Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লকডাউন সফল হোক, নিম্নবিত্তের নীরব কান্নাও বিবেচনায় নিন

মো. নজরুল ইসলাম
৪ জুলাই ২০২১ ১৬:৫২

বিশ্ব এক ভয়াবহ ক্রান্তিলগ্ন ও দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অতি ক্ষুদ্রকায় এক অণুজীবের কাছে পৃথিবী আজ বিপর্যস্ত। পুরো পৃথিবীর মানচিত্র আজ দখলে নিয়েছে করোনাভাইরাস। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশে প্রথম শনাক্ত হয় মারাত্মক প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস। সেই থেকে এক কালো অধ্যায় নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে। বিঘ্নিত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন, সংকুচিত হচ্ছে অর্থনীতি।

অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। প্রতিদিন শতাধিক মৃত্যু দেখছে বাংলাদেশ। এছাড়া সংক্রমণের হারও অতীতের সকল রেকর্ড ভাঙছে। করোনার এই উর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার সারাদেশে তৃতীয় দফায় সর্বাত্মক কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের জন্য অতীত লকডাউনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়, বরং বিষফোঁড়া। বিগত লকডাউনে যে অপরিমিত ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষত এখনো দগদগে। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন লকডাউন মারার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে।তবে করোনার এই উর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে আপাত বিবেচনায় লকডাউনের বিকল্পও দেখছি না।

বাংলাদেশের শ্রমবাজার প্রায় ৬ কোটি ১০ লাখ লোকের উপর নির্ভরশীল। এদের মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ লোক মাসিক বেতনভুক্ত এবং ২ কোটি ৭০ লাখ লোক স্বকর্মসংস্থানে নিয়োজিত। বাকিরা সবাই দিনমজুর। গত বছরের লকডাউনে শ্রমবাজারের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনেকে জমানো মূলধন থেকে ব্যয় নির্বাহ করেছে। অনেকে মূলধন শেষ করে চরম খাদ্য ঝুঁকিতে দিনাতিপাত করেছে।

গত বছর বেসরকারি এনজিও ব্র্যাকের একটি জরিপে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে মানুষকে ঘরে থাকতে হয়েছিল। এর প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ। ফলে দেশের চরম দারিদ্র্যের হার ৬০ শতাংশ বেড়ে যায় এবং ১৪ শতাংশ (সোয়া দুই কোটি) মানুষের ঘরে কোনো খাবার ছিল না। বিশ্ব শ্রম সংস্থা (আইএলও) উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ চাকরি হারাতে পারে। এটি গত বছরের আইএলও’র প্রতিবেদন। নিশ্চয়ই বাংলাদেশও এ তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)এক সমীক্ষায় জানিয়েছে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর কারণে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, বাংলাদেশে করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছে। আর বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে (২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ)।

স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) এক জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোভিড-১৯ এর কারণে লকডাউন ঘোষণায় বাংলাদেশে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। কর্মসংস্থান হারিয়ে ২০ শতাংশের অধিক লোক নতুন করে দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়েছেন।

বিশ্ব ব্যাংকের আরেকটি হিসাব অনুযায়ী, কোভিড -১৯ এর কারণে এক কোটি ৬৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে যুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যে পতিত হয়েছেন।

অ্যাসোসিয়েশন অব হোটেল ওয়ার্কার্স জানায়, চাকরি হারানোর ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়েছিল বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা। দ্বিতীয় দফা লকডাউনের কারণে হোটেল খাতের প্রায় ৩০ লাখ কর্মী কর্মসংস্থান হারিয়েছে বলে ধারণা করছেন তারা।

এদেশের সিংহভাগ মানুষ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ করে তাদের জীবিকা চলে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যমতে, এ হার নব্বই শতাংশ, দিনমজুর, কারখানার শ্রমিক, কুলি, অটো, ভ্যান ও রিকশা চালক, হকার, ইত্যাদি। খোদ ঢাকা শহরে প্রায় এক কোটি ভ্যান ও রিকশা চালক, কারখানার শ্রমিক, গৃহকর্মী রয়েছেন। রিকশা চালক বাদে লকডাউনের কারণে প্রায় সকলের ইনকাম শূন্যের কোঠায়। অনেকের ঘরে খাবার ফুরিয়ে যাবে।খাদ্যাভাবে মানবেতর জীবন কাটাতে হবে তাদের। চার দেয়ালের মাঝে নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে যাদের সময় কাটে তারা হয়তো দারিদ্র্যের এই দুঃসহ যাতনা বুঝবে না। কিন্তু বিশ শতাংশ দরিদ্র ও দশ শতাংশ চরম দরিদ্রের কাছে ক্ষুধার যাতনায় মারা যাওয়ার চেয়ে করোনায় মারা যাওয়া কে নস্যি মনে হবে। সরকারি হিসাবেই দেশেই প্রায় বিশ শতাংশ দরিদ্র ও দশ শতাংশ চরম দরিদ্র লোক রয়েছে। সন্দেহ নেই যে, চলমান মহামারির প্রকোপে এই সংখ্যা বহু বৃদ্ধি পেয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপ অনুযায়ী, করোনার আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এই নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত যা ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ।

জরিপে যারা সাধারণত দারিদ্রসীমার ওপরেই বসবাস করেন কিন্তু যেকোনো অভিঘাতে দারিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে পারেন তাদের নতুন দরিদ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত যেখানে শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামাঞ্চলে তা ৪৪ শতাংশ। এ হিসাব থেকে জাতীয় পরিসরে নতুন দরিদ্রের এ হিসাব (১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ) প্রাক্কলন করা হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো, এই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নতুন দরিদ্রদের কোনো তালিকা সরকারের কাছে নেই। অনতিবিলম্বে এসব নতুন দরিদ্রদের তালিকা প্রস্তুত করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা উচিত।

উপরোক্ত দরিদ্র, অতিদরিদ্র, নতুন দরিদ্র, বিদেশ ফেরত এবং দেশীয় কর্মহীন এই মানুষগুলোর হয়তো অনেকের সঞ্চয় ফুরিয়ে গেছে। অনেকরই দিন এনে দিন খেতে হয়। বিভিন্ন বিধিনিষেধ ও লকডাউনের কারণ এদের উপার্জনও বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলোর কাছে ক্ষুধার রাজ্যে লকডাউনকে গদ্যময় মনে হবে। দিনমজুর, শ্রমজীবী, পরিবহন সেক্টর, ফুটপাতে ছোট ব্যবসায়ীর মতো নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে। সরকার লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র, দুঃস্থ, অসচ্ছল ও কর্মহীন ব্যক্তিদের মানবিক সহায়তা দিতে দেশের ৬৪টি জেলার অনুকূলে ২৩ কোটি ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু আমরা অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে এসব সহায়তার অধিকাংশই প্রকৃত দরিদ্রদের হাতে পৌঁছায় না। এছাড়া বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য এই বরাদ্দ নিতান্তই যৎসামান্য। এমনকি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা মোকাবিলায় এই সহায়তা কার্যকরও নয়। তাই সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম আরও জোরদারের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও দেশের সংকটে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/আইই


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর