বঙ্গবন্ধুই শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনাই বঙ্গবন্ধু
২২ আগস্ট ২০২১ ১৫:০৯
আওয়ামী লীগের রাজনীতির চত্বরে হাঁটাচলা করতে গিয়ে যে কথাটি বার বার শুনেছি তা হচ্ছে ‘এই আওয়ামী লীগ তো সেই আওয়ামী লীগ না। আমরা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের ভক্ত। এখনকার আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই’।
এই কথাটি ছাত্রাবস্থায় অনেক ভুগিয়েছে, অনেক চিন্তার খোরাকও দিয়েছে। অনেক সময় দ্বিধায় ভুগেছি, তাহলে কি আমরা ‘আসল’ আওয়ামী লীগকে পেলাম না? আমাদের যাত্রা কি ম্রিয়মাণ আওয়ামী লীগে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিপক্বতা আসে, এবং পরিপক্বতার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় অনেক ষড়যন্ত্রের নাক-নকশা। আমিও বুঝেছি।
এখন যারা বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে আসছেন, তাদের বলব স্বাগতম। সঙ্গে সঙ্গে বলব চোখকান খোলা রাখুন। যতটা সম্ভব পড়ালেখা করুন, ইতিহাস জানুন। অন্যের মতামতকে অবশ্যই গুরুত্ব দেবেন, কিন্তু সবকিছু চোখ বুজে বিশ্বাস করবেন না। একসময় বলতাম সবার সব কথা শুনবেন, তারপর যাচাইবাছাই করবেন। এখন অন্যের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনাকে জরুরি মনে করি, কিন্তু সবার সব কথা শুনে আসলে নিজের চলার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করা সমীচীন নয় বলে মনে হয়। ইতিহাসকে জানার জন্য শুধু তথ্য-উপাত্ত থাকলেই চলে না, সঙ্গে থাকতে হয় রাজনীতি শুকে বিপ্লবের রাস্তা চেনে নেওয়ার ক্ষুরধার যোগ্যতা।
অন্যের কথা চট করে বিশ্বাস করে নিজের ও দলের ক্ষতি করার মধ্যে গর্বের কিছু নেই, আছে বিচ্ছিন্ন ও পিচ্ছিল রাস্তায় ছিটকে পড়ার আশঙ্কা। ১৫ আগস্ট, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৭৯৫ সালের ১৫ আগস্ট পথভ্রষ্ট সেনাবাহিনীর একাংশ এবং আন্তর্জাতিক পরাজিত শক্তির সম্মিলিত ষড়যন্ত্রে তিনি তার পরিবারসহ নিহত হন। তাদের সবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
বাবা বঙ্গবন্ধু ও মেয়ে শেখ হাসিনা
বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা শেখ হাসিনার জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তার জন্মের সময়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন কলকাতায়, নয়া বিভক্ত দেশে তার মানুষদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে ব্যস্ত। শেখ হাসিনার জন্মের প্রায় একমাস পর বঙ্গবন্ধু তার কন্যার মুখ দেখতে পারেন গোপালগঞ্জে ফিরে। শেখ হাসিনার জন্মের পর মূলত বঙ্গবন্ধু কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। এখানেই তার রাজনীতির খুঁটি শক্ত করতে থাকেন, মানুষের ন্যায্য অধিকারের সংগ্রাম করতে থাকেন।
মেয়ের জন্মের মতো বিয়েতেও বঙ্গবন্ধু পাশে থাকতে পারেননি। শেখ হাসিনার বিয়ের সময় ছয় দফা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কারাগারে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে যাওয়ার পর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শেখ হাসিনার বিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হন। বঙ্গবন্ধুকে যেহেতু আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শাসকদের রোষানলে পড়ে নিয়মিত জেলে যেতে হচ্ছিল, তাই বেগম মুজিব পরিবারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কতি ছিলেন। বড় মেয়ের বিয়ে দেওয়া তাই তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে ড. ওয়াজেদ মিয়া লন্ডন থেকে পরমাণু বিজ্ঞানে পিএইচডি করে দেশে ফিরলে তার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ের প্রস্তাব আসে। ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন ছাত্রলীগ প্যানেল থেকে হল ছাত্র সংসদে একমাত্র নির্বাচিত সহসভাপতি। ফজলুল হক হলের এই মেধাবী ছাত্রনেতাকে বঙ্গবন্ধু আগের থেকেই চিনতেন এবং খুশি মনেই মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর অনাড়ম্বরভাবে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। পরবর্তীতে জেলগেটে বঙ্গবন্ধু নবদম্পতিকে দোয়া করেন।
বঙ্গবন্ধু এমন একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক ও দেশপ্রেমিক ছিলেন যে, তার অতি প্রিয় কন্যার জন্ম এবং বিয়ের সময় তাঁর পাশে তিনি থাকতে পারেননি। কিন্তু প্রজ্ঞাবান কন্যা শেখ হাসিনা সবসময় দেশের জন্য বাবার এই ত্যাগ স্বীকারকে সম্মান করেছেন, এমনকি নিজের জীবনেও এই মাহাত্ম্যকে ধারণ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা বিষয়ে বোধহয় আলোচনা করার মতো বিষয়ের শেষ হবে না।বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার রক্ষার আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ডাক দেওয়া বঙ্গবন্ধুই যেন বাংলাদেশের মানচিত্র। ২৫ মার্চ কালো রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের জন্ম দেওয়া মানুষটি নিজের চাইতে ভালোবেসেছেন দেশ ও দেশের মানুষকে। বাংলাদেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা দৌড়েছেন সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায়। স্ত্রী-সন্তানদের বঞ্চিত করতেও দ্বিধা করেননি। ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১ কোথায় নেই তার নেতৃত্ব, কোথায় নেই তার ভরাট কণ্ঠস্বর? জেলখানার দেওয়ালে দেওয়ালে তার আত্মত্যাগের বাণী।
এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অনুপস্থিতিতে যাতে বাংলাদেশ নেতৃত্বশূন্য হয়ে না পড়ে, তার জন্য উপযুক্ত মানুষদের তিনি প্রস্তুত করেছেন, তৈরি করেছেন। শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের অনুরোধ শুনে কালো রাতে পালিয়ে যাননি, কারণ বঙ্গবন্ধু জানতেন তিনি পালিয়ে গেলে বাংলাদেশের আন্দোলন পরিচিত হতো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ষড়যন্ত্র হিসেবে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দৃঢ়ভাবে পদচারণ করা বঙ্গবন্ধু জানতেন তাকে ধৈর্য্য ধরে পাকিস্তানি শোষকের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। তার এই প্রজ্ঞা ও ধৈর্য্যের কারণে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু মিত্রশক্তির সেনাসদস্যদের বাংলাদেশের যে কোনো সম্ভাবনা ও সুযোগ থামিয়ে দেন। ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে দ্রুততম সময়ে ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যায়।
এরপর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের সংগ্রামে উঠে পড়ে নামতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। পাকিস্তানের ধ্বংস করে যাওয়া দেশ, সঙ্গে পরাজিত আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রকে সামলে দেশ গঠনে এগিয়ে যান তিনি। অনেক সময়ে কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে একসময়ে শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করে, সৌহার্দ্য বজায় রাখেন।
শেখ হাসিনার বাংলাদেশ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালে নৃশংসভাবে হত্যা করে খুনিরা। পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকাসহ কিছু আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে আদর্শচ্যুত এবং মূলত একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানপন্থী সেনাবাহিনীর সদস্যরা জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাকের পরিকল্পনায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা অত্যন্ত পরিষ্কার এবং আমি মনে করি যারা জিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকার কথা বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু হত্যায় তার দায় ভুলে থাকতে চান, তারা ইতিহাসের ক্ষতি করেন।
দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন এ দেশের জন্য আরেকটি সুসংবাদ ছিল। আমরা যদি ইতিহাসের পাতায় তাকাই, তাহলে বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন, তেমনি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করেছিলেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ধারাবাহিকতায় স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হয়, খালেদা জিয়া ও জিয়ার সন্তানদের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা প্রকাশিত হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতার সর্বশীর্ষে থেকেও তার বাবার হত্যার বিচারে কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। অনেকে এটিকে তার ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল বলার মতো নিম্ন মানসিকতা দেখালেও তিনি ধৈর্য্যের সঙ্গে এসব মিথ্যা অভিযোগ ও ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছেন। অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন হয় বাংলাদেশের মাটিতে।
এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে যারা পাকিস্তানের মুখপাত্র হয়েও সরকারে গিয়েছে খালেদা জিয়ার প্রশ্রয়ে, তিনি তাদের আইনের আওতায় আনেন এবং অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত থাকে, দেশের আপাত প্রথিতযশা কিছু মানুষ বিদেশিদের এই নগ্ন হস্তক্ষেপে সমর্থন দেয় এবং দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দিয়ে শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ বাস্তবায়নে বাধা দিতে থাকে। পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশি দোসরদের ষড়যন্ত্র এমন বহু উদাহরণের একটি।
শেখ হাসিনা দৃঢ়চিত্তে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, মানবতাবিরোধীদের বিচার সম্পন্ন ও পদ্মাসেতু কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যাংকের ষড়যন্ত্রে টলে না গিয়ে তার অবস্থানে অনড় থেকেই আজকের বাংলাদেশ গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশ যে শক্তিশালী রাষ্ট্র সেটি প্রমাণ হয়েছে তার অর্থনৈতিক ও জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সাফল্যের কারণে।
অর্থনীতি, সমাজনীতি, সামরিক– কোনো পর্যায়ে শেখ হাসিনার বাংলাদেশকে রুখে দিতে না পেরে ষড়যন্ত্রকারীরা শেখ হাসিনাকে তার বাবা বঙ্গবন্ধুর মতোই হত্যার চেষ্টা করেছে বহুবার, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। শেখ হাসিনা তার ১৮ বছরের শাসনামলে প্রমাণ করেছেন যে স্বাধীনতা অর্জনের চাইতে স্বাধীনতা রক্ষা করা কোনো অংশেই সহজ কাজ নয়। কিন্তু তিনি সফল হয়েছেন।
যারা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনার বাংলাদেশ থেকে পৃথক দেখানোর চেষ্টা করে, তারা মূলত ভবিষ্যতের স্থিতিশীল বাংলাদেশকে আঘাত করতে চায়। তারা তাদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়িত করতে না পেরে, শেখ হাসিনার বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়। এরা খন্দকার মুশতাকের মতোই ভয়ংকর এবং ১৭ কোটি বাংলাদেশিকে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এরা বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ও শেখ হাসিনা বিরোধী দেখাতে চাইলেও, আদতে এরা বাংলাদেশ বিরোধী।
আজকে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীতে আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যা শেখ হাসিনাকে আলাদা করার সুযোগ নেই। মেধা, মননশীলতা ও নেতৃত্বে তারা দুজনই বাংলাদেশের অন্তরে বাস করেন, এবং করবেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বঙ্গবন্ধুই শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনাই বঙ্গবন্ধু।
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই