তালেবানি ঢেঁকুর; বাম-ডানে একাকার
৩ আগস্ট ২০২১ ১৪:৪০
মোস্তফা কামাল
আফগান-তালেবান, ইসরাইল-তুরস্ক, চীন-মিয়ানমার, ভারত-পাকিস্তানের হাল পরিস্থিতি নিয়ে কথার খই ফুটছে বাংলাদেশে। গণমাধ্যমে স্ট্রেট নিউজের পাশাপাশি ঘুরানো-প্যাঁচানো কলাম, মন্তব্য, বিশ্লেষণও তুমুল। এর প্রায় সব কটিই বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। একটিতেও নেই ভালো কিছুর নিশানা। এর মাঝে আবার জামায়াত-হেফাজতের পুলকও গোপন নেই। প্রাসঙ্গিক করে ফেলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদেরও। বাংলাদেশকে কেউ প্লেগ্রাউন্ড করতে চায় কি-না, প্রশ্নের সঙ্গে তা উৎকণ্ঠারও।
রোহিঙ্গা ছাড়াও নানা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় তুরস্কের খেলাটা বেশি উদাম হয়ে পড়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের জন্য ভীষণ দরদি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট জোসেপ তাইপে এরদোয়ান বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের সুযোগ দেয়ায় যারপরনাই শুকরিয়া জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে তোলপাড় করে ফেলার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনেও ছুটে এসেছিলেন তুরস্কের ফাস্ট লেডি। রোহিঙ্গা নারীদের জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটির সেকি আবেগঘন দৃশ্য। এর মধ্যেই রোহিঙ্গা শিবিরে পুড়ে যাওয়া হাসপাতাল আবার নির্মান করে দেয়ার আয়োজন। রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস।
সেই তুরস্কই নিজ দেশে মুসলিম শরনার্থী ঢুকতে বাধা দিতে দেয়াল বানিয়েছে। কী নির্লজ্জ স্ববিরোধীতা। প্রান বাঁচাতে ইরান সীমান্ত দিয়ে তুরস্কের দিকে যাওয়া আফগান শরনার্থীদের ঠেকাতে সীমান্তে দীর্ঘ দেয়াল দিয়েছে। সাথে একশো পর্যবেক্ষণ টাওয়ারও। তুরস্কের বক্তব্য হচ্ছে, তারা তাদের সীমান্তকে সুরক্ষিত করেছে। কেবল তাই নয়, তুরস্ক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তার দেশে ঢুকে পড়া আফগান শরনার্থীদের আটকও করেছে। মিয়ানমার থেকে প্রানভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা মুসলিম। আফগানিস্তান থেকে প্রানভয়ে পালানো ব্যক্তিরা মুসলিম নয়? কী দাঁড়ালো অর্থটা?
অর্থ যা-ই দাঁড়াক তালেবানদের গর্জে ওঠায় আফগানিস্তানে আবার নতুন প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশেও আন্দোলনের যাবতীয় রসদ বিদ্যমান বলে ধারনা তাদের সাঙ্গাতদের। করোনা মোকাবেলায় হযবরল, স্বাস্থ্যখাতে কেবল অব্যবস্থাই নয়, করোনার উছিলায় সাগরচুরিসহ পিলে চমকানো বিশাল অংকের দুর্নীতি-জোচ্চুরি, অভাব, দ্রব্যমূল্যসহ নানা নাগরিক সমস্যা অন্তহীন। এসব নিয়ে দৃশ্যত আন্দোলন নেই মানে ক্ষোভ নেই বিষয়টি মোটেই তা নয়। মানুষ স্বপ্রণোদিতভাবেই ফুঁসছে। কিন্তু, আন্দোলনে রাজপথে নামার সুযোগ-বাস্তবতা কোনোটাই নেই। সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ায় টুকটাক ভাগে-যোগে চলছে। আন্দোলনের রসদ থাকলেও বড় বিরোধীদল বিএনপির সেই শক্তি-সামর্থ নেই। কৌশল খুঁজে ফিরছে তারা। অন্য কোনো দল বা মহল সরব হলে মাঠে নেমে শর্টকাটে ফল খাওয়ার আশায় বিএনপি। তবে, নামে অরাজনৈতিক হলেও রাজনীতির ‘ইনার কোর্টে’ এগুচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। তাদের চেতনা ভিন্ন জায়গায়। মোটেই সরকারের দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের চণ্ডালতা বা স্বাস্থ্যখাতের নৈরাজ্য নিয়ে নয়। আফগানিস্তানে তালেবানদের দাপট ফিরে আসায় উল্লসিত তারা। সামনে সুদিনের স্বপ্ন দেখছে। আশা করছে সুযোগ হাতে এলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাইকে দেখিয়ে দেয়ার।
মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ছাড়তে গিয়ে দেশটিতে তৈরি করা তাদের পোষ্য-তোষ্য বা রাজাকারদেরও নিয়ে যাচ্ছে। ৮ হাজার আফগান ‘রাজাকার’ আমেরিকায় পুনর্বাসনের জন্য ভিসা ও ৫০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিতে মার্কিন সেনেট ৯৮-০ ভোটে জরুরি বিল পাশ করেছে। কী জয়জয়কার ‘রাজাকারদের’! সহযোগী আফগান কোলাবরেটর ও তাদের পরিবার বর্গকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তালেবানদের রোষানল থেকে রক্ষার জন্যে নিজেদের দেশে নিচ্ছে। একাত্তরে পাক সেনাদের বিশ্বস্ত রাজাকারের মতো এরা ছিল মার্কিন সেনাদের খাস পছন্দের আফগান।
সৎ, দেশপ্রেমিক ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলদের হয়রানি, আদালতের বারান্দায় জুতার সুকতলা ক্ষয়ের বিশ্বায়ন। আর বর্বরদের রাজসম্মান। তুরস্কের শরনার্থী আশ্রয় দেয়ার ইতিহাস যে নেই এমনও নয়। তবে, এ নিয়ে অংক কষায় বেশ ওস্তাদ তারা। তুরস্ক ৪০ লক্ষ সিরিয়া লিবিয়া ইরাকিদের আশ্রয় দিয়েছে। তবে, আফগান যুদ্ধাপরাধি- রাজাকারদের তা দিতে চায় না। কিন্তু, বাংলাদেশের রাজাকারদের প্রতি তাদের বেশ টান। তাদের ফাঁসি ও বিচারের কি চেষ্টাই না করেছে।
বাংলাদেশ নিয়ে ‘ফাউল গেমে’ সবারই যেন নিরবচ্ছিন্নতা। যে দিকে পারে টোকা দেয়। বাংলাদেশকে চীনের এন্টি কোয়াডে নিতে জাতিসংঘকেও ব্যবহার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। কতো টোপ ফেলা হচ্ছে! ইদানিং তারা প্রস্তাব দিছে বাংলাদেশেই রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করতে, লাগলে বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি অর্থ ঋন নিয়ে দেবে বলে। এর বিপরীতে কোয়াডে যোগ দিলে রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেয়ার ফোঁসফাঁসও কম নয়। তুর্কি মিডিয়ার খবর হচ্ছে, তুরস্ক বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য আধুনিক ফ্রিগেট তৈরির অংশীদার হতে চায়। পাকিস্তান তো তুরস্কের সাথে তা শুরু করেছেই।
এদিকে, চীন-পাকিস্তানের নেকনজরে ধন্য তালেবানরা যুদ্ধ ময়দানের মতো বহির্বিশ্বের কূটনীতিতেও পারঙ্গম হয়ে উঠেছে। মার্কিনীদের হারিয়ে এখন আরো অনেককে টেক্কা দিচ্ছে। ইরান রাশিয়ার জার্নি শেষে তালেবান কূটনীতিকদের পদচারনা এখন চীনে। এর পেছনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রচুর বোলিং-ব্যাটিং কাজ করেছে। চীন সফর করা তালেবান নেতারা চীনকে আশ্বস্ত করেছেন কোনো দেশের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। জবাবে আফগানিস্তানে শান্তি আনতে চীন ভূমিকা রাখবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। তালেবানদের কথা শুনলে বাংলাদেশে গাত্রদাহ হওয়া বিশিষ্টজনদের থ হয়ে যাওয়া ছাড়া আপাতত উপায় নেই। আস্তিক-নাস্তিক, কমিউনিস্ট-ইসলামিস্টদের এই মিতালি সামনে কতো দূর গড়ায় অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। প্রতিবেশি ভারতে এ নিয়ে এক চোট হয়ে গেছে। চিনা পার্টির শতবর্ষ অনুষ্ঠানে বাম-যোগ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিসির শতবর্ষ উপলক্ষে দিল্লির চিনা দূতাবাস ভার্চুয়াল আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল। তাতে যোগ দিয়ে মোদী সরকার তথা বিজেপির প্রশ্নের মুখে পড়লেন এ দেশের বাম নেতারা। কমিউনিস্টদের বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য রয়েছে অভিযোগ তুলে বিজেপির যুক্তি, নিয়ন্ত্রণরেখায় যখন দু’দেশের মধ্যে টানাপড়েন চলছে, তখন বাম নেতাদের এ বিষয়ে আরও সতর্ক থাকা দরকার।
পাল্টা জবাবে সিপিএম, সিপিআই নেতারা বলছেন, মোদী সরকার কি নিজে চিনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে? সমস্ত বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছেদ করে দিয়েছে? না কি চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে এ দেশের রাজনৈতিক দলের কথা বলা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে? বামেদের অভিযোগ, মোদী সরকার আসলে পেগাসাস, পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, বেকারির মতো বিষয় থেকে নজর ঘোরাতে এই সব প্রশ্ন তুলছে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/ এসবিডিই