ফজল-এ-খোদা: আপনাকে সালাম সালাম, হাজার সালাম
৫ জুলাই ২০২১ ২০:৫৮
‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের মানুষটির সঙ্গে আমার কিছু স্মৃতি আছে। সেই ছোট স্মৃতির আলোকে বড় মাপের মানুষ, কিংবদন্তী গীতিকবি ফজল-এ-খোদাকে স্মরণ করছি। আশির দশকে শেরেবাংলা নগরের বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউটের (বর্তমান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্র ছিলাম। তখন সামরিক শাসন থাকাতে শিক্ষাকার্যক্রম প্রায়ই বিঘ্নিত হতো। ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’ বলে নতুন শব্দগুচ্ছও শিক্ষা জীবনে যুক্ত হয়। তখন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সামরিক শাসনবিরোধী কর্মকাণ্ড ছিল সিলেবাসের মতো অবিচ্ছেদ্য। এর সঙ্গে অনুঘটক হিসেবে ছিল স্বৈরাচারবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন। জাতীয় পর্যায়ের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে গড়ে ওঠে জাতীয় কবিতা পরিষদ-কৃষি কলেজ শাখা, কিষাণ থিয়েটার ইত্যাদি। তখন জাতীয় কবিতা পরিষদ-কৃষি কলেজ শাখার সভাপতির দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে আমাকে।
আশির দশকের মাঝামাঝি আমরা সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কর্মসূচির সাংস্কৃতিক অংশে ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর একটি গীতিআলেখ্য রচনা ও গ্রন্থনার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায়। কলেজ কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সে অনুষ্ঠানে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন সর্বজনপ্রিয় আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ভাই (বর্তমানে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ), ছাত্রলীগ নেতা রুমমেট মেজবাহ (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব), হারুন (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব), সহপাঠী প্রিন্স (মহাসচিব, কৃষিবিদ ইননিস্টটিটিউট বাংলাদেশ), সমীর (বর্তমানে সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষক লীগ), ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ফারুক ভাই (বর্তমানে পুলিশের ডিআইজি), তরিকুল (বর্তমানে পদ্মা অয়েল কোম্পানির নির্বাহী), ছাত্রদল নেতা কায়সার (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক, অর্থ, মাইক্রোফাইবার), কিষাণ থিয়েটারের ওহাব (অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী), শ্যামলসহ (স্বত্বাধিকারী, ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার) অনেক অগ্রজ, সহপাঠী ও অনুজ সংস্কৃতিমনা বন্ধুরা। ‘রক্তপলি’ নামের সে গীতিআলেখ্যে অংশ নেয় কলেজের সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা। অনুষ্ঠানে সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন উদ্ভিদ কৌলিতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভুঁইয়া স্যার (বর্তমানে উপাচার্য, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)।
কলেজ অডিটরিয়ামে সন্ধ্যার সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ফজল-এ- খোদা। তিনি তখন বাংলাদেশ বেতারের একজন উচ্চ পদমর্যাদার কর্মকর্তা। অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তিনি স্বাধীনতার ইতিহাসের সত্যপাঠ করেছিলেন। সামরিক শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর নাম রাষ্ট্রীয়ভাবে যখন নিষিদ্ধপ্রায়, তখন বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা সাহসভরে উচ্চারণ করেছিলেন। অডিটোরিয়াম ভর্তি দর্শকরা বঙ্গবন্ধুময় আবহে উজ্জীবিত হয়েছিল।
অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা ও পরিচালনার মান নিয়ে প্রশংসা করে তিনি আমাদের আবার বাংলাদেশ বেতারে গীতিআলেখ্যটি করার সস্নেহ অনুরোধ জানান। তার সহযোগিতায় ‘রক্তপলি’র পুরো টিম বেতারে আমরা অনুষ্ঠানটি করতে পেরেছিলাম। তবে বেতারে অনুষ্ঠান করতে তার সঙ্গে আমাদের সামান্য মতপার্থক্য হয় গীতিআলেখ্যের নাম ‘রক্তপলি’ ও পাণ্ডুলিপিতে গ্রন্থিত ইতহাস ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে সরাসরি কিছু বক্তব্য নিয়ে। সে সময়ের তীব্র হরতাল-ধর্মঘট-মিছিল-গুলি, রক্তারক্তি ও মৃত্যুময় পরিস্থিতিতে ‘রক্তপলি’ নামটি জাতীয় প্রচার মাধ্যমে দিলে অনুষ্ঠানটি বাধার সম্মুখীন হতে পারে— এমনটিই বলেছিলেন ফজল-এ-খোদা। আর ইতহাস ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে সরাসরি কিছু বক্তব্যে আমরা অনড় দেখে তিনি স্মিত হেসে বলেছিলেন— তোমরা কি আমার চেয়েও বঙ্গবন্ধুকে বেশি ভালোবাস? শেষে তার পরামর্শ নিয়েই বেতারে আমরা অনুষ্ঠানটি করেছিলাম ‘দুর্জয়’ নামে।
ফজল-এ-খোদা তখন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকাতেই থাকতেন। সে সূত্রে মাঝেমধ্যে পথে দেখা হতো। তার অফিসেও গিয়েছি বেশ কয়েকবার। ছন্দের প্রতি আমার বিশেষ পক্ষপাতিত্ব দেখে একদিন তিনি আমাকে গান লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আরেক দিন তিনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন বেতারের আরেকজন গুণী গীতিকবি জাহিদুল হকের কাছে, সুবীর নন্দীর গাওয়া ‘আমার এ দু‘টি চোখ পাথর তো নয়’সহ অনেক গানের কীর্তিমান লেখক যিনি। কেন যেন সে যোগাযোগ-সংযোগটা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
ফজল-এ-খোদা স্যার তার একটি ছড়ার বই আমাকে সৌজন্য হিসেবে দিয়েছিলেন, যা হারিয়ে ফেলে আজ কষ্টে পুড়ছি। তাকে হারিয়ে আজ মনে হচ্ছে— তার পায়ের ধূলো নিয়ে ধন্য হওয়ার সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া করলাম! তার স্মৃতির উদ্দেশে উচ্চারণ করছি—
বাঙালি প্রাণের গানের ইতিহাসে
আছেন সর্বদা
সালাম সালাম হাজার সালাম
ফজল-এ- খোদা।
পারলৌকিক শান্তিতে থাকবেন। ‘আলো ছায়া জোয়ার-ভাটা’র দেশে ‘কাজল মাটির গানে’ই স্মরণীয় থাকবেন আপনি।
লেখক: সরকারি কর্মকর্তা; মহাসচিব, বিসিএস (কৃষি) অ্যাসোসিয়েশন
সারাবাংলা/টিআর