শেখ রাসেলের বাংলাদেশ; ৫৮ বছরে আমরা কতটুকু মানুষ হয়েছি?
১৮ অক্টোবর ২০২১ ১২:০৯
আজ ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের ৫৮ তম জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘ক’ শ্রেণির দিবস হিসেবে শেখ রাসেলের জন্মদিন পালিত হচ্ছে। ১৯৬৪ থেকে ২০২১—অর্থাৎ বেঁচে থাকলে রাসেলের বয়স হতো ৫৮। ৫৭ বছরে মানুষ অবসরে যায় (যদিও ২০১৯ সালে সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়েছে) অথচ শিশু রাসেলকে মাত্র ১০ বছর ১০ মাস বয়সেই জীবন থেকে অবসরে যেতে হয়েছে। এমন দিনে প্রতিটি বাঙালি আজও যেন নিজ সন্তান হারানোর বেদনা বা আদরের ছোটভাই হারানোর জ্বালায় দগ্ধ হয়। রাসেল বেঁচে থাকলে আজ কেমন বাংলাদেশ পেত? রাসেলের বাংলাদেশকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? শত বাঁধা পেরিয়ে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়িত হয়েছে, ৪০-৪১ এর উন্নত বাংলাদেশেও আমরা আশাবাদী। কিন্তু ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত, কাঙ্ক্ষিত মাথাপিছু আয় অর্জিত হওয়াটাই কী উন্নয়ন? দিন দিন ধর্মান্ধতা বেড়েই চলছে। মানবিক মূল্যবোধ, আত্মমর্যাদা, সামাজিক নিরাপত্তা সবকিছুই যেন বিপন্ন আজ মৌলবাদী তাণ্ডবে। রাষ্ট্র, সিভিল সোসাইটি এমনকি মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সবাই যেন হরিণের মতো শুধু মাথা লুকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। অন্ধ সেজে প্রলয় মোকাবিলা করা যায় না। মিডিয়া এড়িয়ে গেলো, সোশাল মিডিয়াও বন্ধ ছিল প্রায় ১ দিন—তবুও গত কয়েকদিন বাংলাদেশে মৌলবাদীদের তাণ্ডবলীলা আমরা দেখলাম বিকল্প মিডিয়ায়। এমনই পরিস্থিতিতে আমরা শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করছি। এই ৫৮ বছরে আদতে আমরা কতটুকু মানুষ হয়েছি? আজ থেকে ৫৮ বছর আগে ঠিক এমনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্রান্তিলগ্নে ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবরে ধানমন্ডির বিখ্যাত ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িতে রাসেলের জন্ম হয়েছিল। সেদিনের ইতিহাস আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
কাশ্মিরের শ্রীনগরে অবস্থিত হজরতবাল দরগাশরিফ থেকে হজরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর সংরক্ষিত মাথার চুল চুরি হয়ে যায় বলে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়, যার প্রকাশ্য ইন্ধনদাতা ছিল স্বয়ং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান। ইসলামাবাদে ফেরার প্রাক্বালে ঢাকা বিমানবন্দরে আইয়ুব খান ঘোষণা করেন যে, ‘হজরতবাল ঘটনার কারণে পাকিস্তানের মুসলিমরা কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখালে তার কোন দায় নেই।’ এরপর হিন্দু সম্পত্তি দখল করতে মুসলিম লীগ নেতা খানে সবুর খুলনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করল, যার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল গোটা দেশে, যা ৬৪ এর দাঙ্গা হিসেবে ইতিহাসে পরিচিতি পায়। মুসলিম লীগের গুন্ডাবাহিনী ও বিহারীদের আক্রমণে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ভৈরবে হাজার হাজার হিন্দু প্রাণ হারায়। বাংলাদেশর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা খুলনা সংখ্যালঘু শহরে পরিণত হয় ৬৪ এর দাঙ্গায়। ইত্তেফাক জানায়, ঢাকা শহরের ৯৫ ভাগ হিন্দু বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। ঢাকা শহরের একটি মন্দিরও রক্ষা পায়নি সেই তাণ্ডব থেকে। ভারতে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেয় কয়েক লক্ষ মানুষ যার মধ্যে শুধু হিন্দুরাই নয়, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আদিবাসীও ছিল। সেই দাঙ্গা প্রতিরোধে প্রধান ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধু। ৬৪ সালের ১৬ জানুয়ারি ‘বেসরকারি দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত করা হয়। ১১ সদস্য সমন্বিত এ কমিটির বিশিষ্ট সদস্যদের মধ্যে নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌ. তফাজ্জল হোসেন, শাহ আজিজুর রহমান, সৈয়দ আজিজুল হক, খাজা খয়েরউদ্দিন, ডক্টর আলিনুর রাজি, হাজী মোহম্মদ দানেশ, বেগম রোকেয়া আনোয়ার, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঢাকার জয়কালী মন্দির রোডের এক বাড়িতে একদল হিন্দু আটকা পড়ে গিয়েছিল। প্রায় দেড়শজন নারী-পুরুষ এবং শিশু ছিল সেখানে। এদের ঘিরে ফেলেছিল বিহারি এবং মুসলমান বাঙালিরা। সিরাজ নামের বিশ-একুশ বছর বয়সের এক দুঃসাহসী বাঙালি তরুণ একাই এই বিপুল সংখ্যক লোককে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। একটি মাত্র আগ্নেয়াস্ত্র সম্বল ছিল তার। এই দিয়েই সারা দিন সে ঠেকিয়ে রেখেছিল রক্ত-পিপাসু মুসলমান গুণ্ডাদের।
গুলি চালাতে চালাতে সন্ধ্যার দিকে গুলি শেষ হয়ে যায় সিরাজের। তারপরেও খালি পিস্তল দেখিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিল সে উন্মত্ত গোষ্ঠীকে। তার এই নিরলস প্রচেষ্টায় উগ্র সাম্প্রদায়িক লোকগুলো পিছিয়ে যায় সাময়িকভাবে। কিন্তু পরিকল্পনা করে রাতে ফিরে এসে হামলা চালানোর। রাতের অন্ধকারে সিরাজ দেখতে পাবে না তাদের ভালো করে, এটাই ভাবনা ছিল তাদের।
তারা ফিরে আসার আগেই দীর্ঘদেহী সুদর্শন এক নেতা এসে হাজির হন সিরাজের কাছে। পঞ্চাশ রাউন্ড গুলি নিয়ে এসেছেন তিনি সঙ্গে করে। সিরাজের হাতে সেগুলো দিয়ে বজ্রকন্ঠে তিনি বললেন, ‘নিজের জান দিয়ে হলেও আমার এই হিন্দু ভাই-বোনদের বাঁচাও তুমি বাবা। বাঙালির সম্মান আর মর্যাদা আজ হুমকির মুখে। যেভাবেই হোক সেটাকে রক্ষা করতে হবে তোমার।’ এই নেতা, যিনি যে কোনো মূল্যে হিন্দুদের বাঁচানোর জন্য গুলি নিয়ে সিরাজের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ (Mujib – The Architect of Bangla Desh by Yatindra Bhatnagar, published in 1971)
এরপরই শুরু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারের মাঝেও এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে। যিনি এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে বাঙালি জাতিকে এনে দেবেন মুক্তির স্বাদ, তার ঘর আলো করে ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর জন্ম নিল এক ছোট্ট শিশু। রাসেলের যেদিন জন্ম হয় বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারণায় অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন।
সময়টা ছিল যুদ্ধ আর উত্তেজনার। ‘হজরতবাল’ চুরি কেন্দ্র করে গোটা উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, ৬২ এর চীন ভারত যুদ্ধের পর আইয়ুব খান আরও হিংস্র হয়ে ওঠে, যার ফলশ্রুতিতে ৬৫ এর পাক-ভারত যুদ্ধ। ৬২ সালে কিউবাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা-রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধ ৩য় বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হওয়ার উপক্রম, সেই সময় যুদ্ধবিরোধী বিশ্ব জনমত গড়ে তুললেন বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক নোবেলজয়ী সাহিত্যিক বার্ট্রান্ড রাসেল। বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় লেখক, বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামে নাম রাখলেন পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের। এই নামটিকে ঘিরে নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর মহৎ কোনো স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন ৫৮ বছরে কতটুকু পূরণ হলো? স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা জয়ী হয়েছি কিন্তু মুক্তির সংগ্রামে আমরা কতটুকু জয়ী হয়েছি?
বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের জাতীয় মানস অসাম্প্রদায়িক হয়নি, উল্টো আরও বেশি উগ্র আর অসহিষ্ণু হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জাতিরাষ্ট্রটিকে আমরা মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারছি না, এটাই সত্য। মানি বা না মানি ৬৪ সালের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি ২০২১ এ এসে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। একটি উদাহরণই যথেষ্ট, সকল আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ ছাত্রী এখন হেজাবধারী যেটা পাকিস্তান আমলেও ছিল না।
একটি বঞ্চিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবাদের উম্মেষ, বিকাশ ও ধারাবাহিক জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম শেষে রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি জাতি রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া এবং সেই রাষ্ট্রের সুবর্ণজয়ন্তীতে তাকে বিশ্বে ঈর্ষণীয় অবস্থায় উন্নীত করার একমাত্র গৌরবময় কীর্তিবাহী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দলের একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি গর্বিত সত্য, কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে আমার দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ তাদের মুখোশ মাত্র, সুযোগ পেলে তাদের ল্যাঞ্জা বেরিয়ে পড়ে।
আমাদের এই ক্রমক্ষয়িষ্ণু জাতীয় চেতনার পরিক্রমটা আমরা জানি, যেই উল্টোরথযাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মমতম হত্যাকাণ্ড ৭৫ এর পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। শিশু রাসেলসহ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে। সুপরিকল্পিতভাবে সামরিক শাসনের মাধ্যমে পবিত্র সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে পাকিস্তানি চেতনায় সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের বীজ বপন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া জাতিরাষ্ট্রের জমিনে। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের বপন করা বিষবৃক্ষের চারা গাছটি মহীরুহে পরিণত হয়েছে এরশাদের নিবিড় পরিচর্যায় অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে। যা শুরু হয় বিসমিল্লাহ্ দিয়ে পোক্ত হয় রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণায়।
কিন্তু যে ঘটনাটি আমরা ভুলে যাই তা হচ্ছে ১৯৮৮ সালে যখন অষ্টম সংশোধনী বিল এনে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয় তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সকল বামদল এমনকি জামায়াতে ইসলামও এর বিরোধিতা করেছিল। ধর্ম যেহেতু খুবই স্পর্শকাতর বিষয় তাই ৯০ এর গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরশাসনের পতন হলেও পরবর্তীতে কোন সরকারই রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। আস্কারা পেয়ে মৌলবাদ এখন ফ্রাংকেনস্টাইনে পরিণত হয়েছে। মুখে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বললেও সাম্প্রদায়িক শত্রুদের বিরুদ্ধে ৬৪ সলের বঙ্গবন্ধু যেমন ৫০ রাউন্ড গুলিসহ গুন্ডা সিরাজের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমন উত্তরসূরি আমরা হতে পারিনি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মী কেন—সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এবার ঘটনাপূর্ব বা ঘটনাকালে দেখলাম না, দেখলাম ঘটনোত্তরকালে।
মুজিববর্ষকালে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শেখ রাসেলের জন্মদিন প্রথমবার জাতীয়ভাবে উদযাপিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত বাংলাদেশে গৌরবোদীপ্তভাবে শিশু রাসেলকে স্মরণ করার কথা আজ। রাসেলবিহীন যে বাংলাদেশ আমরা নির্মাণ করছি তাকে অনাগত শিশুদের যোগ্য জন্মভূমিতে পরিণত করতে পারবো কি না জানি না। গত কয়েক দিনের তাণ্ডবে সোশাল মিডিয়ায় শুধু আহাজারি দেখলাম। নিয়মিত বিরতিতে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর তাণ্ডবলীলা চলছেই। সবাই শুধু জানতে চায় উত্তরণের পথ কী? সমাধান হিসেবে সুশীলদের বক্তব্য একটাই, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সেই সঙ্গে সকল সমস্যার কমন মহৌষধ ‘সচেতনতা’। অবশ্যই সকল প্রকার অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার কিন্তু ‘সচেতনতা’ স্বপ্নে পাওয়া কোনো দাওয়া নয়, জাতি চরিত্রে যে কোনো প্রকার সচেতনতা তৈরিতে পাড়ি দিতে হয় পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদী পথ।
ধর্মান্ধতা এখন শুধু স্থানীয় সমস্যা নয়, বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বব্যাপী একে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে তা বিশ্ব মোড়লদের কুটিল রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের বিষয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ নামক এই অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটিকে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে বিশ্বমোড়লদের কূটকৌশল চলতেই থাকবে। তবু এর বিপরীতে সাম্প্রদায়িকতা রুখতে বাংলাদেশকে দাঁড়াতে হবে তার নিজস্ব শক্তিতে। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে, কিন্তু সময় এখনও আছে। সেই নিজস্ব শক্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন যার সহজ সমাধান ২০২০ সালের ১০ মার্চ হাইকোর্টের দেওয়া রায় অনুযায়ী সকল ক্ষেত্রে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’কে প্রতিস্থাপন করা।
বাংলাদেশের উল্টোযাত্রা শুরু হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের হাত ধরে, সেই ক্যান্টনমেন্টে সবার আগে ‘জয় বাংলা’ স্থাপন করতে হবে। সশস্ত্রবাহিনীর সকল সদস্যকে পাসিংআউট প্যারডে জয় বাংলা উচ্চারণ করে শপথ নিতে হবে। ২০১২ সালে ইন্ডিয়ান আর্মি চিফ জেনারেল বিক্রম সিং সকল স্যালুটেশন ও সম্বোধনে ‘জয় হিন্দ’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে অফিস আদেশ জারি করেছিলেন। ইন্ডিয়ান সকল সেনা সদস্য সকাল বিকাল হাজারবার ‘জয় হিন্দ’ উচ্চারণ করে। গুজরাটের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ইয়েস স্যার’ এর পরিবর্তে বাধ্যতামূলকভাবে ‘জয় হিন্দ’ উচ্চারণ করতে হয়। পাকিস্তানেও ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বা ‘জিয়ে পাকিস্তান’ সার্বজনীনভাবে উচ্চারিত হয়। শুধু আমাদেরই যেন লজ্জা লাগে জাতীয় স্লোগান উচ্চারণে, যেন ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করলেই মুসলমানিত্ব শেষ হয়ে যাবে, ট্রিট হতে হবে আওয়ামী লীগার হিসেবে।
আমরা বেমালুম ভুলে যাই, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মাধ্যমেই বাঙালি তার আত্মপরিচয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক নির্মাণ করেছিল একাত্তরে। আমাদের ঘুরে ফিরে শিকড়েই ফিরতে হবে। একত্তরে স্বাধীনতা পেয়েছি, একাত্তরকে হৃদয়ে ধারণ করলেই মুক্তি মিলবে। একাত্তরের জয়ধ্বনি ‘জয় বাংলা’ই ধর্মান্ধতার অব্যর্থ ঔষধ। আজ যে ধর্মভীরু তরুণ ধর্মান্ধ নেতাদের উস্কানিতে জেহাদি জোশে ‘নারায়ে তাকবির’ বলে হামলা চালায় মন্দিরে সে যদি ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে বেড়ে উঠত, তবে এত সহজেই তাকে বিভ্রান্ত করা যেত না। যতদিন বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে ‘জয় বাংলা’কে স্থায়ী রূপ না দিতে পারবে ততদিন এদেশে শেখ রাসেলরা শিশু হয়েই জীবন থেকে অবসরে যাবে, স্বাভাবিক অবসর বা স্বাভাবিক মৃত্যু অধরাই থেকে যাবে। জয় বাংলা।
লেখক: কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ
সারাবাংলা/আইই