Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’

আর এ শাহরিয়ার
৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১২:৩৩

বলা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ হয়নি। এটি নিছকই মিথ্যা, তবে বলতে দ্বিধা নেই প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ যেমন তীব্র হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। সেই সঙ্গে এটিও বলতে হবে তখন প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ হয়নি, কারণ সে সময়ের কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যর্থতা। সেখানে যথাযথ প্রতিবাদ না হওয়ার উপযুক্ত যুক্তি সর্বজনগ্রাহ্য নয়।

সে সময় মালয়েশিয়াতে মারদকো ক্লাবে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল টিম খেলতে গিয়েছিল। ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার ঘটনা খেলোয়াড়রা জানতে পারেন। ঘটনাটি ছিলো তাদের জন্য খুবই আকস্মিক, খেলোয়াড়রা কিংর্কতব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। খেলোয়াড়েরা সবাই তখন সিদ্ধান্ত নেন, মারদেকা কাপে অংশ নিবেন না। কিন্তু মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ তাদের জানায়, তারা যদি খেলায় অংশ না নেয়, তবে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে বাংলাদেশ ছিটকে পড়বে। ফিফা কোনক্রমেই বাংলাদেশকে আর আন্তর্জাতিক টুনামেন্টে খেলতে দেবে না। তখন সিনিয়র খেলোয়াড়রা দেশের কথা ভেবে খেলায় সম্মতি দেয়। তবে শর্ত থাকে খেলা শুরুর পূর্বে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হবার ঘটনায়, স্টেডিয়ামে শোক প্রস্তাব রেখে এক মিনিট নীরবতা পালন করতে হবে এবং পুরো খেলার সময় বাংলাদেশের পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। মালয়েশিয়ার আয়োজকরা কথা রেখেছিলেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একেই প্রথম প্রতিবাদ বলা যায়।

বিজ্ঞাপন

এরপর সিপিবি’র উদ্যোগে ন্যাপ ও গ্রেফতার এড়ানো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে গোপন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সংগঠিতভাবে মুজিবহত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। সে মতে ডাকসু ও ছাত্রসংগঠনগুলোর উদ্যোগে ২৯ অক্টোবর প্রকাশ্যে জাতীয় শোক দিবস (মতান্তরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি দিবস) পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। পরে প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ থাকায় তারিখ পুনঃনির্ধারিত হয় ৪ নভেম্বর। কর্মসূচির প্রচারের অংশ হিসেবে দু’টি প্রচারপত্র (লিফলেট) প্রকাশ করা হয়। এর একটিতে ছিল ব্যাখ্যাসহ বাকশাল-কর্মসূচি ও মুজিবহত্যার বর্ণনা এবং অপরটিতে ৪ নভেম্বরের কর্মসূচি অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা থেকে মুজিবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি পর্যন্ত মৌনমিছিল সফল করার আহ্বান।

বিজ্ঞাপন

প্রচারপত্র প্রকাশ করা ছিল তখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এবং তা বিলি করতে গিয়েও বেশ ক’জন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ৪ নভেম্বরের কর্মসূচিসহ তৎকালীন আন্দোলনে সবচেয়ে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন ডাকসু ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহবুব জামান ও ছাত্রলীগ নেতা ইসমত কাদির গামা।

পূর্বনিধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ৪ নভেম্বর সকালে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমাগত হয়। কিছু আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি, শ্রমিক ও নারী নেতাকর্মীরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। সকাল ১০টার কিছু পর বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে দুই সারিতে মিছিলকারীরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের উদ্দেশ্যে রওনা হন। নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সামনে মিছিল আটকে দেওয়া হয়। শুরু হয় পুলিশের বাকবিতণ্ডা। একজন পুলিশ অফিসার তার অয়ারলেস-ফোনে অপরপ্রান্তের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘গুলি চালানো সম্ভব নয়, শত শত ছাত্র মিছিলে যোগ দিয়েছে।’ প্রায় ২০/২৫ মিনিট পর ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা স্লোগান না-দেওয়ার শর্তে রাস্তা ছেড়ে দেন।

মিছিল যতই এগোয়, ততই রাস্তার দুপাশ থেকে মানুষ শামিল হয়। কলাবাগান পৌঁছানোর পর ‘শত শথ ছাত্রের মিছিল হাজার হাজার শোকার্ত বাঙালির করুণ সারিতে পরিণত হয়। কলাবাগান থেকেই খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই মিছিলে যোগ দেন। সামরিক পাহরা পেরিয়ে শেষপর্যন্ত মিছিল গন্তব্যে পৌঁছায়।

শোক প্রকাশনার্থে মৌনমিছিল হলেও এটাই মুজিবহত্যার প্রথম সংগঠিত ‘জাতীয় প্রতিবাদ।’ ১৫ আগস্ট ঢাকায় জাতীয়ভাবে মুজিব হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি। তবে তরুণ-ছাত্রকর্মীরা সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রতিবাদ জানাতে সচেষ্ট হয়। ২৪/২৫ আগস্ট কিছু ছাত্র-নেতাকর্মীরা মধুর ক্যান্টিনে জমায়েত হয়। ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান জমায়েত একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন এবং পুলিশ-মিলিটারি টের পাওয়ার আগেই একটি ঝটিকা প্রতিবাদ মিছিলও সংঘটিত হয়। এটা ঢাকায় প্রথম এবং বাংলাদেশে তৃতীয় প্রতিবাদ। এরপর ২০ ও ২১ অক্টোবর মধুর ক্যান্টিনসহ ক্যাম্পাসে সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এসময় অল্পকিছু ‘দেয়াল-লিখন’ও চোখে পড়ে।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ভোরে ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সংবাদ পাওয়ামাত্র সংসদের সদস্যরা অতি সাধারণ পোশাকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। পরে এমপিদের উঠিয়ে নেওয়া নিরাপত্তা ও পুলিশ পুনর্বহাল করা হয় এবং কেটে দেওয়া ফোনেরও পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়। ফলে পরিস্থিতি অনুকূল বিবেচনা করে এমপিরা ঢাকায় ফিরতে শুরু করেন।

মোশতাক তার ক্ষমতা দখলকে জাতীয় সংসদ কর্তৃক বৈধতাদানের অভিপ্রায়ে অধিবেশনে আহ্বানের পরিকল্পনা করেন। সেজন্য মনোভাব বোঝা এবং প্রয়োজনবোধে তাদের হাত করার জন্য ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ বঙ্গভবনে এমপিদের একটি সভা আহ্বান করা হয়। কিন্তু নগণ্যসংখ্যক এমপি সেখানে উপস্থিত হওয়ায় সভার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। তাই হুইপ আবদুর রউফের নেতৃত্বে লোক পাঠিয়ে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে ফের বঙ্গভবনে সভা আহ্বান করা হয়।

বঙ্গভবনে ডাকা সভাকে উপলক্ষ করে নিজেদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ পান এমপিরা। গাজীপুরের কালিগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সাংসদ অ্যাডভোকেট ময়েজুদ্দিনের (পরে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হন) উদ্যোগে মুজিব-সমর্থক সাংসদরা গোপনে সংগঠিত হতে শুরু করেন।

অন্যদিকে, ডাকসু, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কিছু তরুণ নেতাকর্মী সাংসদদের বঙ্গভবনের সভায় যোগদান থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সাজেদা চৌধুরী, ডা. আবদুল মালেক, নূরুল কাদের, লুৎফর রহমানসহ ১০/১২ জন ছাড়া প্রায় সব সাংসদই সে সভায় যোগদান করেন। তবে বঙ্গভবনের সাংসদ সভায় মোশতাক কাঙ্ক্ষিত সমর্থন পাননি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী-বাকশালীরা প্রতিবাদে এগিয়ে না-আসার কারণ হিসেবে মুজিবহত্যা মামলার রায়ে বর্ণিত ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’র উল্লেখ করা হয়। বলা হয়: ‘অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পূর্বে ও পরে তার অনুসারীগনের ব্যবহারে অনেক পার্থক্য। ইহা কিছুটা বোধগম্য আমাদের দেশের নেতাভিত্তিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে; যেমন নেতা আছে তো সব আছে, নেতা নাই তো কেউ নাই।’

‘বন্দুকের নলের মুখে’ মোশতাক-চক্রের সঙ্গে যোগদানে বাধ্য হওয়ার কথা পরবর্তীকালে যারা বলেছেন, তাদের উদ্দেশে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, উপযুক্ত নেতাদের কেউ কেউ জীবন দিয়ে, কেউ কেউ জীবন-বলিদানে প্রস্তুত হয়ে, অশেষ নিগ্রহ সহ্য করে, সেকালে যথার্থ ‘মুজিব সেনা’র পরিচয় দিয়েছেন।

লেখক: আইনজীবী ও খণ্ডকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।

সারাবাংলা/এসবিডিই

আর এ শাহরিয়ার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর