Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা; ইসলামের শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

মর্তুজা হাসান সৈকত
২৩ অক্টোবর ২০২১ ১৭:৪৪

কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফ রেখেছিল যে ব্যক্তি, তাকে শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মাধ্যমে মন্দিরে কোরআন শরীফ রাখার যে গল্পটি প্রচারিত হয়েছিল- সেটি এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে মোটামুটি সব পক্ষই এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সুকৌশলে কাজটি ঘটানো হয়েছিল। পূজা ছিল উপলক্ষ মাত্র। কিন্তু যে আগুন ১৩ অক্টোবর ফেসবুকের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল, সেই আগুনই অন্তত ১৬ জেলায় হিন্দুদের বাড়ি, প্রতিমা ভাঙচুরের ইন্ধন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে গেছে রংপুরের পীরগঞ্জের হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত তিনটি গ্রামকেও।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে এবার অনেক জায়গায় পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা যায়নি, প্রতিমা বিসর্জনও হয়নি অনেক জায়গায়। অনেক জায়গায় পূজা শেষ হবার আগেই প্রতিমা বিসর্জন দিতে হয়েছে। মূলত কুমিল্লার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পাঁচ দিনের উৎসবের তাল কেটে যায় তৃতীয় দিনেই। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া দেশে, যে দেশটিকে এর স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও সব মানুষের দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, সেখানে এমন ঘটনা শুধু দুঃখজনকই নয়, দেশের মূল চেতনা ও নীতিরও পরিপন্থী। তবে একটু দেরিতে হলেও সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও কঠোর বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, হৃদয় থেকে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে, তার কতটুকু উপশম হবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধের পর এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় মানুষেরা নতুন দেশে সমাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অন্য সম্প্রদায়ের তুলনায় তারা ত্যাগও বেশি স্বীকার করেছেন। কিন্তু এতো দীর্ঘ সময় পরও আমাদের সামনে এখন একটি প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আসলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে এই দেশের নাগরিক হিসেবে সংখ্যাগুরু মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা মেনে নিতে পারছি কি না? পরিসংখ্যান বলছে, পাকিস্তান আমল তো বটেই, স্বাধীন বাংলাদেশেও অধিকাংশ সময় সংখ্যালঘুদের কাটাতে হয়েছে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে। রাজনৈতিক সহিংসতার সুযোগে একটি স্বার্থান্বেষী মহল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বারবার হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে আসছে।

অথচ এসব সাম্প্রদায়িক কাজ মহানবীর (সা.) নির্দেশনা ও ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। সুরা আনআমের ১০৮ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেবদেবীর পূজা-উপাসনা করে, তোমরা তাদের গালি দিও না। যাতে করে তারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে।’ ইসলামে যেখানে অন্য ধর্মের দেবতাকে গালি দেওয়াই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে মন্দির ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর কোনোভাবে ধর্মসম্মত হতে পারে না। মহানবী (সা.) এ ও বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে কিংবা তাদের ওপর জুলুম করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি মুহাম্মদ ওই মুসলমানের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে লড়াই করব।’

২.

মূলত পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারপর সামরিক বা বেসামরিক লেবাসে জিয়া, এরশাদসহ যারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছেন তারা শুধু যে সংবিধানকে ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে আবদ্ধ করেছিলেন তা নয়, মাইনরিটি ক্লিনজিং প্রক্রিয়াও ত্বরান্বিত করে গেছেন। ১৯৯০ ও ১৯৯২ সালে এরশাদ ও বিএনপির আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা লাগিয়ে সংখ্যালঘুদের বহু ঘরবাড়ি ও মন্দির ভাঙা হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সারা দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যে তাণ্ডব চালিয়েছে-স্বাধীনতা উত্তরকালে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়ানক নির্যাতন। তখন পূর্ণিমা-সীমাদের কান্নায় বাতাস ভারী হলেও অপরাধীরা শাস্তি পায়নি। গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, জোর করে বিয়ে, ধর্মান্তরিত করা, চাঁদা আদায় ও সম্পত্তি দখল কোন কিছুই যেন বাদ ছিল না সে সময়ে।

দেশে প্রায় দেড় কোটি লোক আছে হিন্দু সম্প্রদায়ের। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যে দেশের জনসংখ্যাই এর চেয়ে কম। এই বিরাট জনগোষ্ঠীর মেজরিটিই এখন ‘শভিনিজমের’ বলি। আগে আড়ালে আবডালে বলা হলেও এখন অনেকক্ষেত্রে মুখের সামনেই তাদের বলা হয় ‘মালাউন’। এটা পরিষ্কার যে একাত্তরের পরাজিত শক্তি সংখ্যালঘু হ্রাসকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে একটি গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের সংকট তৈরি করতে চায়। তারা ভাবছে, যদি সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করাও সহজতর হবে।

প্রথম আলোর ২০১২-এর ২২ সেপ্টেম্বরের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দেশের জনসংখ্যা বাড়লেও সেই অনুপাতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে না। ২০০১ ও ২০১১ সালের আদমশুমারির জেলাভিত্তিক তথ্য পাশাপাশি রাখলে দেখা যায়, ১৫টি জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা কমে গেছে। জনসংখ্যাবিদদের মতে, এটি ‘মিসিং’ পপুলেশন বা ‘হারিয়ে যাওয়া মানুষ’। এরা কেন হারিয়ে গেলো? কেন নীরবে দেশত্যাগ করার কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে অবিশ্বাস্য নেতিবাচক প্রভাব পড়লো সেটা নিয়ে কেউ কি ভেবেছে? পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বরিশাল বিভাগের কোনো জেলাতেই হিন্দুদের সংখ্যা বাড়েনি। বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা- এই ছয়টি জেলায় ২০০১ সালের আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৮ লাখ ১৬ হাজার ৫১ জন। ২০১১ সালের শুমারিতে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৯ জনে। খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা, নড়াইল ও কুষ্টিয়া- এই ৫ জেলায় হিন্দুদের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে। উল্লেখ্য, ২০০১ সালে বরিশাল ও খুলনা বিভাগেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।

গত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন ও উচ্ছেদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্যান্য দল একযোগে কাজ করে থাকে। ২০১২ সালে রামুতে ট্রাকে লোক এসে বৌদ্ধমন্দিরে হামলা করেছে। নাসিরনগরে কয়েক ঘণ্টা ধরে হামলা করা হয়েছে। আর সুনামগঞ্জের শাল্লায় তো মাইকিং করে লোক জড়ো করা হয়েছে। এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করা হয়। আরেকটি ব্যাপার হলো, যত হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাই ঘটুক- পুলিশ আসে ঘটনার পরে। কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হামলা ও লুটপাটের পর পুলিশ এসেছে, চৌমুহনী ও ফেনীতে হামলা চলাকালীন পুলিশ-প্রসাশন ফোন রিসিভই করেনি। একই অবস্থা রামুতেও হয়েছিল। আর পীরগঞ্জে আমরা দেখলাম, পুলিশ নিরাপত্তা দিতে গেলো এক জায়গায়, কিন্তু অগ্নিসংযোগ হলো অন্য জায়গায়।

৩.

আমরা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক দাবি করছি। অথচ কয়েকদিন ধরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে সন্ত্রাসী হামলা হলো, তাদের মন্দির ও পূজামণ্ডপে ভাঙচুর করা হলো, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হলো- সেসব ঘটনা সংখ্যাগুরুদের মনে কি খুব একটা দাগ কেটেছে? উল্টো রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা যেসব কথা বলছেন, তাতে আক্রান্তের ওপর তাদের সহানুভূতি প্রকাশের চেয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টাই বেশি দেখা যাচ্ছে। এ কারণে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আমাদের আস্থা নেই।’ কিন্তু এই অনাস্থা কি একদিনে তৈরি হয়েছে? দিনে দিনে আক্রান্ত হতে হতে তাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে।

কোন দেশের সংখ্যালঘুরা নিরাপদ থাকবে কি না, তা অনেকাংশে নির্ভর করে সেই দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মন-মানসিকতার ওপর। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা মাটি কামড়ে এ দেশেই থাকতে চায়। তাদের তাড়িয়ে বা তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করে বাংলাদেশ কি লাভবান হতে পারবে? বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো হোক সেটা আমরা কেউই চাই না। দেশটিতে একদিকে যেমন সংখ্যালঘু বিতাড়ন প্রক্রিয়া সফলতার সাথে সমাপ্তির পথে একইভাবে সংখ্যাগুরুরাও নিজেরা নিজেরা মারামারি করছে। সেখানে শিয়ারা সুন্নিদের মারছে, আর সুন্নিরা মারছে শিয়াদের। আর সবাই মিলে হত্যা করছে মানবতাকে। বাংলাদেশেও যাতে সেই পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়, সে জন্য এখনই আমাদের সজাগ হওয়া উচিত।

এর পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সুরক্ষায় নারী নির্যাতন দমন আইনের মতো একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। আমাদের যে আইনগুলো আছে, সে সব দিয়ে এ সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না। এই আইন প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাস দমন আইন, দ্রুত বিচার আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োগ ঘটানো যেতে পারে। সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো উচিত সংখ্যালঘুদের স্বার্থে নয়, সংখ্যাগুরুদের স্বার্থেও। কারণ, বহুত্ববাদের ধারণা থেকে রাষ্ট্র একবার সরে এলে সেটি ফিরিয়ে আনা শুধু কঠিনই হবে না অসম্ভব একটি কাজও হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

সারাবাংলা/এসবিডিই

মত-দ্বিমত মর্তুজা হাসান সৈকত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা; ইসলামের শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর