করোনাকে কাবু করতে ভ্যাকসিনই শেষ ভরসা
১৯ জুলাই ২০২১ ১৯:১২
দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশেষত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। করোনার চলমান ঢেউ মোকাবিলায় সরকার ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিনেই মৃতের সংখ্যাটা পূর্ববর্তী সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। সেদিন মারা যান ১৪৩ জন। সেই রেকর্ড বাড়তে বাড়তে ছাড়ায় দুইশ’র ঘর। সবশেষ সোমবার (১৯ জুলাই) একদিনে সর্বোচ্চ ২৩১ জনের মৃত্যু দেখেছে বাংলাদেশ। এই মাসের ১৯ দিনের মধ্যে ১০ দিনই মৃত্যু ছিল দুই শতাধিক এদিকে, জুলাইয়ের আগে যেখানে একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল ৮ হাজারের ঘরে, সেখানে জুলাইয়ের ১৯ দিনের মধ্যে ১২ দিনই সংক্রমণ ছিল ১১ হাজারের বেশি। দুই দিন সংক্রমণ ১৩ হাজারও ছাড়িয়েছে।
হুট করে করোনা পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ রূপ নেওয়ার নেপথ্যে কী? দেশে যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট হু হু করে ছড়িয়ে পড়েছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ এটি। কারণ করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অন্য সব ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে ভয়াবহ এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাস শনাক্ত হয়। গবেষণা অনুযায়ী, মে মাসের ৪৫ শতাংশ নমুনায় এ ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। দিন যতই গড়াচ্ছে, এর হার বেড়েই চলছে। জুন মাসের ৭৮ শতাংশ নমুনাতেই ভয়াবহ এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
কোন পথে হাঁটতে চলেছে দেশের করোনা পরিস্থিতি? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত করোনার ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে সবচেয়ে শক্তিশালী ও দ্রুত সংক্রমণশীল হিসেবে আখ্যা দিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। শুধু বাংলাদেশ বা ভারত নয়, ইউরোপ, আমেরিকাতেও ভয়ংকর এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশেই এরই মধ্যে চলছে করোনার তৃতীয় ঢেউ। সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৮০টি দেশে এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে এবং খুব দ্রুত সময়ে বিস্তার লাভ করছে।
আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর সঙ্গে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপসর্গে মিল থাকলেও কিছুটা পরিবর্তিত উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা গেছে এই ভ্যারিয়েন্টে। বিশেজ্ঞরা বলছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের অন্যতম প্রধান উপসর্গ মাথা ব্যথা। এর পাশাপাশি গলা ব্যথা, সর্দি ও জ্বরও থাকতে পারে। তবে এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হলে স্বাদ বা গন্ধের অনুভূতি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। পাশাপাশি কাশি হওয়ার সম্ভাবনাও বেশ কম।
যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়ান্ট অন্তত ৬০ শতাংশ বেশি সংক্রামক। এছাড়া আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোতে আক্রান্তদের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির আশঙ্কাও প্রায় দ্বিগুণ।
দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সব ভয়াবহতার দৃশ্য এখন আমাদের সামনে প্রতীয়মান। লাফিয়ে লাফিয়ে সংক্রমণ বাড়ছে, আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন আগের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর জন্য তিল পরিমাণ জায়গা নেই। চিকিৎসা খাতে দেখা দিয়েছে তীব্র সংকট। চারিদিকে চিকিৎসাসেবার জন্য এখন চলছে হাহাকার।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২২ জুন পর্যন্ত ৬৪ জেলার মধ্যে ৩৬টি জেলাতেই করোনা চিকিৎসার জন্য আইসিইউ ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে মৃত্যুর ৭৭ শতাংশ হয়েছে আইসিইউ সুবিধা কম থাকা সাতটি বিভাগে। অথচ গত বছরের (২০২০) ২ জুন একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। ১৩ মাসেও জেলা পর্যায়ে আইসিইউ স্থাপন করতে না পারার নেপথ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাফেলতি ও পরিকল্পনাহীনতাই দায়ী। স্বাস্থ্য খাতের সুচিকিৎসা করানোটা এখন সময়ের দাবি।
দেখা যাচ্ছে, জেলা পর্যায়ে করোনা আক্রান্ত রোগীরা নিজ জেলায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা না পেয়ে জীবন বাঁচাতে ছুটে যাচ্ছেন রাজধানী ঢাকা অভিমুখে। ফলে সেখানে বাড়ছে রোগীর চাপ। এক জেলা থেকে আরেক জেলায় হু হু করে ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রমণ, বহুগুণে। দেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি দিন দিন যে পরিমাণে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, এখনই সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ‘ফিল্ড হাসপাতাল’ তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ দেশে হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যার বিপরীতে বহুগুণ করোনা রোগী। এ পরিসংখ্যান দিন দিন বেড়েই চলছে।
বিভিন্ন সময়ে আগত করোনার বিভিন্ন ঢেউ মোকাবিলায় সরকারকে কখনো লকডাউন, বিধিনিষেধ, সীমিত পরিসর; কখনো কঠোর বিধিনিষেধের মতো সীদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সম্প্রতি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় সরকার ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে এবারের কঠোর বিধিনিষেধ কঠোরভাবেই পালিত হতে দেখা গেছে। মানুষকে ঘরমুখো করতে যৌথবাহিনী মাঠে নামানো হয়েছে, জেল-জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু ঘরের বাইরে যে দেশের সিংহভাগ মানুষের রুটি-রুজি, দু’মুঠো ভাত আর প্রাণে বেঁচে থাকার স্থল, সেখানে লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ মানে হলো ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। লকডাউনে এসব নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষদের আর্ত চিৎকার আমরা সমাজপতি, সমাজসেবী, সাহেব, বিত্তবানরা কি শুনতে পাই? এ দেশে যে পরিমাণ বিত্তবান রয়েছেন, তারা এসব প্রান্তিক মানুষদের জন্য এগিয়ে এলে জাতীয় এ দুঃসময়ে এ মানুষগুলো একটু ছায়া পাবেন, প্রাণে বাঁচবেন।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে করোনা সংক্রমণ রোধে ভ্যাকসিন প্রয়োগ নিশ্চিত না করে লকডাউন, শাটডাউন, কঠোর বিধিনিষেধে এখন আর কাজ হবে না। করোনা সংক্রমণ রোধে শুরু থেকে সরকার লকডাউন দিলেও মানুষের মাঝে লকডাউন মেনে চলতে ছিল তীব্র অনীহা। সম্প্রতি আরোপিত লকডাউনও মানুষ সেভাবে আমলে নেয়নি। অকারণে রাস্তায় বের হলে প্রশাসন জেল-জরিমানা-শাস্তি দিয়ে ঘরে অবস্থান করতে বলছেন। কিন্তু মানুষ কি আদৌ ঘরে থাকছে? শহরের প্রধান প্রধান রাস্তাঘাট, দোকানপাট বন্ধ থাকলেও গ্রামের অলিগলিতে, বিশেষ করে চায়ের দোকানগুলোতে মানুষের জনস্রোত দেখা গেছে। একই চিত্র শহরের অলিগলিতেও।
এ অবস্থায় গণমুখী ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচি বাস্তবায়ন ছাড়া করোনাকে কাবু করার আর কোনো পথ নেই। ফেব্রুয়ারিতেই এই প্রক্রিয়া শুরু করলেও এপ্রিলের শেষের দিকে থমকে যেতে হয়েছিল। সরকার নতুন করে চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ থেকে ভ্যাকসিন আনতে তৎপর হলে ফের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। সম্মুখ সারির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, চিকিৎসা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থী— এদের মাধ্যমে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হলেও পরে তা সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রবাসী যারা দেশে এসে আটকা পড়েছিলেন, তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী সাধারণ মানুষের জন্যও ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ৩০ বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে।
সিরাম প্রতিশ্রুতি না রেখে ভ্যাকসিন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করলেও এখন সরকারের কেনা চীনা ভ্যাকসিনের পাশাপাশি কোভ্যাক্স থেকে বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন আসতে শুরু করেছে। সিরামের কাছ থেকে যথাসময়ে ভ্যাকসিন পেলে আমরা হয়তো আরও আগেই সাধারণ জনগণ পর্যায়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচি সফল করার পথে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারতাম। দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত সেই লক্ষ্যপূরণের পথে সরকার আবারও একধাপ এগিয়ে গেছে।
এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনেই হলো করোনাকে কাবু করার কার্যকর অস্ত্র। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা ভ্যাকসিন নিয়েছে তাদের করোনা প্রতিরোধের হার প্রায় শতভাগ। আশার কথা হলো, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব ভ্যাকসিনিই করোনার সব ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর। গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব দেশে করোনায় মৃত্যুর হার বেশি দেখা যাচ্ছে সেসব দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগের হার সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ। আবার ইসরায়েলের মতো দেশ যেখানে ৬০ শতাংশ নাগরিক করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়েছে, সেখানে মৃত্যু ও হাসপাতালে রোগী যাওয়ার সংখ্যাটা অতি নগণ্য। তাই এটা স্পষ্ট, ভ্যাকসিন করোনা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অন্যতম প্রধান কার্যকর উপায়।
চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ও লকডাউনে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গণমানুষ এখন দিশেহারা। ঈদুল আজহা সামনে রেখে সব পরিস্থিতি বিবেচনায় চলমান লকডাউন তুলে দেওয়া হয়েছে। তাতে লকডাউনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কতটুকু অর্জিত হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। লকডাউন, শাটডাউন, সীমিত পরিসর, কঠোর বিধিনিষেধ— এগুলো প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে কতটুকু কার্যকর, তা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। কারণ কেউ কারও কথা শুনতে চায় না। তাই এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিনই হতে পারে করোনাকে কাবু করার সবশেষ অস্ত্র। করোনাকে প্রতিহত করতে ভ্যাকসিনের কোনো বিকল্প নেই। দেশের সব নাগরিকের ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দ্রুতই নিতে হবে সরকারকে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/টিআর