Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১৫ আগস্ট, লেখার ভাষা নেই

মো. আসাদ উল্লাহ তুষার
১৫ আগস্ট ২০২১ ০০:১৮

বঙ্গবন্ধুকে দেখার সৌভাগ্য আমাদের অনেকের হয়নি। কিন্তু আবার এই ভেবে ভালো লাগে যে, বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়ই তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় আমাদের জন্ম হয়েছিল। রাজনীতি বোঝার বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধু আছেন আমার হৃদয়ের মণিকোঠায়। বঙ্গবন্ধু দিন দিন আরও প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠছেন। তিনি দিন দিন জ্বল জ্বল হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন আমাদের মাঝে। মনের অজান্তেই বঙ্গবন্ধুময় হয়ে উঠেছি আমরা। কেউ কি কোনদিন বলে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর প্রেমে পড়তে! পারিবারিক একটা পরিবেশ অবশ্য ছিল। তারপরও বলবো, আমরা বহু মানুষ বঙ্গবন্ধুর কারণেই তার প্রেমে পড়েছি। এবং এই প্রেম আরও দিন দিন গাঢ় হচ্ছে। প্রবল ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি দিনকে দিন। তার প্রতি ভালোবাসা দিন দিন বাড়ছে। যখন এই ভালোবাসা শুরু তখন পাওয়া না পাওয়ার কোনো চিন্তাই মাথায় ছিল না। রাজনীতির মাঠে তখন মনে হতো বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেই জীবন পার করে দেব। যে বয়সে কোনো তরুণীর প্রেমে পড়ার কথা, সত্যি বলছি, সে বয়সে প্রেমে পড়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর।

না বুঝেই কি সেই কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সে মুজিবপ্রেম আমাদের উপর ভর করেছিল? না, জীবনে যদি কোনো কিছু বুঝেশুঝে করি- তা করেছিলাম, ভালোবাসা শুরু করেছিলাম বঙ্গবন্ধুকে।

সময়টা খুব যে অনুকূলে ছিল তা বলা যাবে না। খুনিদের সরাসরি আস্ফালন বা তাদের পৃষ্ঠপোষকতাকারীদে দম্ভ তখনো শেষ হয়নি। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নিয়ে তখনো  চলছিল নিষ্ঠুর অপপ্রচার। সেই সময় থেকে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা শুরু।

যখন কিছুটা বোঝা শুরু করেছি, তখন একটি জিনিস বুঝেছি, যার স্বপ্নের সোনার বাংলা তিনিই নেই। আর সবাই আছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু নেই! এ যে কী নিদারুণ যন্ত্রণা! কী যে বেদনা তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। সেই থেকে এই নিষ্ঠুরতাকে কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি,পারবও না কোনোদিন।

শুধু কি বঙ্গবন্ধু? বঙ্গমাতাসহ তার পরিবারের প্রায় অধিকাংশ সদস্যকেই হত্যা করেছিল ঘাতকরা। সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ জননেতা,মুক্তিযুদ্ধের বীর সংগঠক, বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী,যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনিকে সস্ত্রীক হত্যা করেছিল শকুনেরা। যখন তার স্ত্রী আরজু মনি ছিলেন সন্তানসম্ভবা। তার একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের। ভগ্নীপতি কৃষকনেতা ও মন্ত্রী আব্দুর রব সেরেনিয়াবত। তার আদরের সন্তান,কলিজার টুকরা, নাতি ও বাড়িতে আগত আত্মীয়সহ সতেরজন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কারা করল এই হত্যাকাণ্ড! যারা সেদিন ব্রাশফায়ার করে বাংলার মাটিকে রক্তে রঞ্জিত করেছিল শুধু কি তারাই দায়ী? কী অপরাধ ছিল বঙ্গবন্ধুর। জীবন যৌবন তুচ্ছ করে দিয়ে,জীবনের সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে বার বার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দেয়াই কি ছিল তার অপরাধ! এর পেছনে কি সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া সেই খুনিরাই ছিল? নাকি তাদের পৃষ্ঠপোষক মোস্তাক-জিয়া চক্রের সঙ্গে আরও কোনো বৃহৎ শক্তি বা বহিঃশক্তি ছিল।

বঙ্গবন্ধু তখন শুধু তৎকালীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ছিলেন না, শুধু একটি দেশের স্বাধীনতার মহানায়কই ছিলেন না, বা  একটি দেশের জাতির পিতাই ছিলেন না, তিনি সেই সময়ে ছিলেন একজন বিশ্ববরেণ্য নেতা। যার শৌর্যবীর্য, ব্যক্তিত্ব,সম্মোহনী ক্ষমতা সবকিছু মিলে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিশ্বনেতা হিসেবে পৃথিবীর বুকে পরিচিতি পেয়েছিলেন। পৃথিবীর তাবৎ বাঘা বাঘা নেতা,রাষ্ট্রপ্রধানরা তাকে সমীহ করতেন, সম্মান করতেন,মর্যাদা দিতেন। তিনি সেই সময়ে ছিলেন দেশে দেশে মুক্তিকামী শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দূত, আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। হয়তো এটাই ছিল খুনিদের চোখে তার বড় অপরাধ।

স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরে তখনো পাকিস্তানি ভূত দূর হয়নি। তারা ঘাপটি মেরে বসেছিল, বা কেউ কেউ পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে সুযোগের অপেক্ষা করছিল একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে।

মহান হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু তার সিংহ হৃদয় দিয়ে মানুষকে শুধু ভালোবেসে গেছেন। এই বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। যারা তার এক কথায় জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল এবং জীবনও দিয়েছিল। তার বিনিময়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছিল। তাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর সেই ভালোবাসা দেখানোটা কোনো অন্যায় ছিল না। হ্যাঁ, বেশি ভালোবাসা দেখানোটা হয়তো অনেকেই তার কোমল হৃদয়ের দুর্বলতা মনে করতেন। কিন্তু কুচক্রীরা ভালোবাসা না পেলেও কিছুটা ক্ষমা তো পেয়েছিলই। কিন্তু এই কুচক্রীরা যে মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শুধু হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবেই থেকেছে তা নয়, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে পরাজয়ের গ্লানিও তারা এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেনি। তাদের পেয়ারের পাকিস্তানকে বাংলার দামাল ছেলেরা মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন করে নিলো। তাদের উপর্যুপরি বিরোধিতা ও হত্যাযজ্ঞ কোনো কিছুই দমাতে পারেনি বাঙালিকে। ফাঁসির মঞ্চে নিয়েও মুজিবকে দমাতে পারেনি তারা। এই একটা অপরাধেই সেই সব চক্ররাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে।

পনেরই আগস্টে কারা সেদিন খুশি হয়েছিল? কারা তার পরে দুটি অবৈধ সরকারের মসনদে বসেছিল তা দেখলেই বুঝা যায়। জিয়ার সঙ্গে বেশি সংখ্যায় কারা গিয়েছিল? খুনিদের চাকরি বাকরি ও রাজনীতি করার অধিকার কে দিয়েছিল?

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব,বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব,মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল,শেখ জামাল ও তাদের স্ত্রীদ্বয়,শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় পরিজনকেই হত্যা করেনি, সেদিন খুনিরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকেই হত্যা করেছিল। আর ব্যক্তি মুজিবকে তো হত্যা করে শেষ করা যায় না। বঙ্গবন্ধু তো বাঙালির হৃদয় মননে ততদিন থাকবেন যতদিন বাংলাদেশ থাকবে,পৃথিবী থাকবে। ততদিন তিনি বাংলার মানুষের কাছে নায়ক হিসেবে জাতির পিতা হিসেবে থাকবেন।

মুজিবের মৃত্যু নাই। তিনি দিন দিন বাংলার মানুষের কাছে আরও দীপ্তিময় আলোকশিখার মতো জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াচ্ছেন। একদিন যে কুচক্রীরা তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। তারাই আজ ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তারা বেইমান,মীরজাফর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে- যা তাদের অনিবার্য প্রাপ্য ছিল।

কোথায় আজ পনেরই আগস্টের খুনিরা?কোথায় তাদের মাস্টারমাইন্ডরা? বাংলার ইতিহাসে তাদের জায়গা কী রূপে? তারা সেদিন কত বড় অন্যায় করেছিল- ভাবা যায়? পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার কি হয়েছে, কি না হয়েছে, কয় জন খুনির ফাঁসি হয়েছে বা কয়জন খুনি পালিয়ে আছে তা নিয়ে হয়তো আলোচনা করা যায়, কিন্তু কী পরিমাণ ক্ষতি তারা এই বাংলার করেছে তার কি কোনো পরিমাপ করা যায়!

মুজিবের বাংলায় আজ মুজিব নেই। আশির দশকে নেই,নব্বই দশকে নেই,বিংশ শতাব্দীতে নেই। তখন ছিল জনকের প্রিয় ভূমিতে খুনিদের উল্লাস নৃত্য। অবরুদ্ধ ছিল গণতন্ত্র, বিভীষিকাময় ছিল বাংলার পরিবেশ। সেদিন দারোয়ান ছিল ক্ষমতার শীর্ষে। বেইমানরা ছিল তার চারপাশে। স্তব্ধ ছিল আকাশ বাতাস, অন্ধকার ছিল বাংলার পরিবেশ। পনেরই আগস্ট আসে বারবার, জাতি পালন করে নয়ন জলে। আগস্ট হৃদয়ে ঝাঁকুনি দেয়। লেখার ভাষা নেই পনেরই আগস্ট নিয়ে। মুজিবের বাংলায় মুজিব নেই, অথচ কাপুরুষেরা আছে সদর্পে।

তাই পনেরই আগস্টে কিছু লিখতে পারি না। দেশ সেবার যে অল্প সময় বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন তার বিশদ বর্ণনা দিতে পারি না। দেশের মানুষের প্রতি তার যে হৃদয় নিঃসরণ ভালোবাসা তা প্রকাশ করতে পারি না। বঙ্গমাতার যে ত্যাগ তা কল্পনাও করতে পারি না। বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল ও শেখ জামাল এবং তাদের নববিবাহিতা স্ত্রীদের না শুকানো মেহেদীর রঙয়ে রঞ্জিত তাদের সেই ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করতে পারি না। শিশু রাসেলের বেঁচে থাকার আর্তচিৎকার কল্পনাও করতে পারি না। সস্ত্রীক তরুণ জননেতা শেখ ফজলুল হক মনির দেশপ্রেম আর দেশ নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তাকে যেভাবে বুলটবিদ্ধ করা হয়েছিল, তা ভাবতেও পারি না। মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সাহেব, তার শিশু সন্তান আরিফ সেরনিয়াবাত ও আদরের নাতি সুকান্ত বাবুকে কিভাবে হত্যা করেছে তা কল্পনায়ও আনতে পারি না। পনেরই আগস্টে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ভাই শেখ নাসের, কর্নেল জামিলসহ অন্য আরও যারা শহিদ হয়েছিলেন তারা অমর। আমরা সবাই আছি বঙ্গবন্ধু নাই, বঙ্গমাতা নাই, শেখ কামাল, শেখ জামাল নাই,শেখ রাসেল নাই,শেখ ফজলুল হক মনি নাই,আরজু মনি নাই,শেখ নাসের নাই, নাই আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শিশু আরিফ ও  সুকান্ত বাবু। অথচ খুনিরা এখনো আছে! আর আমরা আছি একবুক যন্ত্রণা নিয়ে,পিতা হারানোর বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুরই বাংলাদেশে এতিম বেশে।

লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর