বারবার কেন বাউল নিপীড়ন?
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৪:১০
গান গাওয়ার স্বাধীনতা সবার আছে। পছন্দের পোশাক-আশাক পরে ইচ্ছে মতো গান গাওয়া ও চুল রাখা তো কোন অপরাধ নয়। যে বিষয়টি সমাজের জন্য ক্ষতি বয়ে আনে সেক্ষেত্রে বাধা আসতে পারে, কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি নিষিদ্ধ থাকে। সমাজে যা স্বীকৃত তা অপরাধ হতে যাবে কেন? তবে বারবার কেন বাউল গায়করা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন? এ প্রশ্নের জবাব যদি কেউ দেয় তবে আছে, নইলে নেই।
ইউনেস্কো ২০০৫ সালে বাউল সঙ্গীতকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর উদ্যোগ ও সহযোগিতায় বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাউল গানের বিশাল ভাণ্ডার থেকে প্রায় পাঁচশ’ গান সংগ্রহ করে সংকলিত করা হয়েছে। যেখানে শতাধিক গানের ইংরেজি অনুবাদ ও দেড়শ’ গানের স্মরলিপি যুক্ত করা হয়েছে।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্যও এক বিরাট গর্বের এতে কোন সন্দেহ নেই। এর বিপরীতে বাংলাদেশে সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসহ গোটা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে থামিয়ে দেওয়ার সুগভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা হয়ত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পুরোপুরি জানে না। অনেকে মনে করেন, বাউল নির্যাতন বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা। আসলে তা নয়। এটা হতে পারে না। সমাজে মৌলবাদী চিন্তার বিস্তার ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই বাউল নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনকে হুমকি-ধমকি দিয়ে সহজেই থামিয়ে দেয়া যায়। বাউলরা স্বভাবগতভাবেই স্বাধীন। তাই সাধারণ হুমকি-ধমকি বাউলরা পরোয়া করেন না। এক পর্যায়ে তাদের ওপর নানা অপবাদ দেওয়াসহ নির্যাতন শুরু করে মৌলবাদী চিন্তার মানুষগুলো।
লোক সংগীতকে বাদ দিয়ে কি এ অঞ্চলের সংস্কৃতি পরিপূর্ণ হবে? এক কথায় ‘না’। তবে বাউল নিপীড়নের জন্য সকল স্থানে ওঁৎ পেতে বসে থাকা কায়েমী স্বার্থবাদী এক শ্রেণীর মৌলবাদীদের বিপক্ষে সরকার কেন কঠোর হয় না। উল্টো মৌলবাদী চক্র বাউল সাধকদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার অভিযোগ তোলে। সেই সঙ্গে রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সব মিলিয়ে সময় এখন বাউলদের পক্ষে নয়। দেশের কোথাও কিছু ধর্মান্ধগোষ্ঠীর মানুষ কোন বাউলের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ আনা মাত্রই সরকার তাকে গ্রেফতার করে। এটা বিশ্বাস করে না ঘটনাটি একেবারেই পরিকল্পিত হতে পারে। এ কথা পরিষ্কার অপরাধীদের বিষয়ে মৌন সমর্থনের কারণে আজ দেশের আনাচে-কানাচে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একটি দেশ সংস্কৃতি চর্চার দিক থেকে অন্ধকারে যেতে থাকা মানেই সে দেশে মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে।
যারা বাউল গান করেন বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রতি ধর্মান্ধগোষ্ঠী চরম অসন্তুষ্ট। এদেশে এসব হোক তারা তা চায় না। নিশ্চয়ই সবার মনে থাকার কথা, ২০২০ সালের মে মাসে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের অন্যতম শিষ্য বাউল রণেশ ঠাকুরের গানের ঘর আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এতে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রসহ বই খাতাপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কতটুকু হিংসা মনে পোষণ করলে এ রকম জঘন্য কাজটি করা সম্ভব!
গত সপ্তাহে বগুড়ার শিবগঞ্জে এক কিশোর বাউল শিল্পীকে মারধর করে মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনা নতুন করে সামনে এসেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত তিন অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, জুড়ি মাঝপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ১৬ বছর বয়সী ওই কিশোর স্থানীয় একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। একসময় বাউল মতিনের সঙ্গে ওই কিশোরের পরিচয় হয়। এরপর থেকে ছেলেটি মতিন বাউলের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাউল গান গেয়ে সংসার চালাচ্ছিল। বাউল শিল্পী হওয়ায় ছেলেটি সাদা লুঙ্গি, সাদা ফতুয়া ও সাদা গামছা ব্যবহার করত। সে মাথার চুলও লম্বা রেখেছিল। এ নিয়ে গ্রামের তিন মাতবর ছেলেটির পোশাক এবং চুল নিয়ে বিভিন্ন সময় অশালীন মন্তব্য ও কটাক্ষ করত। এক পর্যায়ে ওই বাউল কিশোর এর প্রতিবাদ করে। এর জেরে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ওই তিন মাতবর ছেলেটির বাড়িতে যায়। তারা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জোর করে চুল কেটে মাথা ন্যাড়া করে দেয়। বাধা দিতে গেলে তাকে মারধরও করা হয়। মাতবররা ওই সময় তাকে বাউল গান ছেড়ে দিতে বলে এবং মাথার চুল আবার বড় করলে কিশোর মেহেদীকে গ্রাম ছাড়া করার হুমকিও দেয়। এ ঘটনার পর থেকে ছেলেটি লজ্জা ও ভয়ে কয়েকদিন বাড়ির বাইরে যায়নি।
প্রশ্ন হলো ছেলেটির অপরাধ কী? জীবিকার প্রয়োজনে গান করে সংসার চালাচ্ছিল সে। ছোট্ট এই শিশুর মহৎ কাজটিও ধর্মান্ধগোষ্ঠীর গায়ে সহ্য হলো না। তাকে হুমকি ধমকি দিয়ে কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত শারীরিক আঘাত করে তারা ক্ষান্ত হয়েছে। এটা কি ধরনের বর্বরতা!
২০১১ সালের ৪ এপ্রিল রাজবাড়ীর পাংশায় ২৮ বাউলের চুল দাড়ি কাঁচি-দা দিয়ে কেটে ফেলার ঘটনা দেশে বেশ আলোচিত ছিল। ঘটনার দিন মোহাম্মদ ফকিরের বাড়িতে অতিথি হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আমন্ত্রিত বাউলরা এসেছিলেন। এলাকার প্রভাবশালী লোকজন এই বাউলদের জোর করে ধরে নিয়ে যায় মসজিদে, বলা হয় বাউলরা ধর্মচ্যুত হয়ে গেছেন। তাই জোর করে তাদের তওবা পড়ানো হয়। তাদের লম্বা লম্বা চুল দাড়ি জোর করে দা দিয়ে, কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়া হয়। লজ্জায়, অপমানে ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ ফকির বাকরুদ্ধ পর্যন্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখন স্থানীয় এমপি জিল্লুর হাকিমের ভাষ্য ছিল, ‘বাউল নির্যাতনের বিষয়টা একটা তুচ্ছ ঘটনা।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল আলম ছিলেন লালন ভক্ত একজন চিন্তাশীল ব্যক্তি। ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে বাসায় ফেরার পথে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। তিনি বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে লালনের গান সংগ্রহ করতেন, আখড়ায় বাউল শিল্পীদের সাথে কথা বলতেন, নিমগ্ন থাকতেন লালন সাধনায়। তার বিরুদ্ধেও নাস্তিকতার অভিযোগ তোলা হয়।
সব মিলিয়ে যদি বলা হয়, মিথ্যাচারই হলো বাউল নিপীড়কদের প্রধান অস্ত্র। মিথ্যাচারের এই অস্ত্রটি তারা ব্যবহার করে সর্বত্র। যেমন করেছে নেত্রকোনার কেন্দুয়ায়। এই উপজেলার বাসিন্দা আবদুল হালিমের বাড়িতে লালন ভক্তদের নিয়মিত আসর বসতো, যেখানে লালন গানের বাইরে নানা বিষয়ে আলোচনা হতো। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে আয়োজিত সেই আসরের বার্ষিক অনুষ্ঠানটি পুলিশ বন্ধ করে দেয়। ‘হেফাজতে ঈমান’ নামের একটি সংগঠন লিফলেট বিলিয়ে অপপ্রচার চালায়। ইউএনও’র কাছে অভিযোগ করে ‘বাউলরা অনৈসলামিক কাজ করে’।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মির্জাপুরে শরিয়ত বয়াতিকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের বক্তব্য ছিল, অনুষ্ঠানে গানের আগে দেয়া বক্তব্যে শরিয়ত সরকার নামের এই বয়াতী ইসলামের নবী এবং ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করেছেন- এমন অভিযোগে এলাকায় বিক্ষোভ হয় এবং স্থানীয় এক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার জের ধরেই সরকারকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়। ২০১৪ সালে যশোরে বাউল আসরে বোমা হামলা চালানো হয় ও কুপিয়ে এক বাউল শিল্পীকে হত্যার ঘটনাও বেশ আলোচিত।
দেশের আনাচে কানাচে খবর নিলে দেখা যাবে বাউল নির্যাতনের অনেক ঘটনাই হয়ত সামনে আসে না। স্থানীয়ভাবে অনেক সমস্যার সমাধান হলেও বিচার বাউলদের পক্ষে না আসা স্বাভাবিক। কারণ বাউলরা আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে দুর্বল। এই সুযোগে এক শ্রেণীর ক্ষমতাবান, ধর্মান্ধ লোকজন কৌশলে এসব অপকর্ম করছেন। কিন্তু রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে নিজ নিজ ধর্ম পালন করার বা মতাদর্শ অনুযায়ী চলার স্বাধীনতা দিয়েছে। এই স্বাধীনতায় যারা হস্তক্ষেপ করে তাদের আশ্রয় প্রশ্রয় না দিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে- এটাই স্বাভাবিক।
একের পর এক বাউল নির্যাতনের ঘটনা সাধারণ কোনো অপরাধ নয়। সামগ্রিকভাবে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবিক সংস্কৃতির উপর এক বিরাট আঘাত। সমাজে যখন অমানবিকতার দাপট চলছে এমন সময়ে বাউলদের বাদ দিয়ে চলার কোন সুযোগ নেই। কারণ তাদের দর্শনে আছে শান্তি আর সম্প্রীতি, মানবিকতাসহ অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা। তারাই সমাজের মানবিকতাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আরো জাগিয়ে তুলতে পারেন। তাই আক্রান্ত বাউলের পাশে দাঁড়ানো সমাজের সচেতন অংশের নৈতিক দায়িত্ব যেমন রয়েছে তেমনি রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্রকে কোন অবস্থাতেই ধর্মান্ধগোষ্ঠীর পক্ষে অবস্থান নেয়া ঠিক হবে না।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই