ফোটার আগেই বৃন্তচ্যুত ফুল
১৮ অক্টোবর ২০২১ ১৮:৩৬
শেখ রাসেল। মাত্র ১১ বছর বয়সের এই শিশুর অসহায় আকুতি একটু নরম করতে পারেনি পঁচাত্তরের নির্মম ঘাতকদের হৃদয়। চোখের সামনে বাবা, মা, দুই বড় ভাই, দুই ভাবির বুলেটবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়তে দেখে শিশু রাসেল বাঁচতে চেয়েছিল, বলেছিল, ‘আমাকে মেরো না’ – কিন্তু তার এই কথা কানে তোলেনি ঘাতকদল। তারা ছিল কাণ্ডজ্ঞান রহিত, বিবেকবুদ্ধি শূন্য, বেপরোয়া। তাই শুধু জাতির জনককে নয়, শিশু রাসেলসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছিল। সেদিনও রাত ভোর হয়েছিল, কিন্তু ১৫ আগস্ট, পঁচাত্তরে বাংলাদেশে দিনের আলো ছিল রাতের আঁধার থেকেও অধিক অন্ধকারময়। সেই অন্ধকার দূর করে দেশের বুকে আলো ফোটাতে অনেক সময় লেগেছে, বলা যায়, এখনও সে আঁধার কাটেনি পুরোপুরি। শিশু হত্যার মতো গর্হিত অপরাধ জাতির কপালে যে কলঙ্কের দাগ লেপে দিয়েছে, তা কি এতো সহজে মুছে ফেলা যায়?
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাত দেড়টায় জন্ম হয়েছিল রাসেলের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতেই হলো তার ছোট্ট জীবনের চির অবসান। ঘাতকের তপ্ত বুলেট শিশু রাসেলের কোমল শরীরটি ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। এই নিষ্ঠুরতা অসহনীয়, মেনে নেওয়ার মতো নয়। অথচ আমরা তা মেনে নিয়েছি, ঘাতকদের মোকাবিলায় সাহসের পরিচয় দিতে পারিনি। এটা আমাদের সমবেত লজ্জা এবং গ্লানি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শেখ রাসেল। দুই কন্যা, তিন পুত্র। কন্যা দুজন বেঁচে আছেন। একজন শেখ হাসিনা, অন্যজন শেখ রেহানা। শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং কনিষ্ঠতম শেখ রাসেনকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাবা-মায়ের সঙ্গেই। একটি দেশের রাষ্ট্র প্রধানকে, যিনি আবার সেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা-স্থপতি, সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার নজির পৃথিবীতে বিরল। সরকার প্রধান, রাষ্ট্রনেতা কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে প্রতিহিংসাবশত বা অন্য কোনো ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিবাদে হত্যা কিংবা গুপ্ত হত্যার ঘটনা একাধিক ঘটেছে। কিন্তু রাষ্ট্র পিতাকে সপরিবার হত্যার ঘটনা বাংলাদেশেই ঘটেছে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট এমন অনেককে হত্যা করা হয়েছে, যাদের কোনো রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা ছিল না, যাদের বিরুদ্ধে ছিল না কোনো ধরনের অভিযোগ কিংবা তাদের কারো আবার অপরাধ সংঘটনেরও কোনো ক্ষমতা বা সুযোগ ছিল না। কিন্তু ঘাতক দল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে মার্জনা করেনি, বিবেচনা করেনি কারো বয়স। ভাগ্যক্রমে দেশের বাইরে থাকায় জীবন রক্ষা পায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা হাসিনা ও রেহানা।
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, তখন মাত্র চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র, এগারো বছরের শিশু। মায়ের কাছে গিয়ে বাঁচার আকুতি জানিয়ে হতবিহ্বল রাসেল ঘাতদের কাছে উপহার পেয়েছিল তপ্ত বুলেট এবং স্নেহময়ী জননীর রক্তাক্ত দেহ। সেদিন অমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও আকাশ ভেঙ্গে পড়েনি কিংবা শিশু হত্যার বিক্ষোভে সেদিন কেঁপে উঠেনি বসুন্ধরা। সব শিশুর বাসযোগ্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের উজ্জ্বল সময়গুলো উৎসর্গ করেছেন, কিন্তু দেশ স্বাধীন করে নিজেকে জীবন দিতে হলো, এমন কি শিশু পুত্রের জীবনও রক্ষা করা গেল না। কিছু বিশ্বাসঘাতক প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডে শরিক হলো, আর পুরো জাতি প্রতিবাদহীন নীরবতায় সব মেনে নিল। যে জাতিকে অমিত সাহসে বলীয়ান করে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার মন্ত্রে করেছিলেন উজ্জীবিত, সেই জাতির এমন অসহায় আত্মসমর্পণ বড় কষ্ট এবং বেদনার।
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর এক হেমন্তের মৃদু শিশিরস্নাত রাতে মুজিবদম্পতির ঘরে জন্ম হয়েছিল এক শিশুর। তার নাম রাখা হয়েছিল রাসেল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পৃথিবীবিখ্যাত দার্শনিক-চিন্তাবিদ-শান্তি আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক রার্টান্ড রাসেলের ভক্ত। রাসেলের লেখা তিনি পড়তেন। রাসেলকে নিয়ে বেগম মুজিবের সঙ্গে আলেচনাও করতেন। বেগম মুজিব গৃহবধূ হয়েও যে প্রখর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পন্ন হয়ে উঠেছিলেন, তার পেছনেও ছিল বঙ্গবন্ধুরই অবদান। বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ। জেল-জুলুম ছিল নিত্য সঙ্গী। সংসার সামলানোর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের সুখ-দুঃখের খবরসখবরও বেগম মুজিব রাখতেন। যে অল্প সময় স্বামীর সান্নিধ্য পেতেন সে সময়টুকুতেই নিতেন রাজনীতির পাঠ। বঙ্গবন্ধুর কাছে শুনে শুনে বেগম মুজিবও হয়ে উঠেছিলেন রাসেলভক্ত। আর সে কারণেই কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রেখেছিলেন রাসেন। মনে হয়তো প্রচ্ছন্ন আশা ছিল তাদের ছোট ছেলেটিও যদি বার্টান্ড রাসেলের মতো যশস্বী-মনস্বী হয়ে ওঠে। তেমন সম্ভাবনাও ছিল। সব শিশুর মধ্যেই থাকে অপার সম্ভাবনা। নানা উপায় বা কারণে কারো ভেতরের সম্ভাবনা বিকশিত হয়, কারোটা প্রতিকূলতার মুখে বাধাপ্রাপ্ত হয়, ব্যাহত হয়। শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে কি হতেন সে আলোচনা এখন অর্থহীন।
বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বাগান শোভিত করে যে পুষ্প কলি মেলেছিল ,তা প্রস্ফূটিত হওয়ার আগেই একদল পাষণ্ড সব তছনছ করে দিল। ফুলটি ফুটতে পারলো না। সৌরভ ছড়াতে পারলো না। শেখ রাসেলের জন্মগ্রহণের সময়টি বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ ইতিহাসের জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ কাল। বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন ৪০। তিনি তখন রাজনৈতিক মঞ্চে আরোহনের জন্য একটির পর একটি সিঁড়ি ভাঙছেন। তার সময়ের অন্যসব বাঙালি নেতাদের আপসকামিতা-ভীরুতার বিপরীতে তিনি এক আপসহীন সাহসী মানুষ হিসেবে জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছেন। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু তাকে পরাভূত করতে পারছে না। রাসেলের জন্মের পরের বছরগুলোই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের প্রকৃত উত্থানপর্ব।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, পরের বছর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, কারামুক্তি, বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত, ১৯৭০-এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক গণরায় লাভ এবং সবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। এই তোলপাড় করা সময়েই শিশু রাসেলের হাটি হাটি পা পা করে বেড়ে ওঠা। পিতার স্নেহ সান্নিধ্য তেমন না পেলেও পিতার জনগণঅধিনায়ক হয়ে ওঠা দেখেছে শিশু রাসেল। তার মানসগঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখছিল ওই টালমাটাল সময়কাল।
পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হওয়ায় রাসেল স্বাভাবিকভাবেই সবার চোখের মণি হয়ে উঠেছিল। তাকে নিয়ে ভাই-বোনদেরও আদিখ্যেতার শেষ ছিল না। অতি আদরে বখে না গিয়ে রাসেল কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত এবং একজন চৌকশ শিশু হিসেবেই বেড়ে উঠছিল। অন্য ছেলেমেয়েরা বাবার আদর-ভালোবাসা যতোটুকু পায়নি, রাসেল সেটা পেতে শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধু সরকার প্রধান হওয়ার পরও শিশু রাসেল তার সঙ্গলাভ থেকে বঞ্চিত হয়নি। দেশে কিংবা দেশের বাইরে বঙ্গবন্ধু রাসেলকে সঙ্গী করে আনন্দ পেতেন। এই ছোট ছেলেটিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনে এবং চোখে ছিল অন্যরকম স্বপ্ন-কল্পনা। রাসেলকে বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তার হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দিয়ে। কিন্তু হায়েনার দল তার স্বপ্নপূরণ করতে দিল না।
ঘাতকরা সপরিবারে মুজিব পরিবারকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। এই নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচারের পথও আইন করে বন্ধ করা হয়েছিল। ঘাতকদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। হত্যা, শিশু ও নারী হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করার পরও যাদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি, তারা একটা সময় পর্যন্ত সদম্ভে আস্ফালন করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। রাসেলের বড় বোন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে পঁচাত্তরের খুনিদের বিচারের আওতায় এনেছেন। শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া যে রাষ্ট্রের কর্তব্য সেটা প্রতিষ্ঠিত করার পথে দেশ অগ্রসর হচ্ছে।
রাসেলের জন্ম হয়েছিল বড় বোন শেখ হাসিনার ঘরেই। রাসেল পৃথিবীর আলো দেখার সময় সম্ভবত আগে দেখেছিল ‘হাসু আপু’র মুখ। শেখ হাসিনার আদর-স্নেহেই বড় হয়ে উঠছিল রাসেল। এটা বুঝতে কষ্ট জয় না যে, রাসেল হয়ে উঠেছিল শেখ হাসিনার ‘কলিজার টুকরা’। এই ভাইটিকে হারানোর দুঃসহ বেদনা যে ভোলার নয়! এই দুঃখভার বুকে নিয়ে, উদ্গত কান্না চেপে দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাকে। বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারকে হত্যার পর অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়ার যে অপসংস্কৃতি দেশে চালু হয়েছিল তা থেকে বেরিয়ে আসার ধারা শুরু হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। শিশুদের জন্য, সব মানুষের জন্য নিরাপদ একটি দেশ গড়ার চেষ্টাকে বলবান করার মধ্য দিয়েই শেখ রাসেলকে যথাযথভাবে স্মরণ করা সম্ভব হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই