Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

২১ আগস্ট; রাজনীতির এক কলঙ্কিত অধ্যায়

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ
২১ আগস্ট ২০২১ ১৪:২৯

শোকের মাস আগস্টে বাঙালি জাতির জীবনে বারবার অমানিশা নেমে এসেছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে রাতের অন্ধকারে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিন্তু ঘাতকেরা এখানেই থেমে ছিল না। ২০০৪ সালের আগস্টের রোদ ঝলমলে বিকেল বাঙালির জীবনে নেমে আসে আরেক ভয়াবহ অন্ধকার।

ওইদিন আকস্মিক বিস্ফোরণে রক্তের স্রোত বয়ে যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে, এই বাংলায়। গ্রেনেড, বিস্ফোরণ, ধোঁয়া, স্প্লিন্টার, আর্তনাদ! নেতা-নেত্রীরা ঘিরে ধরলেন বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে, রচনা করলেন মানববর্ম। ভাগ্যের জোরে অল্পের জন্য সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বাঙালির বাতিঘর, আশা ভরসার একমাত্র জায়গা তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিজ্ঞাপন

তবে প্রাণ হারান আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ নেতা-কর্মী। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। যাদের অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। অনেকে এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই বিকেলে রক্তাক্ত ভয়াল হামলার স্প্লিন্টারের দগদগে ক্ষত।

জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদের গ্রেনেড হামলায় যদি সেদিন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের মূল নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন হওয়ার মতো দুঃসময় এসে যেত—তাহলে বাঙালির জীবনে তা কত ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনত সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

আজ দূরদর্শী ও বিচক্ষণ রাজনৈতিক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পশ্চিমা দেশগুলি মুশতাক সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। দেশ পিছিয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য ছিল-দেশের মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা। কিন্তু ওই সময় সঠিকভাবে দেশ পরিচালিত হয়নি। বিশ্বমানচিত্রে লাল-সবুজের দেশটির জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি পর্যন্ত মুছে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু রয়েছেন বাঙালির হৃদয়ে, মননে।
বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছিলেন—

‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান/
দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান/
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বর্বরতা ঘটেছিল জনগণের চোখের আড়ালে, রাতের অন্ধকারে। কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হয়েছে প্রকাশ্যে। কোনো জনসভায় হামলা চালিয়ে একটি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের মূল নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা চালানোর কোনো নজির স্মরণকালের আধুনিক ইতিহাসে বিরল। আগস্টের দুই রক্তপাতের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকতেই পারে না, তা নয়।

হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নান ও গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এটা পরিষ্কার যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা করা।

অথচ আমরা দেখেছি, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও প্রচার করা হয়েছিল—আওয়ামী লীগ নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। তারা এমনও বক্তব্য প্রচার করেছিল যে, গ্রেনেড হামলা এমনভাবে করা হয়েছে যেন শেখ হাসিনা বেঁচে যান এবং জোট সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা যায়। নিঃসন্দেহে এ ধরনের যুক্তি খুবই ন্যক্কারজনক।

এমনকি ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদেও তৎকালীন সংসদ সদস্যরা ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে এখন নৈরাজ্যের মাধ্যমে তারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় যেতে চায়। আর সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই নিজেদের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয়েছে। তখন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল বিএনপি।

১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে ২০০৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় বছরে হরকাতুল জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ১০৬ জন নিহত হন। আহত হন ৭০০’র বেশি মানুষ। আওয়ামী লীগ ও সিপিবির সমাবেশ, উদীচী ও ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর এসব হামলা হয়।

এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকেই হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে অন্তত চার দফা। সব মিলিয়ে ২১বার তাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বিএনপি-জামায়াত জোটসরকার দেশবাসীকে এটা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিল যে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে। কলকাতায় পলাতক শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনায় ১৪ জনের একটি দল এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল।

চারদলীয় জোট সরকার ও গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে ওই সব মিথ্যা তথ্য জোট সরকারের সমর্থক পত্রপত্রিকায় প্রচারও করা হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থক লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সভা-সেমিনারে একই সুরে বক্তব্য দিয়ে, পত্রিকায় কলাম লিখে সেই মিথ্যা প্রচারে সহায়তাও করেছিলেন। কিন্তু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সত্য প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে মুখে যেন কুলুপ এঁটেছে বিএনপি।

এদিকে চারদলীয় জোট সরকারের গঠিত এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিশনের প্রধান বিচারপতি জয়নুল আবেদীনও তার প্রতিবেদনে প্রায় একই কথা বলেছিলেন। মোট ৪০ দিনের অনুসন্ধানে প্রস্তুত ওই তদন্ত প্রতিবেদনে সেসব মনগড়া তথ্য-ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল, যা জোট সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা বলেছিলেন। আর তদন্ত কমিশনের কাছে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সাবেক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহীম যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তাও সেই একই কথা, যা বলেছিলেন চারদলীয় নেতা-মন্ত্রীরা। সাজানো হয় ‘জজ মিয়া’ নাটক। সিআইডি ও পুলিশের ‘জজ মিয়া’ আখ্যান নিয়ে তখনই অনেক গণমাধ্যমে সন্দেহ প্রকাশ করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এতে প্রশ্ন দেখা দেয় দেশের মানুষের মনেও।
পরবর্তীতে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তৎকালীন সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে সত্য প্রকাশ করতে পারেনি। ২১ আগস্টের ঘটনার পরপর ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতও একটি পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিককে বলেছিলেন, এটা আওয়ামী লীগেরই কাজ। এ ঘটনায় তারাই তো লাভবান হবে। তারা সহানুভূতি পাবে। শেখ হাসিনার জ্ঞাতসারেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে ওই পাকিস্তানি কূটনীতিক বলেছিলেন। অথচ যার কোনো ভিত্তি নেই।

তবে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ওই সময় দায়িত্ব নেয় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেনা সমর্থিত ওই সরকারের দেড় বছরে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার নেপথ্যের অনেক তথ্যই বেরিয়ে এসেছিল।
বিচার ও তদন্তে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার জেনে শুনে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ঘটনা এবং উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী ও প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা পরে বলার চেষ্টা করেছেন, পুলিশ ও সিআইডি তাদের ভুল বুঝিয়েছিল। উদ্দেশ্যপূর্ণ তথ্য দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করেছিল। এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের মন্ত্রী-নেতারা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ২১ আগস্টের ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ ও ভারতকেই দায়ী করছিলেন। এ কথা তারা প্রচার করেছেন সুপরিকল্পিতভাবে।

২১ আগস্টের ঘটনার পরপরই পত্রিকার সম্পাদক ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে খালেদা জিয়াও সেসব কথাই বলেছিলেন নানাভাবে। তৎকালীন জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
তারা পেশাদার খুনি চক্র, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং ভারতের ওপর এই হামলার দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলার আলামত নষ্ট করা হয়েছিল। যা সংবাদ মাধ্যমে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

তৎকালীন সরকার প্রধানও ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত করতে বলেছিলেন বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়েছে। তবে সে তদন্ত প্রতিবেদন আর কোনো দিন প্রকাশ করা হয়নি। এসব তথ্যের পটভূমিতে অনেকের মনেই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কি ২১ আগস্ট হামলার সঙ্গে জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের যোগসাজশ ছিল?

শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। সত্য ঠিকই বেরিয়ে এসেছে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ হামলার বিচার পর্ব শুরু হয়। এরপর চলে গেছে ১১টা বছর। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।

এর মধ্য দিয়ে ১৪টা বছর বহন করে চলা এক ভয়াবহ কলঙ্কের ভারমুক্ত হয় জাতির ইতিহাস। প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পেয়েছে। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যায় বিচার। যা বঙ্গবন্ধুকন্যার অঙ্গীকার। এভাবে প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হোক বাংলাদেশে।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর