আন্তর্জাতিক যুব দিবস ও কিছু উন্নয়ন ভাবনা
১২ আগস্ট ২০২১ ১৭:৪৩
সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও প্রতি বছর ১২ই আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস উদযাপন করা হয়। যুবদের কথা, কাজ, উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি তাদের জীবনের অর্থবহ দিক ও সার্বজনীনতা সবার কাছে তুলে ধরা এবং স্বীকৃতি দেয়া এ দিবসের মূল লক্ষ্য। আর্ন্তজাতিক যুব দিবস ২০২১ এর প্রতিপাদ্য- Transforming Food System: Youth Innovation for Human and Planetary Health। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করা এবং যুবদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে খাদ্য ব্যবস্থায় কিভাবে রূপান্তর আনা যায়, সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেই সাথে এ ধরণের বিষয়কে প্রতিপাদ্য হিসেবে বিবেচনা করার কারণ হলো, যুবদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া এ ধরণের বৈশ্বিক সংকট দূর করার প্রচেষ্টার সাফল্য অর্জিত হবে না। তাই প্রতি বছর স্থানীয়, জাতীয় এবং বৈশ্বিক নানা বিষয়ে ও পর্যায়ে যুবদের প্রতিনিধিত্ব কিভাবে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো যেতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া হয়। বৈশ্বিক বিভিন্ন সংকটের কারণে বিশ্বের অনেক জনগোষ্ঠীই বর্তমানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও খাদ্য নিরাপত্তার সম্মুখীন হচ্ছে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সারা পৃথিবীব্যাপি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো কোভিড-১৯ এর প্রার্দুভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তন। এখনও সকল ক্ষেত্রে ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুবদের সম্পৃক্ততা ও ক্ষমতায়নের অভাব রয়েছে। এই বিশাল সংখ্যক যুবদের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করতে পারলে তারা দেশের উন্নয়ন তথা গণতান্ত্রিক রাজনীতির উৎকর্ষ সাধনে ভূমিকা রাখতে পারবে না, তাই যুবদের সহযোগিতা নিয়ে দেশ তথা বিশ্ব এগিয়ে যাবে, রাষ্ট্রায়ত্ব, স্বায়ত্বশাসিত, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানেই যুবদের কাজ করার সুযোগ করতে তৈরি করতে হবে, যেন তারা তাদের মেধা ও দক্ষতা বিকাশের সহায়ক পরিবেশ পায়। কোভিড-১৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের মতো সংকট কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার লক্ষ্যে যুবদের অর্থবহ অংশগ্রহণ অতীব জরুরী। যুবদের সক্ষমতার প্রয়োগ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ও তাদের কর্মোদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তাদের প্রতিনিধিত্বকে নিশ্চিত করতে হবে।
এদেশের মুক্তি সংগ্রাম থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এ দেশের যুবসমাজ। শুধু তাই নয় দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজকে আলোকিত করতে এই যুব সমাজের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। যুবসমাজ এদেশের ক্রান্তিকালে সব সময় নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে নিজেরা যেমন হয়েছেন ইতিহাসের উজ্জ্বল স্বাক্ষী, তেমনিভাবে তাদের এই আত্মত্যাগ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হয়ে আছে চির অনুসরণীয়। গণতান্ত্রিক সকল আন্দোলন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এ দেশের যুবসমাজ সবসময় ছিলো সক্রিয় এবং অনাচারের বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠকে সব সময় উচ্চকিত করেছে, তারই মধ্য দিয়েই এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। কখনো বদলে গেছে ঘুনে ধরা পুরো প্রেক্ষাপট। তবে আজ সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যুব সমাজের অংশগ্রহণ কখনো কখনো আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে, কারণ আমরা সমাজের কল্যাণকর কাজের পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই যুবসমাজ নানা ধরণের ঘৃণ্য অপকর্মের সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় যুবসমাজ নেশায় আসক্ত হয়ে পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে তৈরি হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য কখনোই কাম্য নয়, কাম্য ছিলও না। কারণ আমাদের অতীত ইতিহাস কখনোই আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় না। এ দেশের যুবসমাজ প্রগতিশীল ভাবনা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে যে অতীত স্বর্ণালী ইতিহাস তৈরি করেছে তা আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তবে বর্তমানে কেন, যুব সমাজের মধ্যে কুলুষিত রাজনৈতিক দীক্ষা আর রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অপব্যবহারের মাধ্যমে বিত্ত-বৈভব কুক্ষিগত করার নগ্ন মানসিকতা তাদের মগজে ঠাঁই পেয়েছে?
আমি বরাবরই একজন আশাবাদী মানুষ। আমি এখনো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এ দেশের যুবসমাজ এখনো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায় নি, তবে কিছু যুবক বা যুবতী রয়েছে যারা কিছুটা পথভ্রষ্ট, যে মূল্যবোধের ইতিবাচক শিক্ষায় তাদের মেধা ও মনন বিকশিত হওয়ার কথা ছিল, সেটি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি, ফলে তারা আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব কে অগ্রাধিকার দিয়ে জীবনকে পরিচালিত করছে। যেটা সামগ্রিকভাবে একটি হতাশার জন্ম দিচ্ছে। তবুও আমি বিশ্বাস করি, এ প্রজন্মের মাঝেও অনেক সৃজনশীল প্রতিভাবান যুবক ও যুবতী রয়েছে। যাদের কর্মতৎপরতায় শুধু তারা নিজেরাই বিকশিত হচ্ছে না বরং তাদের ব্যক্তিক সাফল্যের দ্বারা তারা পুরো দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। দেশের অর্জন এবং সুনামকে তারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই ইতিবাচক দিকগুলো আমাদের যুব সমাজের মাঝে বেশি করে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাদেরকে ছাত্রাবস্থায় জীবন গঠনে ইতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে জানানোর সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ একটা পর্যায় থাকে, যখন মানুষের মস্তিষ্ককে যেভাবে পরিচালিত করা হয়, মস্তিষ্ক ঠিক সেভাবেই তার প্রতিফলন ঘটায়। সুতরাং আমাদেরকে চলমান সঙ্কট দূর করার ক্ষেত্রে আশাবাদী হতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে কেউ যেন ভুল পথে ধাবিত করতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। কারণ আজকের এই যুবসমাজই আগামী দিনে এদেশের কর্ণধার হবেন। রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। সুতরাং এখন থেকে তাদের মাঝে যদি মূল্যবোধের ইতিবাচক চর্চা এবং জীবন সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি করা যায়, তাহলে এটি যেমন ঐ যুবকদের ব্যক্তিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তেমনি এ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চাকাকে গতিশীল রাখতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। যার ফলে এ দেশের উন্নয়নে ছেলে মেয়ে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মিলে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন রয়েছে, সেটাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা সম্ভবপর হবে। সুতরাং পুরুষের পাশাপাশি পরিবারের নারী সদস্যদের কে সমান সুযোগ দিয়ে এবং তার অর্জিত মেধা-দক্ষতাকে যেন দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারে, সেই ধরণের সুযোগ বা ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই, আমাদের দেশে যেকোনো বিষয়ে নারীর ক্ষমতায়নে নারীর জীবন দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কোন কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নেই। একটি আশাবাদের বিষয় হলো, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে পিছিয়ে পড়া কিশোরী ও যুবতী নারীদের কে সম্পৃক্ত করে আমাদের জীবন, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ শীর্ষক একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। আমরা জানি, কোন একটি বিশেষ এলাকার বাস্তবায়িত উন্নয়ন উদ্যোগের ফলাফলগুলো থেকেও কিছু কার্যকর উন্নয়ন ধারণা বা শিখণ ফল তৈরি হয়, যার মাধ্যমে দেশের এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে সহায়ক হয়। পাশাপাশি, আমাদের চারপাশে যে সকল যুবরা আছেন তাদের মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের যে অভিযাত্রা দেশব্যাপী চলছে, সেখানে যেন নারী ও পুরুষের মধ্যে সমঅধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের মানসিক দৈন্যতার প্রকাশ না ঘটে। আমি বিশ্বাস করি, আত্মবিশ্বাসী যুবদের অংশগ্রহণে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ, সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরির মাধ্যমে আরো এগিয়ে যাবে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায়।
লেখক- জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/আরএফ