উৎসবে সম্প্রীতির বাংলাদেশে
১৫ অক্টোবর ২০২১ ১৪:৪৭
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়ে মা দুর্গার মর্ত্যে আবির্ভাব। বছরে দুবার দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শরতে শারদীয় দুর্গাপূজা আর বসন্তে হয় বাসন্তী পূজা। মেধামুনির আশ্রমে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য কর্তৃক প্রথম প্রতিমার পূজাই বাসন্তী পূজা। আর শ্রী রামচন্দ্র রাবন বধ করে সীতা উদ্ধারের জন্য দক্ষিণায়নে শরৎকালে একশত আটটি নীলপদ্মে পূজিত হন দেবী। রামচন্দ্র দেবতাদের শয়নকালে দেবীকে নিদ্রা থেকে জাগ্রত করে পূজা করেছিলেন বলে এটি অকালবোধন নামে পরিচিত। শরৎকালে রামচন্দ্রের এই পূজাই আমাদের শারদ উৎসবের স্বীকৃতি পায়।
দুর্গা প্রতিমার কল্পনা কতদিনের তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্নভাবে মায়ের প্রতিমা কল্পনা করে শক্তি পূজার প্রচলন ছিল এদেশে। সিন্ধু উপত্যকায় আবিষ্কৃত প্রাকঐতিহাসিক যুগের অসংখ্য পোড়ামাটির স্ত্রী মূর্তিগুলো মাতৃমূর্তির অতীতকালের নিদর্শন।
বাঙালি হিন্দুদের মাঝে কবে এই পূজার প্রচলন তার তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় যে, মোঘল সম্রাট আকবরের সুবেদার রাজা কংস নারায়ণ রায় বাংলার দেওয়ান ছিলেন। তিনি পন্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শে মহাযজ্ঞ না করে দুর্গাপূজা করেছিলেন। ব্যক্তিগত পূজায় যখন সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়ে তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে সার্বজনীন পূজা আয়োজনের। ১৭৯০ সালে হুগলী জেলায় ১২ জন বন্ধুর প্রচেষ্টায় প্রথম বারোয়ারি পূজার আয়োজন। তারপর থেকেই এই পূজা পরিণত হয় সার্বজনীন উৎসবে।
কালের পরিক্রমায় আবহমান বাংলায় সকল ধর্মের মানুষ সমঅধিকার নিয়ে এই বাংলায় বাস করায় শারদীয় দুর্গোৎসব শুধু হিন্দুদের একার উৎসবে নয়, পরিণত হয় সার্বজনীন উৎসবে। সকল ধর্মের এমন নিরাপদ আবাসভূমি পৃথিবীর আর কোথায় আছে? প্রতিটি পূজা মন্ডপে দর্শনার্থীদের যে ভীড়, কে যে কোন্ ধর্মের আর কেইবা কোন্ বর্ণের তা বোঝাই কষ্টকর। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেনো মিলেমিশে একাকার এই শারদীয় উৎসবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’।
বৈশ্বিক মহামারী করোনা কেড়ে নিয়েছে আমাদের সকল উৎসব। বাঙালির জীবনে গত দু’বছর ছিলনা বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখের বর্ণাঢ্য আয়োজন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ছিলনা না কোনো প্রাণের ছোঁয়া। শারদীয় দুর্গাপূজায় গত বছর ছিল শুধুই পূজার আনুষ্ঠানিকতা। নিজের জীবন, পরিবারের সদস্যদের জীবন, সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাত্ত্বিক পূজায় সীমাবদ্ধ রেখে গত বছর শেষ হয় শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। মহান স্রষ্টার অশেষ কৃপায় করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমায় অনেকটা আগের অবস্থায় ফিরেছে উৎসবের আমেজ। এবার বর্ণিল অলোকসজ্জার ঝলকানি পূজা মন্ডপের চারদিকে। করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছর পূজার মন্ডপের সংখ্যা কমলেও বেড়েছে এবার। যা ২০১৯ সালের চেয়েও বেশি। ঐ বছর সারাদেশে পূজা মণ্ডপের সংখ্যা ছিলো ৩১ হাজার ৩৯৮টি। ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ৩০ হাজার ২২৩টিতে। এবার সারা দেশে পুজা মণ্ডপের সংখ্যা ৩২ হাজার ১১৮ টি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণীতে হিন্দু সম্প্রদায়সহ দেশের সকল নাগরিককে শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। কামনা করেছেন দেশ ও জাতির সমৃদ্ধির।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখনো কোনো ভেদাভেদ মানেনি। সব মানুষ- হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নারী-পুরুষ, বাঙালি-ক্ষুদ্রজাতি সকলেই এই লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন। ভেদাভেদহীনভাবেই সব ধর্মের মানুষ প্রতিরোধযুদ্ধ করেছেন, শহীদ হয়েছেন, সহায়সম্পদ হারিয়েছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেদিন হিন্দু-মুসলিমে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। নির্বিচারে তারা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ-অত্যাচার চালিয়েছিল; কিন্তু এ দেশের মানুষ সেই বিভেদ মানেনি। তারা একাট্টা হয়েই প্রতিরোধ-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে উচ্চারিত হয়েছে সম্প্রীতির গান- ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ/বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান/আমরা সবাই বাঙালি।’ অন্য একটি গানে শুনতে পাই- ‘আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের।’ এখানে কারও মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই; কিন্তু মাঝে মাঝেই রাজনৈতিক হীনউদ্দেশ্যে সম্প্রীতির এই বাতাবরণ বিনষ্ট করার চেষ্টা চালায় দুষ্টচক্র।
ইংরেজ আমল থেকেই তা আমরা দেখে আসছি, পাকিস্তান আমলেও দেখেছি। সম্প্রতি আবারও তারা মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। কুমিল্লার ঘটনা ঢাকা পড়ার আগেই চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর তিনটি এলাকায়, কক্সবাজারের পেকুয়া, হবিগঞ্জ, ভোলা, বান্দরবান জেলার লামাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় দুর্গাপূজার প্রাক্কালে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজামণ্ডপ ও লোকালয়ে হামলা হয়েছে। এটা দুঃখজনক, এটা দুর্ভাগ্যের বিষয়। অবশ্য বর্তমান সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেশে সম্প্রীতির বাতাবরণ বজায় রাখতে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ অনেক পূজামণ্ডপে গিয়ে জোরালো ভাষায় একই বার্তা দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর রয়েছে।
আমরা জানি একটি মহল দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টায় রয়েছে। জঙ্গিবাদী ও ইসলামি মৌলবাদীদের একটি অংশ তো এ ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেই; কিন্তু অনেকেরই ধারণা প্রধান বিরোধী দলেরও কোনো কোনো নেতার এতে ভূমিকা থাকতে পারে। আমরা এর সত্যতা জানি না, তবে বলব- সর্বত্র নিরাপত্তা ও শান্তির ব্যবস্থা জোরদার রাখতে হবে এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে দ্রুত হস্তক্ষেপ করে দোষীদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।
প্রতিবার পূজামণ্ডপে পূজারীদের মায়ের কাছে ব্যক্তিগত সুখ-সমৃদ্ধি চাওয়া-পাওয়া প্রত্যাশা থাকলেও গত দু’বছর ধরে সব চাওয়া পরিণত হয়ছে করোনা সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রার্থনায়। দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি কামনার পাশাপাশি বাঙালির জীবনে আবার যেনো সব উৎসবের আমেজ ফিরে আসে, বন্দীজীবন থেকে পৃথিবীর সকল মানুষ যেনো মুক্তির আলোতে ফিরে আসে- মা দুর্গতিনাশিনীর কাছে এমন প্রার্থনা ছিলো সবার।
অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শুভ শক্তির সকল বিবেকবান মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাক যুগ থেকে যুগান্তরে- শারদীয় দুর্গোৎসবে এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক
সারাবাংলা/এসবিডিআই/এজেডএস/