Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মহিয়সী বঙ্গমাতা

মো. আসাদ উল্লাহ তুষার
৮ আগস্ট ২০২১ ১৫:৫৬

প্রথমেই বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিনকে (৮ আগস্ট) সরকার জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। দেরিতে হলেও সরকার এই মহিয়সী নারীর জন্মদিনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান ও মর্যাদা দেয়ায় তাঁর প্রতি রাষ্ট্রের একটা শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ হলো। আমাদের জাতীয় জীবনে বঙ্গবন্ধুর পরেই বঙ্গমাতার অবদান অবিস্মরণীয়। তাই তাঁর তুলনামূলক স্বল্প দিনের কিন্তু ঐতিহাসিক জীবনকে চিরস্মরণীয় করার লক্ষ্যে  এই দিবস পালন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন মরণের সঙ্গী। তিনি মাত্র পয়তাল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন । ছোটবেলাতেই বঙ্গবন্ধুর সাথে তার বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক সিদ্ধান্তে। তারপর সংসার জীবন শুরু করে যতদিন বেঁচেছিলেন তিনি লড়াই সংগ্রাম করে বেঁচেছিলেন। কতদিন আর সংসার জীবন ছিল তাঁর? এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তাঁর স্বামীকে সাড়ে চৌদ্দ বছরের মতো জেলে থাকতে হয় । তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়ন নির্যাতন সহ্য করে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন । কিন্তু পেছন থেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন,সাহস জুগিয়েছেন বঙ্গমাতা। স্বামী দিনের পর দিন জেলে, তিনি তার ছোট ছোট সন্তানদেরকে নিয়ে সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে খুবই কষ্টে দিনযাপন করেছেন। এমনও সময় গেছে শেখ মুজিবের স্ত্রী হিসেবে তাঁকে অনেকেই বাসা পর্যন্ত ভাড়া দিতে চান নাই। সন্তানদের নিয়ে তিনি অমানবিক কষ্ট করেছেন, পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু জেলখানায় থাকার কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে সমস্ত আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে শলাপরামর্শ করেছেন, তাদের সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করেছেন । জেলে বঙ্গবন্ধুর নিকট খবর দেয়া নেয়া, কিভাবে আন্দোলনকে সফল করা যায় সেই বিষয়ে নেতৃবৃন্দকে পরামর্শ দেওয়া, বিশেষ করে ছাত্র নেতৃবৃন্দকে উদ্বুদ্ধ করা এ সবকিছুই তিনি একজন দেশপ্রেমিক, বিশ্বস্ত, সৎ, সর্বোপরি একজন সাহসী নারী হিসেবে এ কাজগুলো করেছেন। পাশাপাশি তাঁর সংসারকে তিনি  সামলিয়েছেন একহাতে, যার স্বামী দেশের জন্য দিনের পর দিন কারাগারে থাকে একজন স্ত্রীকে তার ছোট ছোট সন্তান নিয়ে কি অমানবিক জীবন যাপন করতে হয় তা শুধু ভুক্তভোগী  ভালো জানেন। আর সেই স্বামী যদি হয় সরকারের প্রধান ‘শত্রু’।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগ্রামমুখর দিনগুলোতে যে সব ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার নেপথ্যে ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলোতে কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। এ ছাড়াও তাঁর সাথে যারা মিশেছেন আন্দোলন সংগ্রামে পরামর্শ নিয়েছেন, জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে যেসব বিষয়ে কথা বলেছেন তা থেকে বুঝা যায়; শত অন্যায় অত্যাচারের হুমকির মুখেও বঙ্গবন্ধুকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলে থাকতে যখন আইয়ুব খান প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বসার আমন্ত্রণ জানায় তখন অনেক নেতার সায় থাকলেও বঙ্গবন্ধুর মতোই বঙ্গমাতা প্যারোল না নেয়ার ব্যাপারে খুবই শক্ত অবস্থানে ছিলেন। গোল টেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু যোগদান করলে একজন মুক্ত মানুষ হিসেবেই যোগদান করবেন, কোনো প্যারোলে না। স্বামীর ফাঁসির দড়ি যার গলার সামনে সেই সময়ে স্বামীকে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানে দৃঢ় থাকতে এমন মর্যাদাপূর্ণ কঠোর অবস্থানে কয়জন স্ত্রী থাকতে পারবেন, যা বেগম মুজিব পেরেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু একজন মুক্ত মানুষ হিসেবেই গোল টেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। বাঙালি তাঁর অবিসংবাদিত নেতাকে আন্দোলনের মাধ্যমেই মুক্ত করেছিলেন সেদিন। একইভাবে সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে কি বলবেন নানাজনের নানা মতের পরামর্শের মধ্যে বঙ্গমাতার পরামর্শ ‘তোমার অন্তর থেকে যা আসে তাই বলবে’ সেই সময়ে সেই সুপরামর্শ বেগম মুজিবই  দিয়েছিলেন। এমন আরো অনেক উদাহরণ তাঁর পক্ষে দেয়া যাবে। এমনই ছিলেন বঙ্গমাতা।

একজন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার খুব নিকটে অবস্থান করেও যে সহজ-সরল আটপৌরে জীবন যাপন করা যায় তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। মূলত তিনি ছিলেন বৃহৎ একটি পরিবারের মধ্যমণি। তাঁকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হত এই বাংলাদেশের আবেগ অনুভূতি, লড়াই-সংগ্রাম ও শ্রদ্ধা ভালোবাসার শেষ আশ্রয়স্থল ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি। যেখানে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব নেতারা কোন না কোন সময়ের ঐ বাড়ির আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। তিনি যেমন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রধান প্রেরণা শক্তি ছিলেন। তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে নিয়োজিত সকল মত পথের নেতাকর্মীদেরও প্রেরণা যোগাতেন বঙ্গমাতা। আর এসব করতে গিয়ে তাঁকে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তিনি শুধু জাতির পিতার স্ত্রী হিসেবে নয় একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ছিলেন নেপথ্যের একজন শ্রেষ্ঠ ও প্রধান কারিগর। তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা, যিনি তাঁর সন্তানসম্ভবা কন্যা ও শিশু পুত্রকে নিয়ে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর হাতে মৃত্যুকূপে নয় মাস বন্দি ছিলেন।

শুধু বঙ্গবন্ধু বললেই শেখ মুজিবকে যেমন দেশ-বিদেশের মানুষ বাংলাদেশের জাতির পিতা হিসেবে চেনে। ঠিক তেমনি বঙ্গমাতা বললেই শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে বোঝে। বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতা বাঙালির এই প্রাণ নিঃসরণ করা উপাধি, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা তাঁদের নিজেদের নামকে ছাড়িয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুই যে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনক, তেমনি বঙ্গমাতা বললে শেখ ফজিলাতুন্নেছাকে বোঝানো হয়, যিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়তমা স্ত্রী। যিনি অত্যন্ত ছোট বয়স থেকে বঙ্গবন্ধুর সব সময়ে পাশে থেকেছেন। ঠিক শেষ বিদায়েও বঙ্গমাতা ঘাতকের বুলেটের সামনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মরণের সাথী হয়েছেন, শহীদ হয়েছেন। কিভাবে হত্যা করেছিল খুনিরা বঙ্গমাতাকে? তাঁর চোখের সামনেই কি তাঁর সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল? শিশু পুত্র রাসেলকে কি তাঁর সামনেই ব্রাশ ফায়ার করে ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়েছিল? বঙ্গমাতার সামনেই কি তার প্রিয়তম স্বামী এই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যিনি জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন সেই বঙ্গবন্ধুকে কি তার সামনেই বুলেট বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল? নাকি খুনিরা আগেই বঙ্গমাতাকে হত্যা করেছিল। কেন হত্যা করেছিল বঙ্গমাতাকে? এমন একজন মহীয়সী নারীকে, বাংলাদেশ সৃষ্টির অকৃত্রিম যোদ্ধা, বাঙালির মাকে,বোনকে যিনি কিনা নির্লোভ, নিরহংকারী, সাদামাটা জীবনযাপন করতেন, ক্ষমতার দম্ভ যার পবিত্র শরীরকে একবিন্দু স্পর্শ করতে পারেনি। শান্ত, স্নিগ্ধ, সৌম্য চেহারার বাঙালি নারীদের এক পবিত্র প্রতিচ্ছবি বঙ্গমাতাকে, রক্তাক্ত করেছিলো খুনিরা পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের সুবেহ সাদেকের সময়। ছোটবেলায় যিনি পিতামাতা হারিয়েছিলেন, খুবই অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় শশুর শাশুড়িই ছিলেন যাঁর সবকিছু। তারপর বয়স একটু বাড়তেই স্বামীর ভালোবাসা স্নেহ মমতায় যিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তিনিই কিনা একদিন হয়ে উঠেছিলেন একটি রাষ্ট্রের নির্ভরতার প্রতীক হয়ে, বাংলার মা হয়ে। স্বামীর জীবনেও যেমন পরম সঙ্গী ছিলেন মরণেও তেমনই সঙ্গী হলেন।

এই দেশের জন্য তাঁর যে ত্যাগ,স্বাধীনতার জন্য তাঁর যে সংগ্রাম তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। বেঁচে থাকতে তিনি কোন মূল্যায়নের আশায় কিছু করেনি। তিনি সবকিছু নেপথ্যে থেকে করেছেন। এই নেপথ্যে থেকে করতে গিয়েও তাঁকে অনেক মানসিক নিপীড়নের মধ্যে থাকতে হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলিতে তো বটেই মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস তাঁকে থাকতে হয়েছে মৃত্যু কূপে। দুই সন্তান মুক্তিযুদ্ধের  রণাঙ্গনে। স্বামী শেখ মুজিবকে পঁচিশে মার্চের গভীর রাতে ধানমন্ডির নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার করে কোথায় রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, যা আল্লাহ তাআলা ছাড়া কেউ জানতেন না। তিনি বেঁচে আছেন না তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে, তা স্ত্রী হিসেবে বঙ্গমাতাসহ বাংলার মুক্তিকামী মানুষ জানতেন না। এমন  অবস্থায় কী নিদারুণ মানসিক যন্ত্রনায় বন্দিশালায় থাকতে হয়েছিল বঙ্গমাতাকে তা কল্পনাও করা যায় না! তিনি শুধু জাতির পিতা বা রাষ্ট্রপতির স্ত্রী নন। তাঁর দুই সন্তান রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নিজেও সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন,যুদ্ধের সময়ে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন। তিনি তো শ্রেষ্ঠ নারী মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা না বললে অন্যায় করা হবে।

এমন একজন মহিয়সী নারীর জন্মদিনকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে দেশ তাঁর কিছু ঋণ শোধ করার সুযোগ পেলো। তাঁর জীবন ও কর্ম ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পাঠ্যপুস্তকে স্থান করে দেয়া দরকার। তাঁর সাহস, শক্তি, দেশপ্রেম, সততা ও নিষ্ঠা আগামী প্রজন্মের জন্য বিরাট এক শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে থাকবে। যিনি তাঁর স্বল্প সময়ের জীবন মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছেন, কোন কিছুর বিনিময় ছাড়াই। জন্মদিনে মহিয়সী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

সারাবাংলা/এসবিডিই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর