সমাজ, অপরাধ ও সাংবাদিকতা
৮ নভেম্বর ২০২১ ১৭:৩৯
বাঁচার প্রয়োজনে মানুষকে লড়াই করতে হয়। সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতার বুক থেকে ছিড়ে আনতে হয় বাঁচার আলো। নিজের জন্য, সমাজের জন্য এমনকি রাষ্ট্রের গতিশীল গাঁথুনির জন্য। চলমান সমাজ, মানুষ ও উত্তর আধুনিক সভ্যতার চাকা মানুষ বহুদিনের সংগ্রাম ও পরিবর্তিত হওয়ার ইচ্ছা থেকে তৈরি করেছে। তৈরি করেছে স্বপ্নের ভিত যেখানে কর্ম ও ইচ্ছাপ্রবাহ অবিরাম খেলা করে। পিছিয়ে থাকা যাবে না, এগিয়ে যেতে হবে। অন্ধকার থেকে আলো ছিনিয়ে আনতে। আনতে হবে হাসিমাখা বলয় আর পরিবর্তনের জ্ঞানগত আকর্ষণ।
একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ কিংবা পরিশীলিত মানুষের প্রত্যাশা পৃথিবীর চারপাশকে করেছে আরো গতিময়। মানুষ কাজের মাধ্যমে জেনেছে, প্রকাশ করেছে ও পরিবর্তনের মিছিলে সফেদ পোশাকে শামিল হওয়ার আহবানে সরবে বা নীরবে ডেকেছে মানুষকে। মানুষের জন্য মানুষের চিন্তার শেষ নেই। সেটি ভালোর জন্য হোক কিংবা মন্দের জন্য হোক। অথবা মুক্তির স্বাধীনতা দিতে হোক বা নিয়ন্ত্রণের সংগীত রচনার জন্য হোক। এ ভাবনা চলছে ও চলবে। যতদিন মানুষ নিজেকে দেখে অন্যের চোখের মণিতে, কখনো দেখে ফ্যাকাশে কখনো রক্তিম লাল। যেন জবাফুলের একরাশ আগমন। নিতে না চাইলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
মানুষ কাজের মধ্য দিয়ে নিজের যোগ্যতার পরিচয় সমাজের সামনে তুলে ধরে। কাজের ভিন্নতা ও অতি সূক্ষ্মতার বৈশিষ্ট্য নির্মাণের লক্ষ্যে পেশাগত অবয়ব সমাদৃত। ঘটনার মধ্য দিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রকে চেনে মানুষ। কাছে বা দূরে অবস্থান করে মানুষের। এই ঘটনার সঠিক বাতায়ন মানুষ বা সমাজের কাছে তুলে ধরে সাংবাদিকতা নামক বহুমুখী পেশা। যা সর্বদা নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সয়ে সামনের দিকে চলে। অপরাধ সাংবাদিকতা সমাজে কিংবা মানুষের জীবনে সংঘটিত নানামুখী অপরাধ, অপরাধে সম্পৃক্ততা ও সমাজ-সংস্কৃতিভেদে অপরাধের চলমান প্রবাহ সত্যের কঠিন আগুনে ছেঁকে হাজির করে মানুষের সামনে। অক্ষর আর শব্দের মিছিলে তা কখনো আগুন ধরিয়ে দেয় মনের গহীনে। পরিবর্তনের জন্য কৌশল পাল্টায় নীতি-নির্ধারণী পর্যায়। আবার ক্ষিপ্ত হয় অপরাধী, দিতে চায় প্রতিশোধের রক্তিম শুভেচ্ছা। সাংবাদিককে যেতে হয় হাসপাতালের শীতল বিছানায়। কখনো পুরষ্কারও জোটে। সমাজটাই যদি অপরাধী হয় তবে অপরাধ হয়ে যায় সংস্কৃতি বা উৎসবের আয়োজনে এক ধাপ এগিয়ে মনুষ্যত্ববিহীন এক জাগরণ। এরূপ সমাজের মধ্যে প্রত্যাশিত পরিবর্তন বা সমৃদ্ধির ছোঁয়া লাগুক অপরাধ সাংবাদিকতা এই লক্ষ্য নিয়ে স্বপ্নের বাজারে ঘুম বিক্রি করে। কখনো সফল হয়। আবার কখনও প্রাপ্তি ঘটে অভিজ্ঞতার মিশ্রানুভূতি। সমাজের কাছে ভরসা বা আশ্বাসের জায়গায় অবস্থান করে অপরাধ সাংবাদিকরা। আর এদের মধ্যে যারা মাতোয়ারা হয় নীতি-বহির্ভূত উপায়ে সম্পদ ও ক্ষমতার মালিক হতে, তারা নগ্ন হয় নীতির কাছে, পোশাক খুলে দাঁড়ায় সমাজের শরীরে, গভীর অন্ধকারে। কেউ দেখে না!
সাংবাদিকতার একনিষ্ঠতার অক্ষরে মানুষের নির্ভরশীলতার শব্দ নির্মাণ হয়। মানুষ আশ্রয়ের প্রলেপে বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর ভর করে সম্পর্কের বন্ধন এগিয়ে নেয়। সামনের দিকে অথবা সম্পর্কের স্বাভাবিকতা বন্ধ করে দেয়। হতে পারে সাময়িক, হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী। মানুষ বিশ্বাস করে কেউ পথ দেখাবে, কেউ বলবে সত্যের গল্প। ঘুম ভাঙ্গাবে মানুষের, শুদ্ধ হবে মনন আর ক্রিয়াশীল হবে চলন। সমাজের ভিতরে জমে থাকা আবর্জনা দূরীকরণে নীতিসিদ্ধ কায়দায় মানুষকে দাঁড় করায় মানুষের পাশে। অপরাধ সাংবাদিকতা বা সাংবাদিকরা শত ঝুঁকি নিয়ে খবর প্রকাশে আপস করেন না। যারা করেন তারা বুক পকেটে বোমা নিয়ে বেঁচে থাকা বা খ্যাতি পাওয়ার অভিষেকে চলেন এ ঘর থেকে অন্য ঘরে। বসেন এ ঘরের দুয়ারে, পান করেন অন্য ঘরের বাসনে। কোথাও স্বস্তি নেই, নেই শান্তির শৃঙ্খলা। কিংবা খুঁজে পান না পেশার অন্তর্নিহিত মর্যাদা ও শুভবোধের উপলব্ধি। যা বাঁচায় বাঁচার মতো, শব্দের তেজস্বী দাপটে কিংবা অহংকারের মুক্তায় ঝড়ে পড়ে একরাশ সোনালী সকাল, রোদ ঝলমলে সূর্যের হাসি।
সমাজে শৃঙ্খলা বা নৈরাজ্যহীন জীবনের স্লোগানের কথা যতই বাজুক না কেন একদল মানুষ অপরাধের ওপর ভরসা করেই বাঁচতে চায়। গড়তে চায় জীবন সম্পৃক্ত উপকরণের অঢেল আয়োজন। অপরাধ সাংবাদিকতা এই সকল আয়োজনের খবর জানিয়ে দেয়। সতর্ক করে মানুষকে। আইন-শৃঙ্খলার শক্ত কথন প্রয়োগে রাষ্ট্রকে জাগিয়ে তোলে। সমাজের মধ্যে যদি পচন দীর্ঘ সময় ধরে চলে তবে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। পারে না পরিবর্তনের নকশা তৈরি করতে।
বর্তমান পৃথিবীতে সম্পদ, ক্ষমতা, আভিজাত্য বা আমিত্বের লড়াই বিভিন্নরূপে দখল করছে মানুষকে। অথচ জন্মগত ভাবধারায় মানুষ হলো প্রকৃতির সহজাত ফসল। যেখানে পরস্পর সৌজন্য কিংবা সম্প্রীতির উর্বর অনুশীলন থাকবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেক মানুষ প্রকৃতিবান্ধব এ প্রত্যয় থেকে দূরে সরে গিয়েছে। এদেরকে সঠিক পথে রাখা, এদের মূল্যবোধ ও আইনবর্হিভূত কর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সকলের দায়িত্ব। তবে সবাই সেই ভরসা বা সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে না বা সুযোগ থাকে না।
অপরাধ সাংবাদিকতা মানুষকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দেয় রীতিভঙ্গের আচরণ কাঠামো। অনুসন্ধানের তীর্যক প্রয়োগে দখলে নেয় মানুষের আস্থার নীতিমালা। সমাজের মধ্যকার দুর্নীতি, সমাজরীতি উপেক্ষা করে নৈরাজ্য সৃষ্টির পায়তারা, দখল বাণিজ্যের প্রাথমিক স্বরলিপি, প্রান্তিক মানুষের সহায়-সম্বল হাতিয়ে নেয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় অপরাধ সাংবাদিকতা। একটি লক্ষ্য অথবা পাথেয় নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বাতাসা সর্বোচ্চ মিষ্টান্ন ভেবে ছড়িয়ে দেয় মানুষের চিন্তার আঁতুড়ঘরে। মানুষ বাঁচার প্রয়োজনে মানুষকে খামচে ধরে নিরন্তর। তুমুল বৃষ্টিতেও আশা করে কেউ এগিয়ে আসবে, নিয়ে যাবে সতর্ক পাহারায়। সবসময়, সবযুগে মানুষ আশায় থেকেছে মানুষের। এ প্রত্যাশা অমূলক নয়, এ চাহিদা যুগের কারণে রং পাল্টালেও মানুষের শরীরে এখনো মানুষেরই গন্ধ।
অপরাধ সাংবাদিকতা সমাজের কাঙ্খিত পরিবর্তনে ভূমিকা রেখে চলছে। সমাজে নীতিভ্রষ্ট মানুষের কর্মকাণ্ড প্রকাশ করে আইনের আত্ততায় এনে বিচারের মুখোমুখি করে এবং সৃষ্টি হয় জবাবদিহিতার সংস্কৃতি। সৃষ্টি হয় কর্মের স্বচ্ছতাবোধ ও পরিপূর্ণ সামগ্রিকতা। সমাজের প্রত্যাশিত পরিবর্তনের জন্য মানুষকে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে ও সতর্ক ভূমিকা পালনের পরিবেশ নিশ্চিতকরণে অপরাধ সাংবাদিকতা নীতিনিষ্ঠ ন্যায়পরায়ণতার সংস্কৃতি বজায় রাখে। সমাজের পরিবর্তন ও মানুষের উন্নয়নে অপরাধ সাংবাদিকতা অপরাধ ও সমস্যাগুচ্ছ প্রকাশ করে সমৃদ্ধির যাত্রাকে এগিয়ে রাখে। আর সমাজে এ ভূমিকা কাঙ্খিত ও বহুল প্রত্যাশিত।
লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই