Saturday 17 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও মৃত্যু ঘটছে কেন?

শামীম আহমেদ
১৮ জুলাই ২০২১ ১৬:২১ | আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২১ ১৭:১৮

করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও কেউ কেউ আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, এ ধরনের খবরে ভ্যাকসিন নিয়েছেন এমন অনেকেই উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। আবার যারা ভ্যাকসিন নেননি, তাদের অনেকেই ভ্যাকসিন নিতে চাচ্ছেন না। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে এই যে আশঙ্কা, উৎকণ্ঠা– এটি সারা পৃথিবীতেই রয়েছে এবং এ নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা চলছে। চলছে গবেষণাও।

চলুন দেখে নেওয়া যাক ভ্যাকসিন কি আসলেই মৃত্যু ঠেকাতে পারছে না? যদি ভ্যাকসিন কার্যকর হয়, তবুও কেন মানুষ মারা যাচ্ছে?

বিজ্ঞাপন

দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা
ভ্যাকসিন কারও কারও ক্ষেত্রে কাজ করছে, অন্যদের ক্ষেত্রে কাজ করছে না; আবার কিছু ভ্যাকসিন একেবারেই কাজ করছে না, অন্য ভ্যাকসিন পুরোদমে কাজ করছে— এই ধারণাগুলো মোটেও ঠিক নয়। আপনি যে ভ্যাকসিনই নিয়ে থাকুন না কেন, সেটি যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত হয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা আপনাকে গুরুতর অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। ভ্যাকসিন ভেদে ফাইজার ও মডার্নার করোনাভাইরাস ঠেকিয়ে দেওয়ার কার্যকারিতা ৯০ শতাংশের উপর এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্মা, এবং জনসন এন্ড জনসনের কার্যকারিতা ৬৫ শতাংশের আশেপাশে হলেও এই সবকটি ভ্যাকসিনই মৃত্যু ঠেকাতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে। তবে এর পরও ভ্যাকসিন নিয়ে কেউ কেউ মারা যাচ্ছেন। কেউ দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও মারা যাচ্ছেন কেন?

স্বাস্থ্য গবেষকরা বলছেন, ভ্যাকসিনের পূর্নাঙ্গো ডোজ নেওয়ার পরও যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের প্রায় সবারই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম । চলুন দেখা যাক কাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং কেন?

বিজ্ঞাপন

দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত মানুষ
স্বাস্থ্য গবেষকরা করোনায় আক্রান্ত ও মৃত মানুষের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, ভ্যাকসিনের একটি বা দুটি ডোজ নেওয়ার পরও যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের প্রায় সবাই ক্রনিক ইলনেস অথবা দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভুগছিলেন। এর মধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং ফুসফুসের জটিলতাজনিত রোগীদের মধ্যে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও হৃদরোগ, কিডনির জটিলতায় আক্রান্ত কেউ কেউ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন মৃত্যুবরণ করছেন।

বেশি বয়সীরা বেশি ঝুঁকিতে
স্বাস্থ্য গবেষকরা বলছেন, যাদের বয়স বেশি তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসে, এবং তাদের আক্রান্ত হওয়ার এবং মৃত্যুর ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও একজন ৮০ বছরের অধিক বয়সী ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণের ঝুঁকি একজন ভ্যাকসিন না নেওয়া ২০ বছরের তরুণের চেয়ে বেশি।

কিছুদিন আগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইংল্যান্ডে দুটি ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও যে ৫০ জন মানুষ মারা গেছেন, তাদের প্রত্যেকেরই বয়স ৫০ বছরের বেশি। অর্থাৎ, দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে ৫০ বছরের কম বয়সী কেউ ওই সময়কালে মৃত্যুবরণ করেননি।

ভ্যাকসিন নেওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে মৃত্যুর হার অত্যন্ত কম
ভ্যাকসিনেশন সাফল্যে বিশ্বে শীর্ষ দেশ কানাডায় ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া ৯৫ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ৩২ জন মারা গেছেন। মৃত ৩২ জনের বেশিরভাগের বয়স ৮০ বছরের অধিক এবং তারা অন্যান্য গুরুতর রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কানাডায় ৮০ বছরে পৌঁছে মানুষের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা যে মাত্রায় হ্রাস পায়; নানা কারণে আমাদের বাংলাদেশে অনেক ৫০ বছর বয়সী মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা একই মাত্রায় হ্রাস পায়।

কানাডায় আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, এক ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়াদের মধ্যে প্রতি ১ হাজার জনে মাত্র ২ জন, এবং দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়াদের মধ্যে প্রতি ১০ হাজার জনে মাত্র ২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, যা অত্যন্ত কম এবং ভ্যাকসিনের সফলতারই প্রমাণ।

এখানে উল্লেখ্য যে, স্থান কাল পাত্র, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ভ্যাকসিনের মান, ভ্যাকসিন সংরক্ষণের মান এবং ব্যক্তির স্বাস্থ্যের অবস্থা ও বয়সের উপর নির্ভর করে একেক দেশে এই মাত্রা একেক রকম হবে।

ভ্যাকসিন নেওয়া বেশিরভাগ মানুষ আর আক্রান্ত হচ্ছেন না, এটি খেয়াল রাখতে হবে
এটি খুব স্বাভাবিক যে ভ্যাকসিন নেওয়া একজন মানুষও যদি মারা যান, তবে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ছি, ভ্যাকসিনের মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছি, কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভ্যাকসিন নেওয়া কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন করোনাভাইরাসে কাছাকাছি যাচ্ছেন। শরীরে নিচ্ছেন, কিন্তু ভ্যাকসিন নেওয়ার কারণে এই বিপুল জনগোষ্ঠী আর আক্রান্ত হচ্ছে না। আক্রান্ত না হওয়ার বিষয়টি যেহেতু আমাদের চোখে পড়ে না, তাই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে আমরা সন্দিহান হই।

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন অত্যন্ত কার্যকর হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। তারপরও কিছু মানুষ মারা যাচ্ছেন, যেটি হতাশাব্যঞ্জক। আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব সতর্ক থাকতে, কিন্তু তবু কিছু মানুষ মারা যাবেন। আগামী দিনগুলোতে এই অবস্থায় আমাদের কী করণীয়?

মহামারিতে হার্ড ইমিউনিটি হয় না, ভ্যাকসিনই একমাত্র সমাধান
জনস্বাস্থ্যের খুব সাধারণ সূত্র হার্ড ইমিউনিটি—যাতে বলা হয়, একটি লোকালয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায় আসলে বাকি ২০ শতাংশ মানুষকে আর ভ্যাকসিন দেওয়া লাগে না, কারণ তাদের আক্রান্ত করার জন্য কেউ বাকি থাকে না— এই সূত্র মহামারিতে কাজ করে না। বিশেষত ২০২১ সাল, যখন বিশ্বের প্রতিটি দেশ একে অপরের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, সেখানে হার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধ সম্ভব নয়। দয়া করে হার্ড ইমিউনিটির অপেক্ষায় থেকে নিজের জীবনকে মৃত্যু ঝুঁকিতে ফেলবেন না। আমাদের চেষ্টা করতে হবে— সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা। আপনি সুযোগ পাওয়া মাত্রই ভ্যাকসিন নিন এবং আপনার চেনাজানা সবাইকে ভ্যাকসিন নিতে উৎসাহিত করুন।

প্রবীণ এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত যেকোনো বয়সী মানুষকে সাবধানে রাখুন
যে কোনো বয়সের মানুষ যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং ফুসফুসে প্রদাহ আছে, তাদের আগেভাগে ভ্যাকসিন দিন এবং যতটা সম্ভব অপ্রয়োজনীয় মেলামেশা থেকে সতর্ক রাখুন। এই রোগগুলো নেই, অথচ অন্যান্য রোগ আছে এবং বয়স ৬০ এর অধিক তাদের ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।

দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব না হলে মাস্ক পরুন
আপনার সঙ্গে একই বাসায় বসবাস করে না এমন মানুষের সঙ্গে যখন ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে কথাবার্তা বলা সম্ভব নয়, সেখানে অবশ্যই মাস্ক পরুন। মাস্ক নাক ও মুখ ঢেকে পরুন। উন্মুক্ত জায়গা, যেখানে অন্য মানুষের শরীর ও শ্বাসপ্রশ্বাস অবধারিত, সেখানে কিছু স্পর্শ করলে হাত ধুয়ে নিন এবং নিজের মুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।

সার্বিকভাবে মন প্রফুল্ল রাখার চেষ্টা করুন। যে জিনিস আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই, যেমন কোরবানির বাজারের যৌক্তিকতা অথবা লকডাউনের সময়কাল নির্ধারণ করা— সেসব বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করে, উষ্মা প্রকাশ করে, উচ্চরক্তচাপ বাড়িয়ে করোনায় হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াবেন না।

সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। পরনিন্দা থেকে দূরে থাকুন এবং সুস্থ বিনোদন উপভোগ করুন।

লেখক: সোশ্যাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ডক্টরাল রিসার্চার, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আইএসপিএবি’র ভোট শুরু
১৭ মে ২০২৫ ১০:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর