প্রতিহিংসার ভয়াল দিন একুশে আগস্ট
২১ আগস্ট ২০২১ ১৩:৫৮
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। শনিবার। রৌদ্রজ্জ্বল বিকেল ৫টার পরের সময়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে, খোলা ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শেষ করলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। প্রাণচাঞ্চল্য সমাবেশে মুহূর্তে নেমে এলো গ্রেনেড হামলার বিভীষিকা। যে কোন সুস্থ মানুষ, সুস্থ রাজনৈতিক ধারা চর্চাকারী এই দিনটিকে গণতন্ত্রের কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করবেন, প্রতিবাদ করবেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে সচেতন নাগরিকদের বুঝতে হবে নৃশংসতম এই দিনটির খুঁটিনাটি।
সিলেটসহ দেশের নানান জায়গায় বোমা হামলা, গোপালগঞ্জে তুষার হত্যাকাণ্ড এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মীদের হত্যা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২১শে আগস্ট দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ডাকে আওয়ামী লীগ। বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ শুরু হয় সমাবেশ। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরা তাদের বক্তব্য রাখছিলেন। তুলে ধরছিলেন সারাদেশে অব্যাহত সন্ত্রাস এবং দুর্নীতির চিত্র। বিকেল প্রায় ৪টার দিকে সমাবেশে অংশ নেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বক্তব্য রাখতে শুরু করেন ৫টা ২ মিনিটে। বক্তব্য শেষে হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করে মাইক থেকে সরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাকে লক্ষ্য করে দক্ষিণ দিক থেকে গ্রেনেড নিক্ষিপ্ত হয়। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেড। ট্রাকের বামপাশে পড়ে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনা ট্রাকের ওপর বসে পড়েন। এ সময় নেতা-কর্মীরা তার চারিদিকে ঘিরে তৈরি করেন মানববর্ম। এ সময়ে কেবল একটি দুটি নয়, পরপর কয়েকটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। গ্রেনেডের পর শুরু হয় গুলি।
একপর্যায়ে আহত নেত্রী শেখ হাসিনাকে ধরাধরি করে ট্রাক থেকে দ্রুত নামিয়ে আনেন নেতাকর্মী এবং দেহরক্ষীরা। তাকে তার বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলে দেন। স্টেডিয়ামের দিক থেকে পিলখানা হয়ে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আসা হয় ধানমন্ডির সুধা সদনে। রক্তাক্ত নেতাকর্মীদের রেখে তিনি সুধা সদনে ফিরতে চাচ্ছিলেন না। বারবার বলতে থাকেন, ‘গাড়ি থামাও, আমি সুধা সদন যাবো না, সবাইকে দেখে তারপর সুধা সদন যাবো।’
সাধারণত ট্রাকের সমাবেশগুলোতে কোন টেবিল রাখা হয় না। কিন্তু পেছন থেকে ধাক্কাধাক্কিতে কেউ যেন পড়ে না যায়, এ কারণে সেদিন ট্রাকের উপর একটা টেবিল রাখা হয়েছিলো। সেই টেবিলটাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জীবন রক্ষায় অনেকটা ভূমিকা রেখেছিল। কারণ গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলে ঐ টেবিলের নিচেই মাথা গোঁজেন তিনি।
শেখ হাসিনা যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন, তখনো একই দিক থেকে গ্রেনেড এসে ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হয়। মাঝে কয়েক সেকেন্ড বিরতি মাত্র। গ্রেনেডের আঘাত আসতে থাকে ক্রমাগত। হামলা ছিলো খুবই পরিকল্পিতভাবে। কারণ হামলার লক্ষ্যবস্তু শেখ হাসিনাকে জখম করতে ব্যর্থ হয়েছে বুঝতে পেরেই বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে শুরু করে হামলাকারীরা। শেখ হাসিনাকে বহনকারী মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির সামনে পিছনে গ্রেনেড ছুঁড়ে ও গুলি করে। গাড়ির চাকা গুলি লেগে পাংচার হয়ে যায়। পরবর্তীতে একাধিক গুলির আঘাতের চিহ্নও দেখা যায় গাড়ির সামনে পিছনে। পাওয়া যায় গ্রেনেডের আঘাত চিহ্ন। গ্রেনেডের বিকট শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার শ্রবণশক্তির।
অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে ফেরেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা আইভী রহমানসহ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ২৪ জন মানুষের তাজা প্রাণ। আহত হন শেখ হাসিনাসহ কয়েকশ নেতাকর্মী। মানুষের চিৎকার, ছোটাছুটি, লাশ আর রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলো বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের পিচঢালা পথ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে আহত-নিহত মানুষের শরীরের ছিন্নভিন্ন অংশ, রক্ত, ছেঁড়া স্যান্ডেল, পড়ে থাকে দোমড়ানো ব্যানার এবং অবিস্ফোরিত গ্রেনেড। যন্ত্রণাদগ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছিলেন কেউ কেউ।
প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন আওয়ামী লীগ কর্মীরা। ঘটনার প্রারম্ভে শেখ হাসিনার নিরাপত্তাকর্মী বাদে আশেপাশে কোন পুলিশ ছিল না, কিন্তু বিস্ফোরণের পরবর্তী ঘটনাস্থল লক্ষ্য করে পুলিশ টিয়ার গ্যাস মারে। কাঁদানে গ্যাসে মানুষজন ছোটাছুটি করলে শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ। ঘটনাস্থলে নামানো হয় রায়ট কার। হাসপাতালের সামনে চিকিৎসা জন্য বিক্ষোভ করলে ঘটে ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া। বিক্ষুব্ধ জনতা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সিটি ভবনে ইটপাটকেল মারতে থাকে। কারণ ধারণা করা হয় হামলা পরিচালিত হয় মূলত এখান থেকেই। আহতদের আর্তনাদ, উদ্ধারকর্মীদের হৈ চৈ, বিক্ষুব্ধ জনতার শ্লোগান আর পুলিশের গাড়ির সাইরেনে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। মোবাইল নেটওয়ার্কও বিকল করে দেওয়া হয় সেসময়ে।\
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এই দুঃসময়ে সংসদ মুলতবি ছিলো। পরবর্তী অধিবেশনে রক্তমাখা পাঞ্জাবি গায়ে সংসদে অংশ নেন সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সংসদে তিনি কথা বলতে চেয়েছিলেন। বিএনপির স্পিকার তাকে এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ দেননি। ২১ আগস্টের সাথে জড়িত নয় এরকম কোন বিশ্বাসযোগ্য আলাপও হাজির করতে পারেনি বিএনপি। বরঞ্চ সংসদে হাসি-তামাশা করে, ভ্যানিটি ব্যাগ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছে। ঘটনাস্থলে টিয়ার সেল মেরে, লাঠিপেটা করে নষ্ট করেছে আলামত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এ হামলার মামলা তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। আদালত প্রমাণ পেয়েছে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা পরিচালিত হয়েছে এবং এর জন্য তৎকালীন বিএনপি জোট সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দায়ী। রায়ে সরকারের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণও মেলে। তারা মঞ্চায়ন করেছে ‘জজ মিয়া’ নাটক। বিএনপিকে নৈতিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত করেছে যে ভবিষ্যৎ সমঝোতার রাজনীতির আর কোন পথ খোলা নেই।
দীর্ঘ ১৪ বছর পরে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার দায়ে ১৯ জনের ফাঁসির আদেশ এবং আরও ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়াও আদালত ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন। রায় বাস্তবায়ন হওয়ার পথ হয়তো এখনো অনেক দীর্ঘ। তবে পরিবার সদস্যদের মৃত্যু সংকটেও আদালত কর্তৃক অপরাধী সাব্যস্ত হওয়াদের ভিতরে পালিয়ে থাকা আসামীরা কেন দেশে আসেন না? সত্যি বলতে- অপরাধ করলে যার শাস্তির ভয় আছে, নৈতিকভাবে যারা দুর্বল তারাই কেবল পালিয়ে বেড়ায়।
রাজনীতির অর্থ কি ক্ষমতা পেয়ে বিরোধিমতের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ? কখনোই না, বরং রাজনীতিতে সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধ থাকবে। সরকারপক্ষ ভুল করলে বিরোধী দল যৌক্তিক সমালোচনা উপস্থাপন করবেন। সমালোচনা থেকে ভুল সিদ্ধান্ত সংশোধনের সুযোগ পাবে সরকারি দল। এটাই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। রাজনীতিতে রক্তাক্ত-বীভৎস অসুস্থ ধারা চালু কেবল অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত।
ভাগ্যক্রমে বুদ্ধিমতী রাজকুমারী ষড়যন্ত্রীদের কাছে বারবার আঘাত পেয়েও জিতে যাওয়া এক বীর। পালিয়ে যাওয়ার নয়, বিপদের দিনে আওয়ামী লীগ একজোট হয়ে দাড়িয়ে থাকা দল। গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ আরও সুসংগঠিত হয়েছে; কর্মীরা ত্যাগের প্রমাণ দিয়েছে নিজ দলের জন্য। ক্যালেন্ডারের পাতায় হাজির হয়েছে প্রতিহিংসার নৃশংসতম সেই ভয়াল একুশে আগস্টের দিনটি। সব ধরনের হামলা এবং হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক, যেন হামলার ষড়যন্ত্রীরা দ্বিতীয়বার উঠে দাঁড়াতে না পারে।
লেখক: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ভাসানী পরিষদ
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই