Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

মাসুদ রহমান
২৪ অক্টোবর ২০২১ ১৫:৫২

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাটুগান গাইতাম॥
– শাহ আবদুল করিম

গ্রামে বাস করা হয়নি সেভাবে কোনোকালেই, সেসময় বাউলা বা ঘাটুগান কী তাও আলাদাভাবে বুঝতাম না। মানে নওজোয়ান কালের কথাও বলছি না। তারপরও একথাটুকু বলতেই পারি, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। ও হ্যাঁ, হিন্দু-মুসলমান ব্যাপারটাও সেই শৈশবে সেভাবে বুঝিনি। বুঝতাম, আমি বা সহপাঠী বাচ্চু মুসলমান, আরেক সহপাঠী গৌতম বা খেলার মাঠের সঙ্গী সুবীর হিন্দু। আমি-বাচ্চু নামাজ পড়ি, গৌতম-সুবীর পুজো করে। ব্যাস, এটুকুই। এ-নিয়ে বিশেষ পার্থক্য করার প্রশ্নই ওঠেনি। ঝগড়াকালে একটু ক্ষেপানো বা আড্ডার সময়ে এই পরিচয় প্রসঙ্গ তুলে দুটো কথা যে হতো না, তা নয়। তবে যার গাত্রবর্ণ কালো তাকে ‘ক্যাল্টে’ বা মোটাকে ‘মোটকু’, লম্বাকে ‘লম্বু’, চিকনকে ‘শুটকি’ বলতাম, সে রকম আর কী। তা-ও মনে হয় ধর্ম প্রসঙ্গ নিয়ে তেমন কিছু বলা হতো না এ-বিষয়ে জ্ঞানগম্যি কম থাকার কারণে। বাড়ি থেকেও বারংবার বারণ করে দিতো, হিন্দু বন্ধুরা সংখ্যায় স্বল্প, কাজেই ধর্ম নিয়ে তাদের যেন কটূকথা বলে দুঃখ দেয়া না হয়, এতে আল্লাহ নারাজ হন। তবে আমাদের পক্ষ থেকে হিন্দু বন্ধুদের না ঘাঁটানোর বড়ো কারণ হলো পুজোর দিনে ওদের বাড়ি নেমতন্ন খেতে পাওয়া। এটা ফাও-ই ছিলো বলবো। কারণ এমনিতে সারাবছর আসলেও ঈদের সময়ে ওরা আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় প্রবেশ করতো না গো-মাংসের কারণে। কিন্তু আমাদের যেহেতু ওদের কোনো খাদ্যে অরুচি বা বারণ ছিল না, তাই প্রাপ্তিযোগ একটু বেশিই হতো। এ-নিয়ে ওদের মনে সামান্য আফসোস ও আমাদের মধ্যে একটু আনন্দ ছিলো। চারণ করতে বসেছি আমার পূজা-উৎসব বিষয়ক স্মৃতি।

বিজ্ঞাপন

কদিন পরপরই কীসব পার্বণ-তিথির কথা বলে হিন্দু বন্ধুরা পকেটে বা প্যাকেটে করে টক-মিষ্টি প্রসাদ নিয়ে আসতো। কার পুজো তা জানার প্রয়োজন বোধ করিনি, আমাদের মূল লক্ষ্য থাকতো পেটপুজো। পুজোর আনন্দও অবশ্যি ছিল। বিশেষ করে তিনটি পুজো তিন রূপে-রসে আমাদের সাংবাৎসরিক আনন্দের বার্তা নিয়ে আসতো। স্কুলে সরস্বতী পূজা, নদীতীরে কালীপূজা আর মন্ডপে বিস্তৃত দুর্গাপূজা।

শৈশবে দুর্গোৎসব নানা কারণে অন্য যে-কোনো পূজার চেয়ে অধিক আনন্দ-আকর্ষণের ছিল। প্রথমত, অপেক্ষাকৃত লম্বা ছুটি পাওয়া। কয়েকদিন একেবারে পড়াশোনা নেই। খেলা আর বেড়ানো। দ্বিতীয়ত, অন্য পুজোয় না হলেও, দুর্গাপূজায় সব হিন্দু বন্ধুর বাড়িতেই কিছু না কিছু আয়োজন-আপ্যায়ন থাকতো। তৃতীয়ত, ষষ্ঠী থেকেই মন্ডপগুলোতে বিগ্রহ দেখতে যাওয়া হতো। আব্বা নিয়ে যেতেন। ব্যাপারটা ভাবি আজও, উনি নিয়ে যেতেন আসর বা মাগরিবের পর। হয়তো নামাজ শেষে মাথায় টুপি নিয়েই আমাদের নিয়ে বেরিয়েছেন। কখনোবা বিকেলে বেরিয়েছি, মাগরিবের ওয়াক্ত হয়েছে, উনি মন্ডপেই পরিচিত কারো কাছে আমাদের রেখে নামাজ পড়ে এসেছেন। কই, ধর্মের কোনো সমস্যার কথা তো ওঠেনি! বৈশাখের মেলাতে নিয়ে যাওয়ার মতোই ব্যাপার আর কি। এভাবেই বেড়ে উঠেছি আমরা। দুর্গাপূজার বাড়তি দুটো আকর্ষণ-অনুষঙ্গ ছিল। ‘আনন্দমেলা’ পূজাবার্ষিকী ও ক্যাসেট-ডিস্কে পূজার গান। বাসায় ‘দেশ’ ও ‘আনন্দলোক’-এর শারদীয়া সংখ্যাও আসতো। শিশুকালে ‘দেশ’ পড়তে পারতাম না, আর আমাদের কাছে ‘আনন্দলোক’-এর একমাত্র উপযোগিতা ছিল নায়ক-নায়িকাদের ছবি দেখা। হিন্দি ছবির বহু চেনামুখের সাথে নাম-পরিচয় ওসব সংখ্যার মাধ্যমেই ঘটেছে। পড়তাম ‘আনন্দমেলা’র রহস্য-রোমাঞ্চ-গোয়েন্দা গল্প-উপন্যাস। কমিক পড়ার শুরুও সেখান থেকেই। এরপর আমাদের কৈশোরে এলো ক্যাসেট-রেকর্ডার। সন্ধ্যা-আরতি-হেমন্ত-মান্নার বাংলা, লতা-রফি-কিশোরের হিন্দি গানের পূজার প্রকাশনা আসতো দোকানে। সেসব ক্যাসেটের প্রতীক্ষায় থাকতাম। ভিন্ন ভাষার গান শোনার কানটা সৃষ্টি হয়েছে এ-উপলক্ষেই। দুর্গোৎসবকে যে সর্বজনীন বলা হয়, আমার মনে হয় তার একটি দিক হিসেবে এটাও গণ্য করতে পারি যে, বাঙালির শৈল্পিক মানস সৃষ্টিতে উৎসবটি এভাবে কাজ করে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

কালীপূজা উপলক্ষে নদী দেখার সুযোগ ঘটতো। তখন পালতোলা, গুণ টানা নৌকার কাল। কুষ্টিয়া আমাদের শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা গড়াই নদীতে ভাসতো নানান কিসিমের নৌকা। সেই সাথে কিছুটা কিম্ভূত রূপ-বেশের বিশাল কালীমূর্তি। দুটোই আমাদের দ্রষ্টব্য ছিল। তবে কালীপুজো উপলক্ষে আমাদের শহরে আতশবাজি ফুটানো দেখিনি তখন। সেটা দেখলাম সরকারি চাকুরির শুরুতে সিলেটের জকিগঞ্জে এসে। না, জকিগঞ্জে এসব হতো না। তবে উপজেলাটি ছিল সীমান্তবর্তী। ওপারে ভারতের আসাম রাজ্য। জেলা করিমগঞ্জ। মাঝখানে কুশিয়ারা নদী। মাত্র বরাক উপত্যকা থেকে নেমে এসেছে। ক্ষীণপ্রশস্ত নদীটির ওপারের সাইকেলের বেলও শোনা যেতো এপারের কাস্টমস পয়েন্টের সামনের খোলা জায়গা থেকে। প্রায়ই সন্ধ্যাকালে বসতাম নদীতীরে। ভারতীয় অংশের যেটি বিশেষ নজরে আসতো, সেটি হচ্ছে সাদা দেয়াল ও স্বর্ণচূড়াবিশিষ্ট এক মন্দির। ওপারে যাতায়ত আছে এমন লোকদের কাছে শুনেছিলাম, ওটা কালীমন্দির। মন্দিরের উচু স্তম্ভে বাঁধা মাইক হতে এপারে ভেসে আসতো গান। একটি সংগীত প্রায়ই বাজতো, ‘সকলি তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি/ তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি।’ দিবাবসানের আলোছায়ার অলৌকিক মুহূর্তে যেন আকাশ থেকে নেমে আসতো এই ভক্তিগীতির বাণী-সুর- আমাদের কখন যেন কিছুক্ষণের জন্যে করে দিতো স্তব্ধ। আর কালীপূজার রাতে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে জমা হতো সীমান্তের এপার থেকে ওপারের আতশবাজি দেখতে। শব্দময়তার সাথে বিচিত্র বর্ণের চিত্রময় শোভা সৃষ্টি হতো কুশিয়ারার ঊর্ধ্বাকাশে। সে মায়াবী আলো যেন মরীচিকারূপ সীমান্তকে অবলুপ্ত করে দিতো। যে একটা ভাবনা তখন আমাকে আচ্ছন্ন করতো, তা হলো, আসাম-অংশের মানুষেরা জানতেও পারছে না, পুজোয় তারা এই যে আনন্দ করছে তা আকাশতরঙ্গের মধ্য দিয়ে আরেকটি দেশের কিছু মানুষের নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রায়ও আনন্দের উপকরণ হয়েছে। সার্থক আনন্দবস্তু বুঝি এটাই!

সরস্বতী পূজার কথা বলে সমাপ্তি টানি। যদিও সরস্বতীর আরাধনা-অর্চনার সাথে আমাদের বিশেষ যোগ তো সেই শৈশবেই। বিদ্যার দেবী বলে স্কুলে তার পূজা হতো। ব্যবস্থাপনায় আমাদের সহযোগিতা করার সুযোগ থাকতো, তাই একটা কর্তৃত্বের ভাব আসতো। অবশ্য কবুল করি, লুচি-সবজির আকর্ষণই ছিল সর্বাধিক। তবে আমার হিন্দু বন্ধুরা তাদের পড়াশোনার ব্যাপারে হংসবাহন শ্বেতবসনা শিল্পের এই দেবীর প্রতি যেভাবে নির্ভর করতো, ভক্তিপরবশ থাকতো, তা আমার মনে খুব করে গেঁথে যায়। তা জকিগঞ্জ সরকারি কলেজের কর্মকালের কথা বলছিলাম। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও জকিগঞ্জে কিছু হিন্দুর বসবাস ছিল। তারা মূলত দরিদ্র ও নিন্মবর্ণের। হিন্দু শিক্ষার্থীরা না বললেও বুঝতাম, কলেজে যে সরস্বতী পূজা হয় না, এটা নিয়ে তাদের মনে একটা বেদনা আছে। কোনো বাধা যে ছিল তা বলা যাবে না। কারণ, কেউ তো এ-ব্যাপারে কোনোদিন উদ্যোগও নেননি। আমি কথাটা পাড়লে দেখি, হিন্দু সহকর্মীরা তাদের ব্যক্তিগত অসুবিধা, পারিবারিক কাজকর্মের কথা বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেন। একরকম অনাগ্রহই প্রকাশ করলেন। মুসলিম সহকর্মীদেরই বরং দেখি তেমন কোনো আপত্তি নেই। ধর্মনিষ্ঠ মোক্তার হোসেন সাহেব তো উৎসাহ দিয়ে বললেন যে, ‘এটা হিন্দু ছাত্রদের পাওনা। আপনারা তরুণ শিক্ষকেরা উদ্যোগ নেন।’ সার্বক্ষণিক ও সর্বাত্মকভাবে পাশে পেলাম ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আতাউল গণিকে।

সেই প্রত্যন্ত জকিগঞ্জে বিগ্রহ নির্মাণ বা মন্ডপ সাজানোর উপকরণ তেমন পাওয়া যেতো না। মানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো করাটা অসম্ভব ছিল। তাছাড়া বাজেটও সামান্য। ছোট্ট কলেজ, এ খাতে আয়ও ছিল সামান্য। কী আর করা? ছোটখাটো বিগ্রহের ফরমাশ দেওয়া হলো। জকিগঞ্জের বাজার লভ্য সস্তা-সাদামাটা সামগ্রী দিয়েই সাজানো হলো মন্ডপের ভিতর-বাহির। উপজেলা শহর ছাড়িয়ে কিছুটা জনপদবিচ্ছিন্ন এলাকায় কলেজ। আলোকসজ্জার প্রশ্নই নেই।

কিন্তু পুজোর দিন আমার ছাত্রদের চলনে-বলনে পরম আনন্দপূর্ণ অভিব্যক্তি দেখলাম। মনে হলো, নাহ্ কোথাও কোনো দীনতা নেই, সকলি ভরে গেছে অমূল্য বৈভবে। মুসলমান ছাত্রছাত্রীরাও বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিল। এলাকাটি মুসলিম মৌলবাদী প্রভাবিত বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু দেখলাম এলাকাবাসীও ঘটনাটি খুব ভালভাবে নিয়েছে। উপজেলা কমপ্লেক্সের ইমাম সাহেব তো আমার সাথে আলাপে এটাই বললেন যে, সংখ্যালঘুদের নির্বিঘ্ন ধর্মপালনের সুযোগ করে দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে মুসলমানদের উপরে। আমারও মনে হয়েছে, আমি আমার ধর্মত কাজই করেছি।

সেই বৃহত্তর সিলেটের লোককবি শাহ আবদুল করিমের গান এ-লেখার শিরোনাম ও শুরুতে ব্যবহার করেছি। সেই গানেই এক জায়গায় রয়েছে, ‘দিন হতে দিন আসে যে কঠিন’। কথাটা সত্যিই হবে! নানাসূত্রে যেসব সংবাদ পাই, তাতে মনে হয়, এ শুধু আমার বাংলাদেশ নয়, বর্তমান বিশ্বেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই অভাজনের যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আমার যে জীবনবৃত্ত, আমার বন্ধুমহল বা কর্মক্ষেত্রের যা ঘটনাবলি, তা কিন্তু এখনও অনেকটা আগের মতোই। এমনকী আমার কিশোর সন্তানের জীবনও সেইরূপ অকঠিন থেকে সরল-তরলধারায় চলছে বলে দেখছি-জানছি। আমার বিধর্মী বন্ধু-সহকর্মীদের সাথে আমার কখনো কোনো বিবাদ-বিসম্বাদ যে হয়নি তা বলবো না। কিন্তু বলতে চাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘বিবাদ যদি কখনও বাঁধে সে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিবাদ, মিটিয়াও যায় অল্পেই। কুবেরের সাথে সিধুর যে কারণে বিবাদ হয়, আমিনুদ্দির সঙ্গে জহরের যে কারণে বিবাদ হয়, কুবের-আমিনুদ্দির বিবাদও হয় সেই কারণেই (পদ্মানদীর মাঝি)’। মানে ধর্মকে বিষয় করে বিবাদ-বিদ্বেষ-বিভক্তির কথা আমার কাছে আজন্ম অবান্তর-অগ্রহণযোগ্য এবং তা যুক্তি বা মানবিকতার বিচারেই শুধু নয়, ধর্মের বিচারেও বটে। এই শিক্ষাই আমার সন্তানদের দিয়ে থাকি। তারাও সেভাবেই বেড়ে উঠছে।

কাজেই আশা হারাচ্ছি না। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে অনেকেই ক্যান্সারের সাথে তুলনা করেন। ক্যান্সারে দুষ্ট কোষ ভাল কোষকে আক্রান্ত করে, কোষান্তরে ছড়িয়ে পুরো দেহকেই ব্যাধিগ্রস্ত করে। কিন্তু মানবদেহের সাথে সমাজদেহের একটু পার্থক্য রয়েছে। কর্কটরোগের বিপরীত ক্রিয়াও ঘটতে পারে সমাজদেহে। অর্থাৎ ইতি পারে নেতিকে দূর করতে। ছোট জায়গা থেকে শুরু করলেও চলে। ব্যক্তি-সংসার তো রাষ্ট্র-সমাজের অন্তর্গত এক একটি কোষের মতো। সেখান থেকে যদি ভাল কিছু শুরু হয়, তবে তা রাষ্ট্র-সমাজেও বিস্তৃত হতে পারে। নিশিদিন এই ভরসাতেই আছি, হবেই হবে।

লেখক: শিক্ষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম মত-দ্বিমত মাসুদ রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর