Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অভিবাসন; দাসপ্রথার আধুনিক রূপ

মুছা কালিমুল্লাহ
২৩ আগস্ট ২০২১ ১৭:২৪

দাস প্রথা- একটি অতি প্রাচীন এবং ঘৃণ্য প্রথা। সাধারণত বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য ক্ষেত্রে কেনাবেচার রীতি পরিলক্ষিত হয় এবং মালিক সেটাকে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারে অথবা ছুঁড়ে ফেলতে পারে। দাসপ্রথায় মানুষকে পণ্যদ্রব্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পণ্য কিংবা দ্রব্যের মতো তাদেরকেও অর্থের বিনিময় কেনাবেচা করা যেতো এমনকি কেনাবেচা করার জন্য নির্দিষ্ট হাট-বাজার ছিল। মানুষ হিসেবে দাসদের কোন মর্যাদা দেয়া হতো না। তাদের ছিলো না কোনো সামাজিক মর্যাদা। এই ঘৃণ্য প্রথায় তাদেরকে মালিকের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মালিক তাদের সাথে খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করত।
একটা পণ্য যেমন নিজের খেয়াল-খুশি মতো ব্যবহার করা যায় তার সাথে ও ঠিক একই ধরনের ব্যবহার করত অথবা ভালো না লাগলে ছুঁড়ে ফেলত। দাসদের নিজের স্বাধীন ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, কোন চাহিদা থাকতে পারতো না এমনকি মালিকের অনুমতি ব্যতীত ছাড়া দাস-দাসীরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারত না। এই দাসপ্রথার সূচনা হয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সভ্যতা গ্রীকদের হাত ধরে। যা যুগে যুগে ছড়িয়েছে প্রাচীন রোম সহ এ বিশ্বে অন্যান্য সকল সভ্যতায় এমনকি ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই ধরনের প্রথা চালু ছিল যদিও সেটি পরবর্তীতে বিলোপ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

দাসদের সাথে অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন প্রতিবাদ পরিকল্পনা হাতে নেয়া হলেও ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর দাসত্ব থেকে মুক্তির আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে।

দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত হয়ে দাসরা তাদের মানবিক অধিকার ফিরে পেতে ১৭৯১-১৮০৩ পর্যন্ত হাইতিতে বিদ্রোহ করে। ১৭৯১ সালের ২২ আগস্ট এবং ২৩ আগস্ট দাসদের আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং দাসকর্তৃক ১ হাজার ফরাসি প্রভু হত্যা করা হয়। মূহুর্তেই দাসদের এ আন্দোলন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর ধারাবাহিকভাবে ১৮০৭ সালে বৃটেনে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করা হয়, রাশিয়ায় হয় ১৮৬১ সালে, আর চার বছর পর রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রেও দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল ।

১৯৯৮ সালে প্রথমবার হাইতিতে আজকের এই দাস বাণিজ্য স্মরণ এবং রদ দিবস পালন করা হয়। পরের বছর সেনেগালে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎযাপন করা হয়। যার চুড়ান্ত ফলাফলস্বরূপ জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো ২৩শে অগাস্টকে আন্তর্জাতিকভাবে দাস বাণিজ্য স্মরণ ও রদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

এই গেল দাসপ্রথার ইতিহাস বিশ্লেষণ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে নতুন আঙ্গিকে দাস বাণিজ্যের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের দাবি রাখে। পরিতাপের বিষয় বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বের তথাকথিত উদারনীতি, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিশেষ প্রবণতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অরাজকতা এই একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বকে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে আধুনিক দাসত্ববাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর এই সম্পূর্ণ ভিন্ন দাসত্ব প্রথার প্রধান অবকাঠামো তথাকথিত পশ্চিমা উদারনীতি এবং অসম অর্থনীতি ব্যবস্থা। এই নতুন রূপ হচ্ছে শ্রমবাজার ও দাসের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার দাসপ্রথা। নব্য দাসরা যেমন বাজারের ওপর নির্ভরশীল। আবার বাজারও দাসদের ওপর নির্ভরশীল। সুবিধাবঞ্চিত নিম্ন আয়ের শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে নয়া উদারবাদ কাঠামোয় আধুনিক দাসে পরিণত হয়েছে। আর এই আধুনিক দাসত্বের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে সুদূর উন্নত আধুনিক যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া বা ইরাক, ঝুঁকিপূর্ণ পাকিস্তান বা জলবায়ুজনিত ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশে।

বিজ্ঞাপন

সমাজের নিম্নশ্রেণীর আয়ের মানুষের যোগাযোগ সীমিত হওয়ার কারণে স্বল্প আয়ের বিনিময়েই শ্রমদান করতে বাধ্য হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতি হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। বরং নয়া উদারবাদ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধারণার ফল এই নয়া দাসত্ববাদ, যা এখন বিশ্ববাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। উদার অর্থনীতির নামে অবাধ ও মুক্ত বাজার, পাইকারি হারে বেসরকারিকরণ, অসমানুপাতিক সম্পদের মালিকানা ও বৈষম্য সমাজে দিন দিন বাড়ছেই।

বর্তমান সমগ্র ইউরোপ বিশাল এক শ্রমদাসের রাজত্বে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার সময় বেকারত্বের বৃদ্ধি ঘটলেও ইউরোপের অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য সামগ্রিকভাবে অনেক শ্রমিক এর ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা থেকে লক্ষ লক্ষ অভিবাসন প্রত্যাশী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে সামান্য একটু মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজতে ব্যস্ত আর ইউরোপের আগ্রাসী শ্রম ইউনিয়নগুলো তাদেরকে তথাকথিত উদারনীতির কথা বলে আধুনিক দাসে পরিণত করছে। ব্যাপারটা যেন ‘রথ দেখা কলা বেচার’ মতো অবস্থা। একদিকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের বাহবাপ্রাপ্তি অন্যদিকে অতি নগন্য মূল্যে এই সমস্ত এশীয় এবং আফ্রো অভিবাসন প্রত্যাশীদের নামমাত্র মূল্যে আধুনিক শ্রমদাসে রূপান্তর। একদিকে নয়া উদারবাদ নতুন নতুন অভিবাসী তৈরি করছে, এই অভিবাসীরাই আবার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে নয়া সস্তা দাস হিসেবে প্রবেশ করছে।

একই চিত্র আমাদের জাতীয় পর্যায়েও। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানাবিধ কারণে কর্মসংস্থান হারিয়ে দেশের শিল্পোন্নত এলাকাগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। ফলত শ্রমিকের প্রয়োজনের তুলনায় শ্রমিকের যোগান বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্প মালিকরা নামমাত্র মূল্যে তাদেরকে শ্রমদাসে রূপান্তরিত করেছে।

ইউরোপে প্রতিবছর হাজার হাজার অভিবাসী পাড়ি জমাচ্ছে। স্থলপথ, জলপথ ও আকাশপথ যে যেভাবে পারছে ইউরোপে ঢুকছে। ২০১৫ সালেই ১০ লাখের বেশি অভিবাসী ইউরোপে পাড়ি জমায়। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তপথগুলোয় কড়া নজরদারির কারণে কমে এলেও ইউরোপামুখী অভিবাসীঢল থেমে নেই। আর সাম্প্রতিক সময়ে এই অভিবাসীদের তালিকায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন জানায়, চলতি বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ৮২৩ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে এপ্রিলে তিউনিসিয়ার উপকূলে এক নৌকাডুবিতে ৪০ জনের বেশি মানুষ ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা যান। আর মার্চে মারা যান ৩৯ জন।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানায়, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। এভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এ সময়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন। গত এক দশকে এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় আটক হয়েছেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি। মানবপাচারের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট এটি। সংস্থাটি আরও জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যে সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন তিউনিশিয়ার অধিবাসীরা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাবমতে, সারা বিশ্বে ২৭ মিলিয়ন মানুষ নানাভাবে দাসত্বের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশেই রয়েছে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন আধুনিক দাস। দাসপ্রথা বিলোপের জন্য প্রায় ২৫০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র লড়াই করেছিল। সরকারি হিসাবমতে, প্রতিবছর ১৪ থেকে ১৭ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকছে এবং দাসত্বের শিকার হচ্ছে।

উনবিংশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দিতে এসে শ্রমের মজুরী কমে গিয়েছে। যার মধ্যে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক কাঠামো শ্রমিকদেরকে আধুনিক দাস রূপে গড়ে তোলার পাঁয়তারা হাতে নিয়েছে। অনতিবিলম্বে যদি এই তথাকথিত পশ্চিমা উদার নীতির দিকে না ঝুঁকে সমগ্র জনগোষ্ঠীর নাগরিক মান উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ না করা হয় তাহলে এটা খুব দূরে নয় যে খুব দ্রুতই আবারও এক বিশাল আধুনিক দাসত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছে একবিংশ শতাব্দী এই ধরণী।

সুতরাং আজ এই দাস বাণিজ্য স্মরণ এবং রদ দিবসের প্রকৃত উদ্দেশ্য হোক তথাকথিত জিডিপি, মাথাপিছু আয় না বাড়িয়ে নাগরিকদের জীবন মানের প্রকৃত উন্নয়ন এর দিকে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বকে দাস বানিজ্যের মত কলঙ্কজনক অধ্যায় ফিরে যাওয়া থেকে রক্ষা করা।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

অভিবাসন; দাসপ্রথার আধুনিক রূপ মুছা কালিমুল্লাহ