Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিউটি হত্যা: আমাদের অন্ধকার যাত্রা


২ এপ্রিল ২০১৮ ১৬:০০

হাওরের ধানক্ষেতের পাশে সবুজ জমিনে শুয়ে থাকা মেয়েটির নাম বিউটি। সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণীটি পৃথিবীর আলো ঠিকমতো দেখার আগেই শিকার হয়েছে পাশবিকতার। অপরিমেয় নির্যাতনের এক পর্যায়ে ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়েছে সে। সে ঘুম অনন্ত ঘুম, জাগরণের সুযোগ না থাকার ঘুম।

কাব্য-ভাষায় মৃত্যুর হিমশীতল পরশ ছোঁয়ার কথা বলা হয়। যারা ইতোমধ্যেই মৃত্যুসুধা পান করেছেন কেবল তারাই জানেন মৃত্যু কী। তবে কিছু মৃত্যুর অব্যবহিত পর আর সকলেও বুঝতে পারেন মৃত্যু ক্ষেত্রবিশেষে যন্ত্রণার। বিউটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। দীর্ঘ উত্যক্তকরণ শেষে ধর্ষণ, এরপর হত্যা। সকল পর্যায়েই কষ্টের সীমা-পরিসীমা থাকার কথা না। ধর্ষণে জোরজবরদস্তি হয়। তাই ওটা কষ্টের। এরপর যখন হত্যা করা হয় তখন দুই কষ্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ধর্ষণোম্মুখ ঘাতক দুই পর্যায়েই ঘাতক। মানবিকতা লোপপাওয়া পশুসম চরিত্র। বিউটির ধর্ষক বাবুল মিয়াও তেমনই এক চরিত্র। ঘৃণার।

বিজ্ঞাপন

আমাদের সমাজ ধর্ষকের চাইতে ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে দোষারোপ ও হেয় করতে প্রস্তুত থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসার ও মোবাইলযুগের এই সময়ে ধর্ষিতা ফের ধর্ষণের শিকার হয় অনলাইন পামরদের উদ্ধত আচরণে। ঘুরেফিরে আসে নারীর ত্রুটি সন্ধান অভিযানের নামা কতিপয় লোকের আচরণ। তারা অপ্রকাশ্য যুক্তিতে ধর্ষণকে ধর্ষকের অধিকার জ্ঞান করে, যুক্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায়। ধর্ষিতার দোষ খুঁজতে গিয়ে সন্ধান করে তার পোশাক, আচার। মরেও শান্তি হয় না, নিথর দেহ ফের অবজ্ঞা-অপমানে বিদ্ধ হয়। কোণঠাসা হয়ে পড়ে জীবন্মৃত হয়ে থাকা ধর্ষিতার পরিবার।

একেতো প্রিয়জন হারা পরিবার, তার ওপর প্রতিবেশিজনের বাঁকা চাহনি; কাঁহাতক সহ্য করা যায়। এমন চলে আসছে, চলছে। তবু কিছু পরিবার বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে সুস্থ চিন্তার মানুষজনের প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া আর গণমাধ্যমের সাহসী ভূমিকায়। তারাও বিচারের দাবি জানায়, কখনও চাপাস্বরে, কখনওবা সুউচ্চকণ্ঠে। জানে তারা বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ, সুদীর্ঘ; তবু বিচার চায়। কজন পায় সে হিসাব কেউ রাখে না। কদিন পর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে আর গণমাধ্যম যায় না বলে তারাও হয়ত বিচারের দাবি জানানোর প্ল্যাটফর্ম পায় না। তাদের দাবিগুলোও আড়ালে পড়ে যায়, যাচ্ছে; হয়ত যাবেও।

বিজ্ঞাপন

হবিগঞ্জের যে কিশোরীটি ধর্ষণের শিকার হলো, মারা গেল; তার খুনের বিচার কতখানি হবে জানি না। অনলাইনে থাকা মানুষজন এ নিয়ে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। দেরিতে হলেও স্থানীয় প্রশাসন ধর্ষক ও খুনিকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে উত্যক্ত, ধর্ষণ ও হত্যার মধ্যবর্তী সময়ে সালিশ মীমাংসা ও পুলিশের নীরব ভূমিকার আড়ালে যে সময়ক্ষেপণ হয়েছে তার বলি হয়েছে এই তরুণি। অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে।

ঘটনা সম্পর্কে তরুণীর স্বজন, স্থানীয়রা ও পুলিশ জানায়, কাজে যাওয়া-আসার পথে প্রায় প্রতিদিন বিউটিকে উত্ত্যক্ত করতো বাবুল মিয়া। এ নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে বিউটির বাবা-মা বাবুলের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে বিচার চান। এতে বাবুল আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এর জের ধরে গত ২১ জানুয়ারি বিউটিকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় বাবুল ও তার সহযোগীরা। এরপর অজ্ঞাত স্থানে একমাস আটকে রেখে বিউটিকে ধর্ষণ করে বাবুল। পরে গত ২১ ফেব্রুয়ারি কৌশলে বিউটিকে তার বাড়িতে রেখে বাবুল পালিয়ে যায়। এর প্রায় এক সপ্তাহ পর গত ১ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল ও তার মা ইউপি সদস্য কলমচানকে আসামি করে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। গত ৪ মার্চ আদালত শায়েস্তাগঞ্জ থানাকে এ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। এরপর গত ১৬ মার্চ সায়েদ আলী বিউটিকে তার নানার বাড়ি লাখাই উপজেলার গুনিপুর গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মামলার পর ওই দিন রাতেই আবার বিউটিকে তুলে নিয়ে যায় বাবুল। এরপর বিউটিকে ধর্ষণের পর খুন করে লাশ হাওরে ফেলে দেয়। ১৭ মার্চ সকালে হাওরে বিউটির লাশ পাওয়া যায়। এর পরদিন সায়েদ আলী শায়েস্তাগঞ্জ থানায় বাবুলসহ দুজনের নাম উল্লেখ এবং আরও কয়েকজনকে আসামি করে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে ফের মামলা করেন।

এখানে লক্ষণীয় যে, মামলা হয় মার্চের ১ তারিখে। আদালতও আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশনার পরেও পুলিশ কোন ভূমিকা পালন করেনি, গ্রেপ্তার করেনি ধর্ষককে। এরপর খুন হন বিউটি। মামলা ও আদালতের গ্রেপ্তারের নির্দেশনার পরেও বাবুল মিয়া গ্রেপ্তার হয়নি, উপরন্তু দ্বিতীয়বারের মত ধর্ষণ করে খুনই করেছে বিউটিকে। স্বভাবত প্রশ্ন জাগে, কেন পুলিশ প্রশাসন অভিযোগ পাওয়ার পর এমনকি আদালতের নির্দেশনার পরও অপরাধীকে ধরতে কার্যকর উদ্যোগ নিল না। অভিযোগ পাওয়ার পর পরই পুলিশ প্রশাসন যদি তৎপর হত, যদি ধর্ষক বাবুল মিয়াকে গ্রেপ্তার করত তাহলে নিশ্চিতভাবেই বিউটিকে খুন হতে হত না।

এই ঘটনায় প্রশাসন কেন বিলম্বিত পদক্ষেপে গেল, এর উত্তর কেউ চাইছে না, দিচ্ছেও না কেউ। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চাইলেই পারে, এর প্রমাণ পাওয়া গেছে আত্মগোপনে থাকা ধর্ষক ও খুনি বাবুল মিয়ার গ্রেপ্তার ঘটনায়। হবিগঞ্জ থেকে শতাধিক মাইল দূরে অন্য জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে লুকিয়েও পার পায়নি ধর্ষক। তাকে সিলেটের বিয়ানীবাজারের রামধা বাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। প্রশাসনের এত বিস্তৃত নেটওয়ার্ক অথচ বিউটির অভিযোগ পাওয়ার পর প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি, ফলে অকালে প্রাণ হারাতে হয় বিউটি নামের তরুণিটি।

ধারণা করি এই গ্রেপ্তার সম্ভব হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিউটির হত্যার ঘটনাটি ব্যাপক আলোচিত হওয়ার কারণে। ফলে প্রশ্ন জাগে ফেসবুকে আলোচিত না হলে কি বিউটির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করত না প্রশাসন। প্রশাসন কেন ফেসবুক দেখে পরে সিরিয়াস হলো। আগে থেকে তারা সক্রিয় থাকলে বিউটিকে হয়ত এভাবে প্রাণ হারাতে হত না!

বিউটিকে উত্যক্ত, ধর্ষণ ও মামলার পর পরই এনিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কোথাও আলোচনা ছিল না। আলোচনা শুরু হয় খুন হয়ে যাওয়ার পর। সবুজ জমিনে লাল কাপড় পরিহিতা বিউটির মরদেহকে অনেকেই এক টুকরো বাংলাদেশ বলছিল। হাওরে পড়ে থাকা মরদেহ দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় ওঠেছিল বলেই হয়ত প্রশাসন খুনিদের গ্রেপ্তারে উদ্যোগী হয়েছে। কিন্তু দেশের মধ্যে এমন অন্যায়-অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হওয়া অগণন বিউটি আলোচনায় আসছে না বলে হয়ত এভাবে বা অন্য কোনোভাবে অকালে চলে যেতে হচ্ছে। মরে যাওয়ার পরেও হয়ত অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যন্ত না পৌঁছার কারণে তাদের খুনিদের গ্রেপ্তারেও উদ্যোগী হচ্ছে না প্রশাসন। এ আমাদের আশঙ্কা, এর সত্যতা থাকাটা বিচিত্র কিছু নয়!

উত্যক্তকরণ, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা শেষে র‍্যাব যখন বিউটির খুনিকে গ্রেপ্তার করে তখন ভিকটিমের পরিবারের পক্ষ থেকে আইনি আশ্রয় চাওয়ার সময়টা এক মাসের মতো হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ওই পরিবার হারিয়ে ফেলেছে তাদের সন্তানকে। গরিব এক দিনমজুর যখন এত দেরিতে তার চাওয়াটা পূরণ হতে দেখেন তখন দেখেন যাকে আশ্রয় করে বিচার চাওয়াটা সেই মেয়েটিই আর নেই পৃথিবীতে। তবে কী লাভ হল তার? বিচার চাইতে গিয়ে হারালেন নিজের মেয়েকেও- এরচেয়ে করুণ পরিণতি আর কী হতে পারে! এখন ওই পরিবার যদি বিচার চাওয়াটাকেই নিজেদের ‘অপরাধ’ ভেবে বসে- তখন কী জবাব দেবে সমাজ-রাষ্ট্র?

বিচার চেয়ে উলটো চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার এমন নজির চলমান আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থাহীন করবে। বিচার চাইলেই বিচার পাওয়া যাবে না, উলটো খুন হয়ে যেতে হতে পারে, এমন বিশ্বাসটা সমাজে প্রবল হতে থাকলে আমরা অন্ধকারের দিকেই ধাবিত হব। বিউটির ধর্ষণ, বিপরিতে আইনের আশ্রয় চেয়েও আশ্রয় না পাওয়া, হত্যা- আমাদের অন্ধকারকেই নির্দেশ করে। আমরা অন্ধকারে যেতে চাই না, তবু যাচ্ছি; যাচ্ছিই, ক্রমশই!

লেখক : কবির য়াহমদ, সাংবাদিক

সারাবাংলা/ এসবি

 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর