কোন পথে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ?
২০ জুলাই ২০২১ ১০:৩০
গত ২৫ জুন হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি এবং তার সাবেক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও বর্তমান আফগানিস্তানের হাই কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল রিকনসিলেশনের প্রধান আব্দুল্লাহ। এসময় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যহার করে নিলেও আফগানিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন শেষ হয়ে যাবে না। তবে ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত আফগানদের নিজেদেরই নিতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো— দীর্ঘ ৪০ বছরের যুদ্ধকবলিত ভঙ্গুর আফগানিস্তান কি পারবে তাদের নিজেদের ভাগ্যের সিদ্ধান্ত নিতে? এ প্রসঙ্গে আলোচনা করার জন্য প্রথমেই একটু শুরুর দিকে ফিরে যাওয়া যাক।
আফগানিস্তানে যেভাবে যুদ্ধের শুরু
আফগানিস্তানের রক্তাক্ত ইতিহাস শুরু হয়েছিল সত্তরের দশকে। ১৯৭৮ সালের সাওর বিপ্লব। তৎকালীন আফগান রাষ্ট্রপতি জেনারেল মোহাম্মদ দাউদ খানকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত এবং হত্যা করে সোভিয়েত সমর্থিত পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তানের (পিডিপিএ) নেতারা। ক্ষমতায় আসেন পিডিপিএ’র মদদপুষ্ট হাফিজুল্লাহ আমিন।
‘পিডিপিএ’ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী সবুজ ইসলামি পতাকার বদলে সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে লাল রঙের পতাকার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এর ফলে জনগণ অসন্তুষ্ট হয় এবং প্রথমবারের মতো জাতি পর্যায়ের অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন হাফিজুল্লা আমিন এবং কাবুলের গদিতে বসেন বাবরাক কারমাল।
পরে আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ চরমে উঠলে আফগানিস্তান দখল করে নেয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। দীর্ঘ ৯ বছর দলখদারিত্ব বজায় ছিল। ১৯৮৯ সালে মিখাইল গর্বাচেভ আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেন এবং আফগানিস্তানে নজিবুল্লাহর নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে ১৯৯২ সালে মুজাহিদিনদের হাতে দুর্বল নজিবুল্লাহ সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু তখন ও মুজাহেদিনদের আভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলের কারণে গৃহযুদ্ধ শেষ হয়নি। উল্লেখ্য, তৎকালীন মুজাহেদিনরা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত ছিল। ওই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে মোল্লা ওমর সিঙ্গেসরে ফিরে আসেন এবং প্রায় অর্ধশত মাদরাসাছাত্র নিয়ে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। আর এই দলটিই তালেবান (ছাত্র) নামে পরিচিত। দলটি ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে এবং ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলা পাল্টে দিয়েছে আফগানিস্তানের রাজনীতি। ওই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত হন জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন। বিন লাদেনকে তালেবানরা আশ্রয় দিয়েছে— এমন অভিযোগ তুলে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী দখল করে নেয় আফগানিস্তান। শুরু হয় আফগানিস্তানে আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ।
যুদ্ধ শেষ না করেই সেনা প্রত্যাহার কী বার্তা দেয়?
চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন সৈন্যদের আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হলেও নির্ধারিত তারিখের আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট। এই যুদ্ধে আমেরিকার খরচ হয়েছে প্রায় ২ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার। ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে এখন পর্যন্ত ২৩০০ মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মারা গেছে। আহত হয়েছে প্রায় ২০ হাজার সেনা। সেই সঙ্গে ৪৫০ জন ব্রিটিশ সৈন্যের প্রাণহানি ঘটেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি দেশের কয়েকশ সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে দুই দশকের এই যুদ্ধে। তবে এই যুদ্ধে বহুগুণ বেশি হতাহত হয়েছেন আফগানরা। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজারেরও বেশি সদস্য নিহত হয়েছেন। সাধারণ বেসামরিক আফগানের মৃত্যুর সংখ্যা তারও দ্বিগুণ। বিশ্লেষকদের মতে, নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহার রাজনীতিতে তিনটি বার্তা দেয়—
১. কোভিড মহামারিতে আমেরিকার ব্যর্থতা ও অর্থনৈতিক সংকট
কোভিড-১৯ বিশ্বের যেসব দেশে জাঁকিয়ে বসেছে তার মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মহামারি ঠেকাতে ট্রাম্প প্রশাসন এতটাই হিমশিম খেয়েছে যে অনেকেই এই ব্যার্থতাকে আমেরিকার গত নির্বাচনে ট্রাম্পের হারার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে। এমনকি নিজের ব্যার্থতাকে আড়াল করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়াই মার্কিন সর্বেসর্বা ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে ‘চায়না ভাইরাস’ বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও করোনাভাইরাসকে চীনের ল্যাবে তৈরি মানবসৃষ্ট জীবাণু-অস্ত্র বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প। মূলত আমেরিকার স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা ও কোভিড-১৯-এ সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধ্বসের কারণে বাইডেন প্রশাসন আর চাচ্ছেন না সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। এজন্যই তড়িঘড়ি করে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছে বলে মনে করেন কিছু বিশ্লেষক।
২. সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ বিশ্বে গুরুত্ব হারিয়েছে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ যে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছিলেন, সাম্প্রতিক সময়ে তা অনেকটাই গুরুত্ব হারিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের তকমা ছাড়াও বিশ্ব রাজনীতিতে এখন নতুন নতুন রোডম্যাপ তৈরি হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের নয়া বাণিজ্যযুদ্ধ যুক্ত হয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশলেও বিভিন্ন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিদেশের মাটিতে বিপুলসংখ্যক সৈন্য মোতায়েনের বিকল্প পথ খুঁজছে বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলো। মূলত পরাশক্তিগুলোর যুদ্ধ ক্ষেত্রে ‘বুটস অন দ্য গ্রাউন্ড’ কমিয়ে এনে ডিজিটাল প্রযুক্তির দিকে ধাবিত হওয়াই এর মূল লক্ষ্য।
৩. বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের সম্ভাব্য প্রভাব ঠেকানো
একটা সময় ছিল যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই আমল অতীত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙন ও সাম্প্রতিক কোভিড-১৯-এ মার্কিন সাম্রাজ্যের অচলাবস্থা বিশ্ব রাজনীতিতে চীনকে বৈশ্বিক পরাশক্তির কাতারে নিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে চীন। চীনের সামনে এখন কেবল সামরিক শক্তিতে বলিয়ান হওয়ার পালা। অন্যদিকে কোভিড-১৯ মহামারিতে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো যখন নাকানি-চুবানি খাচ্ছিল, চীন তখন নিজের দেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করে বিশ্ববাজারে রমরমা ব্যবসা শুরু করে দেয়। আর এই বৈশ্বিক বাজারের অর্থনীতিতে ঢুকে পড়া চীনকে ঠেকানোর দিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বাইডেন প্রশাসন।
সাম্প্রতিক তালেবানের পুনঃউথান ও আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
আফগানিস্তান বরাবরই বৈশ্বিক রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। আর এই গুটি নিয়ে নানা সময়ে খেলা করেছে বিশ্ব মোড়লরা। সাম্প্রতিক সময়েও নতুন খেলা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপক। আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্যেই পাকিস্তান, রাশিয়া ও চীন আফগানিস্তানের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে এবং তারা তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, বিষয়টি সহজভাবে নিচ্ছে না মার্কিনপন্থি ঘানি প্রশাসন ও তাদের মিত্র ভারত ও তুরস্ক। এর ফল হিসেবে আফগানিস্তান পরাশক্তিগুলোর তুরুপের তাস হয়েই থাকবে।
দীর্ঘ সময় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে আফগানিস্তানে দেখা মেলেনি বহুদলীয় উদার গণতন্ত্রের কিংবা প্রতিষ্ঠিত হয়নি প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র। ১৯৯৬ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় থাকাকালীন শরিয়াহ্ভিত্তিক ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিল। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে তালেবানরা আফগান রাজধানী কাবুলে ক্ষমতাসীন ছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র তিনটি দেশ তাদের স্বীকৃত দিয়েছিল— পাকিস্তান , সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এছাড়াও তালেবানের শাসনামলে আফগানিস্তানে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কথিত আছে, তালেবানের শাসনামলে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংসতা ও নারীশিক্ষায় প্রতিবন্ধকতা তৈরির মতো নৈরাজ্য তৈরি হয়েছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবাঞ্ছিত ছিল আফগান নারীরা। ধর্মীয় আইনের নামে নারীদের অধিকার ও ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছিল। বাংলাদেশের বেশকিছু ইসলামপন্থা মতাদর্শীদের কাছে তালেবানের রাজনীতি সাচ্চা ইসলামপন্থা মনে হলেও বিগত বছরে তালেবানের রাজনীতিতে প্রকৃত ইসলামপন্থা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির দেখা মেলেছে।
সাম্প্রতিক তথ্যমতে, আফগানিস্তান ভূখণ্ডের ৮৫ শতাংশ দখল করে নিয়েছে বলে দাবি করেছে তালেবানরা। যদিও এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন দেশটির বর্তমান ঘানি সরকার। উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে পশ্চিমা সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই তালেবানের হামলা-সহিংসতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। প্রতিনিয়ত সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে দেশটির বিভিন্ন এলাকার দখল নিতে শুরু করেছে সশস্ত্র এ গোষ্ঠীটি। আমেরিকার সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহার করলে আফগানিস্তানে সরকারি বাহিনী ও তালেবানের বিরোধে একটা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে এবং এই যুদ্ধে আমেরিকার মদতপুষ্ট দুর্বল ঘানি সরকারের পরাজয় অনেকটাই নিশ্চিত। এটাও সুনিশ্চিত যে পশ্চিমা সেনা প্রত্যাহার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে তালেবান কাবুল দখল করবে।
এখন আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যত অনেকটাই নির্ভর করছে তালেবানদের হাতে। এজন্য প্রথমেই তালেবানদের নিজেদের একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ জরুরি। সাম্প্রতিক আফগানিস্তানের রাজনীতিতে বর্তমানে মোটা দাগে একটিই প্রশ্ন, আর তা হলো— তালেবান কি পারবে অতীতের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে একটা বহুদলীয় উদার গণতান্ত্রিক আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে? কিংবা, তথাকথিত নয় বরং প্রকৃত ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েম করতে, যেখানে থাকবে না তাঁবেদারি সরকার, থাকবে না বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ, থাকবে না ধর্মের নামে গৃহযুদ্ধ?
এছাড়াও ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে আফগান ভূমিতে থাকবে না জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদার অভয়ারণ্য। উল্লেখিত বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ আফগানিস্তান বিনির্মাণে রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। সমঝোতাবিহীন আফগানিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভবিষ্যত অস্বচ্ছ।
লেখক: গবেষক
সারাবাংলা/টিআর