ফুলিদের ফুল হয়ে ফোটা হয় না হাসেমদের বাগানে!
৯ জুলাই ২০২১ ২৩:৫৬
কোমল হাতে হয়ত হাজার লিটার জুস প্যাকেটজাত করেছে। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে তৃষ্ণার্ত জিভে জল আসলেও জুসের বদলে ওয়াসার পানিই গেছে পেটে। মাস শেষে কয়েকটা চকচকে নোট মা;র হাতে তুলে দিয়ে শুরু হয় প্রতীক্ষা, এইতো আর কয়েকটা বছর। বড় হবে ফুলি বেতন বাড়বে; তারপর স্বপ্নের মানুষটির সাথে গাঁটছড়া। দু’জনে একসাথে কাজে আসবে, নিজের রান্না করা ভাত আর আলু ভাজি দিয়ে দুপুর একসাথে খাবে। বিকেলে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফিরবে ঝুপড়ি ঘরের প্রসাদে! ফুলিরা এভাবেই ফুল হয়ে ফোটার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু হাসেমদের বাগানের বন্ধ খাঁচায় ফুলিদের আকাশে উড়া হয় না কখনোই। হাসেমদের জুস হারানোর বড় ভয়, খাঁচার কপাটে তাই বড় তালা। আগুনে পুড়ুক তবুও জুস চুরি হতে দেয়া যাবে না।
মিলেছে ৫২টি ভস্ম দেহ। অথচ হাসেমদের দাবি ৫১ জন নিখোঁজ। সেজানের কারখানায় মাত্র দুইশো নয়, আরো অনেকে কাজ করতেন বলে শ্রমিকদের দাবি। অধিক লাভের আশায় কারখানাটিতে অবাধে চলেছে শিশুশ্রম। অনেক ফুলি কাজ করতো সেখানে। অথচ দেশে অনেক কর্তৃপক্ষ। কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ, অগ্নি নির্বাপন দেখভাল কর্তৃপক্ষ, বিল্ডিং কোড দেখভাল কর্তৃপক্ষ, শিশুশ্রম দেখভাল কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুত ব্যবস্থা দেখভাল কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি। তারা কী দায়িত্ব পালন করেনি? ফাইল ঘাটলে দেখা যাবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাজ করেছে তারা। কিন্তু তারা কেউই ফুলিদের স্বার্থ দেখেনা। কোট পরা ভদ্রলোকেদের সাথে কোট পরাদের সম্পর্কটা ভিন্ন রকম হয় আমাদের দেশে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এসব কর্তৃপক্ষের লোকজন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী। তাদের কোন মেয়ে কোথায় পড়ে, কোন ছেলে কোন দেশে আছে কিংবা ঢাকা শহরে তাদের কয়টা বাড়ি; সহ ধার্মিকদের (?) সাথে তাদের এই গল্প প্রতিনিয়ত বাতাসে ভাসে। আর ফুলিদের পরিবার পায় রাষ্ট্রের গভীর সমবেদনা। আর দাফনের জন্য কয়েকটি টাকা। এই ফুলিদের রক্ত চুষে বৃষ্টিশরা ভদ্র হয়েছে…এখন হাসেমরা ভদ্র হয়। নীচ তলার কোমলমতি শিশুদের রক্ত চুষে উপরতলার কোমলমতি শিশুদের জন্য জুস বানায় তারা।
যে কোনো কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে অধিক মৃত্যুর কয়েকটি কারণ বরাবরই বলে থাকে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনীয় ফায়ার এক্সিট নেই, কক্ষ তালাবদ্ধ, মেইট গেট বন্ধ, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা অকেজো, প্রচুর দাহ্য পদার্থ ইত্যাদি। কিন্তু দুর্ঘটনার পর, আগে নয়। হয়ত পরবর্তী কোনো কারখানায় আবারো মানুষ পোড়ানো হলে একই কারণ উঠে আসবে। যেমনটা পেয়েছিলাম তাজরিন ফ্যাশনসের বেলায়। কিন্তু কারাখানা মালিকদের কিছুই হয় না। শ্রমের পরিবেশ, শ্রমিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এভাবে কারখানা চালানো কী বড় অপরাধ নয়? এটা কী হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ নয়? নিয়ম না মেনে কারখানা চালালে এবং দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হলে তাকে হত্যা জ্ঞান করে আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। না হলে ফুলিদের মতো কোমলমতি শিশুদের কোনোদিনও ফুল হয়ে ফোটা হবে না। বন্ধ হবে না শ্রমিক শোষণ আর অবৈধ সম্পদের মালিকদের দাপট।
কিছুই হবে না, কিছুই হয় না। হয়, প্রয়োজনীয় আইন নেই, কিংবা আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে হালকা-পাতলা মামলা থেকে বেড়িয়ে যাবে হাসেমরা। অতপর তাজরিনের মালিকের মতো দাঁড়ি রেখে আল্লাহ;র নাম নিয়ে মায়া কান্না করে পার পেয়ে যাবে সমাজের কাছ থেকেও।
আমার সোনার বাংলা যেন ক্রমেই চোর আর ক্রিমিনালদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে। কোথায় গিয়ে রাষ্ট্র যেন থেমে যায়। রাষ্ট্র দায় নিতে চায় না ফুলিদের। সেই কবে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “পাকিস্তান সব নিয়ে গেছে, রেখে গেছে চোরদের। এই চোরদেরও নিয়ে গেলে বেঁচে যেতাম।’’ এখন হয় এই চোরদের দৌড়াত্ম আরো বেড়েছে। তাহলে কী চোর বাটপারদের সাথেই চলতে হবে আজীবন!
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে সারাবিশ্ব আহত হলেও আমাদের পরির্তন হয়নি। বরং বেনিয়া বলে যাদের সারাজীবন জেনেছিলাম তারাই দেশের গার্মেন্টস খাতের আমুল পরিবর্তন এনেছিলেন। গার্মেন্টস কারখানার সার্বিক ব্যবস্থাপনা, শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে ইরোপীয়ান এবং আমেরিকান ক্রেতা গ্রুপ একর্ড আর অ্যালায়ে্ন্স গঠন করেছিলেন। কিন্তু দেশের স্বার্থান্বেসী মহল সেই একর্ড এবং অ্যালায়েন্সকে এক প্রকার তাড়িয়েই দিলো। শ্রমিকদের রক্ত পান করতে না পারলে যেন তাদের ঘুম হয় না।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, গাজী টেলিভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই