১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু ,আমার বাবা এবং শোকাবহ শূন্যতা
১৫ আগস্ট ২০২১ ১৮:৫৬
অশ্রুভেজা শোকাবহ ১৫ আগস্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস। আজকের সূর্যোদয় হয়েছে মহান নেতা জাতির পিতাকে স্মরণ করে—যে মানুষটির হাত ধরে এসেছিল স্বাধীনতা, সবুজ মানচিত্র, লাল সবুজের পতাকা, একটি দেশ—তার কথা বলছি।
“বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই মুজিব”
“কে বলেছে মুজিব নাই, মুজিব সারা বাংলায়”
“এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে”
এই শ্লোগানগুলো আমার রক্তের সঙ্গে সতত প্রবহমান । মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যে মানুষটি থাকবে আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। আমি কোনো দিন বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখিনি। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি। কিন্তু এই দুঃখবোধ যেমন আমাকে কাঁদায়, ঠিক তেমনি মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু আমার প্রতিদিনের অহংকার।
আমার বাবার সৌভাগ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়ার। আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু সেই গল্পগুলো কতবার যে শুনেছি বাবার মুখে। বঙ্গবন্ধু যে স্কুলে পড়াশোনা করতেন, আমার বাবাও পড়তেন একই স্কুলে। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর কয়েক বছরের ছোট। বাবা প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন। স্কুলে প্রথম বেঞ্চে বসতেন। কিন্তু কয়েকজন ছেলে প্রায়ই বাবার বই খাতা ফেলে পেছনে রেখে দিতো। বাবা একদিন সেই সময়ের মুজিবকে এই বিষয়টি জানান। তারপর থেকে বাবা প্রতিদিনই প্রথম বেঞ্চে বসতেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে না দেখলেও এরকম অনেক গল্প শুনে বেঁড়ে উঠেছি বঙ্গবন্ধুর সাহস আর শক্তি নিয়ে।
আমার বাবা আমাদের একটি লোহার তৈরি রড দেখাতেন আর বলতেন এটি নিয়েই তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসভায় রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন। সেই জনসভার গল্প আমরা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি।
ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধুর একটি পোস্টার আমাদের বাসায় টাঙানো দেখতাম। পঁচাত্তরের সেই দুঃসময়েও বাবা পোস্টারটি নামাতে দেননি। অনেক আত্মীয়স্বজন এসে সতর্ক করত। বাবা বলতেন, একবারতো ৭১-এ মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছি । সেই সময়ের দু’আনা দামের বঙ্গবন্ধুর সেই পোস্টারটি হৃদয়ের একেবারে গহীনে নিয়েই বড় হয়েছি।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে আমি ছোট ছিলাম। কিন্তু সেই সময়ের বিভীষিকাময় দিনগুলোয় আমার আব্বা ভীষণ আহত হয়েছিলেন। তার ভেতরের শূন্যতা এখনো অনুভব করি। শেখ সাহেবকে মেরে ফেলেছে ঘাতকরা— এটা তিনি ভাবতেই পারছিলেন না। পাকিস্তানিরা যা করতে সাহস করেনি, এ দেশেরই কিছু লোক তা ঘটিয়েছে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ ৭৫-এর ১৫ আগস্টে ঘাতকের নির্মম বুলেটে নিহত সকল শহিদদের। ঘাতকরা ভেবেছিল জাতির পিতাকে হত্যা করলেই তার নাম মুছে ফেলা যাবে এই বাংলায়। কিন্তু তারা বোঝেনি বঙ্গবন্ধুর আরেক নাম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ প্রত্যাশিত যাত্রা থেকে বিচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছিল।
আমার বাবা কোনো নেতা ছিলেন না, কিন্তু সরকারের একেবারেই একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে জীবন পার করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু জীবনাচরণে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতো সাহসী এবং স্বাধীনচেতা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করল, তখন বিটিভিতে বেশ কিছু অনুষ্ঠান হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মানুষের কাহিনী নিয়ে। সেই সময় আমার বন্ধু আব্দুন নূর তুষার বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তুষার মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতা জানতে আমার বাবার একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকদিন আগে জানতে পারি সেই সময়ের অনুষ্ঠানের কোনো কিছুই নেই বিটিভির আর্কাইভে।
আমার কষ্ট হয়েছিল শুনে, সেটিই ছিল মিডিয়াতে আমার বাবার প্রথম এবং শেষ সাক্ষাতকার অথবা কথকতা। সেটিও তুষার বার বার অনুরোধ করায় বিটিভির স্টুডিওতে গিয়েছিল। একথা মনে করার কারণ হলো— বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল না, তখন অনেক বঙ্গবন্ধু সৈনিককে দেখতাম যারা কোনো কিছু চাওয়া পাওয়ার হিসেব না করেই ৩২ নম্বরে ভিড় করতো। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্যে জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানানো বা শেখের বেটিকে এক নজর দেখতে। পরনে ময়লা কাপড়। হয়তো নব্য আওয়ামী লীগার শাহেদদের মতো গুছিয়ে কথা বলতে পারতো না তারা, কিন্তু রিকসায় বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে ৭ই মার্চের ভাষণ শোনাত অবলীলায়। আমি সেই সব মুখগুলো খুঁজে ফিরি । আমাকে এখনো উজ্জীবিত করে সেই সব দৃপ্ত শৃঙ্খলমুক্ত মুখ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর জীবনীকে অনুধাবন করতে হবে। এই দিনে আমরা এই মহামানবকে স্মরণ করি, শোকে কাতর হই, আবার শোককে শক্তিতে পরিণত করতে চাই। বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব, মানবপ্রেম, অধিকারবোধ ও তার নেতৃত্বগুণ, সাহস, সততা, নিষ্ঠা ও আপসহীনতার মতো গুণাবলি নিজেদের ভেতর ধারন করতে হবে আমাদের। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, দেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, সৎ কাজের মাধ্যমেই সম্ভব তার প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
এই পনেরো আগস্ট এলে বাবাও নিঃসঙ্গ একাকী অনুভব করতেন। মাঝে মাঝে ঘৃণা ঝরে পড়ে কতিপয় বিড়ালের উপর। কেন পথভ্রষ্ট স্বার্থান্বেষী ইঁদুরেরা ব্যর্থ হয়ে গর্তের ভিতর ঢুকেছিল? ওরা কি পারতো না বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে? খন্দকার মোশতাকের গোপন ইশারায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল তারা, এগিয়ে এলো না সাহায্য করতে।
মনে হয় এক অভিশপ্ত স্তব্ধতায় নিজের অস্তিত্ব খুঁজে ফিরি। শূন্যতায় খুঁজি শাদা পিরহান..বাবার কণ্ঠে পবিত্র কোরআনের বাণী।
তোমার জন্য অতল শ্রদ্ধা
হে পিতা।
লেখক: অধ্যাপক, হৃদরোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ