার থেকে বের হয়।

অন্তত কয়েকটা হলেও পাকিস্তানি সৈন্যকে বাংকারের বাইরে হাতের মুঠোয় পাবার আশায় থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে বুঝতে পারা গেল, এই ঝিরঝির বৃষ্টির মাঝে আরামে ঘুমাচ্ছে পাকিস্তানিরা। একসাথে অনেকগুলোকে হয়তো হাতের নাগালে পাওয়া যাবে না আজ। অগত্যা আখতার সবাইকে ডেকে জানালেন,
‘শালারা তো সব আরাম কইরা ঘুমাইতেছে, অনেকগুলারে পাওয়া যাইব না। এর চাইতে যার সামনে দুজনের বেশি পাকিস্তানী পাওয়া যাইব, তারাই আগে ফায়ার ওপেন করো, বাকিরা সেই অবস্থায়ই জয়েন করবা, ঠিক আছে?’

অবশেষে সকাল সাতটার দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরলে দুজন পাকিস্তানি সৈন্যকে দেখা গেল বাংকার থেকে বের হতে। প্রথমজনের আলুথালু বেশ, শার্টটা ঝুলছে প্যান্টের উপর। পেছন পেছন আরেকটা শত্রুসেনা হায়েনার মতো হাসতে হাসতে উর্দুতে কি কি সব বলতে বলতে বের হল। তারও প্যান্টের বেল্ট খোলা, শার্টে অসংখ্য ভাঁজ। দেখে বোঝাই যাচ্ছে, মাত্র পাশবিকতার লোলুপ আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করেছে অমানুষটা। একটা গেল নিচে প্রস্রাব করতে, আরেকটা বাংকারের সামনে দাঁড়িয়ে তার সাথে খোশগল্পে মত্ত হয়ে গেল। আখতার রুমিকে সংকেত দেবার জন্য মাত্র মুখ খুলেছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ রুমীর হাতে ধরা অস্ত্রটা থেকে শুরু হলো অটোমেটিক ফায়ার। নরকের কীটটার মুখের হাসি মিলিয়ে পারল না, তার আগেই চলে গেল নরকের নিকৃষ্ট তলদেশে। আরেকটা বোধহয় কোন নোংরা রসিকতা করতেই মুখ খুলেছিল, সেই মুখ আর বন্ধ হল না। তিনজনের মাঝে দুজন শত্রুসেনাই মরল উইথ দেয়ার প্যান্টস ডাউন।

প্রাথমিক তিনটা টার্গেটকে নরকে পাঠিয়ে বাংকার দুটোর ফুটো দিয়ে দু’দফা ব্রাশফায়ার করে দুটো গ্রেনেড ছুঁড়ে মারা হল। তার আগেই অবশ্য নির্যাতিতা দুজন নারীকে বের করে আনা হয়েছিল বাংকার থেকে। পাঁচ মিনিট পরেই উইথড্র করার নির্দেশ দিলেন আখতার। ফায়ারের আওয়াজ পেয়েছে ক্যাম্পে থাকা বাকি পাকিস্তানিরা, এক্ষুনি ওরা মর্টার দাগাতে শুরু করবে।

হাসপাতালে ফিরতে ফিরতে বাজল সকাল নয়টা। মেলাঘরে গিয়ে মেজর আখতার অভিযানের রিপোর্ট করলেন দুপুরে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং দুই নম্বর সিচুয়েশন রিপোর্টে খবরটা সম্প্রচারিত হয়ে গেল সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে। ঘটনা শুনে তো দুই নম্বরের সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ কটমটে চেহারায় চেয়ে রইলেন। তাঁর প্রিয় শিষ্যদের না পারেন বকতে, না পারেন সইতে। যে কোন মুহূর্তে প্রাণ হারাতে পারত যে কেউ। আজব ছেলেপেলে সব, পুরোপুরি তারছিঁড়া নাহলে কি আর এমন করে!

এদিকে তথাকথিত দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি সৈন্যর বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপেলের হাতে এমন নাস্তানাবুদ হওয়ার খবর শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার দশা সবার। মেজর নুরুল ইসলাম শিশু সেদিন ওই সেক্টরে ছিলেন। হাসতে হাসতে আখতারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তোমাগোর জানে কোন ভয় নাই? পাগলামির তো একটা লিমিট আছে মিয়া, এইসব কি করো তোমরা?’

আখতার মাথা চুলকে জবাব দেন, ‘ইয়ে মানে স্যার, বসে থাকতে থাকতে হাত পায়ে জং ধইরা গেছিল তো… এই একটু ব্যায়াম কইরা আসলাম আর কি…!’

এরাই ছিলেন আমাদের দুঃসাহসী পূর্বপুরুষ। এমনই অসামান্য সব ঘটনার সমন্বয় আমাদের জন্ম ইতিহাস। পিশাচের জিব টেনে ছিঁড়ে আনতে পারত ক্র্যাক প্লাটুনের বদি-জুয়েল। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ চিৎকার করার দুর্জয় সাহস ছিল রুমি-আলতাফ মাহমুদদের। এঁদের ক’জনকে চিনি এই প্রজন্ম?
‘এই দেশ আমার না’, ‘এখনো স্বাধীনতা পাই নাই’, ‘বাথরুমের কল নষ্ট, তাই এই স্বাধীনতা ঝুটা হ্যায়’, ‘রাস্তায় জ্যাম, তাই দেশের মায়রে বাপ’, ‘চাকরী নাই, তাই বালের দেশে বাস করি’ সুযোগ পেলেই এসব কথা বলা তরুণ প্রজন্মের আমরা ক‘জন জানি যে আজ ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধষ গেরিলা শাফী ইমাম রুমীর জন্মদিন?
জানার চেষ্টাও কি করেছি একবারও? চেনার চেষ্টা করেছি তাকে? জানতে চেষ্টা করেছি কখনো যে কতটা পাথর কঠিন সংগ্রামে আর অপরিসীম ত্যাগে রুমীর মত এমন হাজারো গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে বিলিয়ে দিয়ে আমাদের জন্য এই স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা কিনে এনেছিলেন? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো চেষ্টা করেছি কিনা কখনো?

বোধহয় না। কে যায় এতো পুরনো ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করতে, ভেবে এড়িয়ে যাই অনেকেই। কিন্তু এভাবে এড়াতে থাকলে শহীর রুমি সহ মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদদের আত্মারা শুধু কষ্টই পাবে। শহীদ শাফী ইমাম রুমীর মত অনন্য অনেকের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতার রঙ ভীষণ ফিকে হয়ে যাবে যদি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতেও আমরা ভুলে যাই।

(তথ্যসূত্র: বারে বারে ফিরে যাই- মেজর (অবঃ) ডাঃ আখতার বীর প্রতীক)

লেখক- কপিরাইটার ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখক

সারাবাংলা/আরএফ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর