তোমার পতাকা যারে দাও
১২ নভেম্বর ২০২১ ১৮:৫৭
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যেদিন দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হলেন, সেদিন আইনমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় বললেন—দিনটি সুখকর নয়। এ দুর্ভাগা দেশে মন্ত্রী হিসেবে আমরা খুব কমই সঠিক মানুষটিকে সঠিক মন্ত্রণালয়ে পেয়েছি। আমরা খুব কমই একজন কৃষিবিদকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে বা একজন চিকিৎসককে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পেয়েছি।
তবে প্রায় সব সরকারের আমলে আমরা প্রথিতযশা আইনজীবীদের আইন মন্ত্রণালয়ে পেয়েছি। এবং তাদের মধ্যেও বর্তমান আইনমন্ত্রী স্বীয় প্রতিভায় সমুজ্জ্বল—একথা বোধকরি দলমত নির্বিশেষে সবাই মানবেন। কাজেই প্রথিতযশা আইনজীবীর পুত্র মাননীয় আইনমন্ত্রী (কথাটি এ কারণে বলা যে আইনজীবী হিসেবে দু’পুরুষের অভিজ্ঞতা তার) যে দেশের বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ব্যক্তির নৈতিক স্খলনে দুঃখিত হবেন তা বলাই বাহুল্য।
বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি কে? আইনের শাসনে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বলে কি কেউ আছেন আদৌ—নাকি এরকম ক্ষমতাধর ব্যক্তি থাকা সম্ভব? কৃষি মন্ত্রণালয়ে কৃষি মন্ত্রীর পরে ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্স অনুসারে কৃষি সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং ক্রমানুসারে পরবর্তী কর্মকর্তাগণ। এখানে মন্ত্রীর নির্দেশনায় সচিব এবং সচিবের নির্দেশনায় পরবর্তী কর্মকর্তাগণ কাজ করেন। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ে ব্যাপারটি তা নয়। এখানে প্রত্যেক বিচারিক কর্মকর্তা স্বাধীন। একজন জেলা জজ বা একজন ট্রাইব্যুনালের বিচারক কোন মামলায় কী রায় দেবেন সেটি একান্তই তার এখতিয়ার এবং স্বয়ং প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা মহামান্য রাষ্ট্রপতিও তাকে মামলার রায় নিয়ে কোনো নির্দেশ দিতে পারেন না।
একজন বিচারক তথ্য, প্রমাণ, সাক্ষ্য এবং আদালতের কার্যবিধি মেনে কোনো মামলার রায় দেবেন। তার এ রায়ের সঙ্গে আরেকজনের বা পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের রায়ের মিল নাও থাকতে পারে। এদেশের আইন বিষয়ে আরেক কৃতবিদ্য প্রবাদপুরুষ প্রয়াত গাজী শামসুর রহমান তার আদালত জীবনের স্মৃতিকথায় এ রকম বহু মামলার কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে খারিজ হয়েছে বা পরিবর্তিত হয়েছে।
কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই উচ্চ আদালতের বিচারক নিম্ন আদালতের বিচারককে তিরস্কার করেননি। ঘটনার পরম্পরা বা বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গি একই মামলায় একই সাক্ষ্যপ্রমাণে অন্য রকম রায়ও হতে পারে। কিন্তু যা হতে পারে না তা হলো আইনের ধারণা, পরিধি বা কার্যবিধির বাইরে গিয়ে কোনো রায়। যদি তা হয় তবে উচ্চতর আদালতে আপিল হলে নিম্ন আদালতের বিচারক স্বীয় অবস্থানে অনড় থাকতে পারেন না। তাকে আবার তখন মাফ চাইতে হয়। বিচার ব্যবস্থার জন্য এ রকম রায় অত্যন্ত লজ্জার। ঠিক যেমনটি ঘটেছে কয়েক দিন আগে পরীমনির রিমান্ডের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে মামলায়। দুজন বিচারক আদালতে মাফ চেয়েছেন। কিন্তু কেন তারা মাফ চাইবেন? যে রায় তারা দিয়েছেন তা কি তারা নিজেরা বিশ্বাস করতেন না? যদি করেন তবে তাদের মাফ চাওয়ার প্রয়োজন নেই, বরং বলতে পারেন এই এই অপরাধে আমরা পরীমনির রিমান্ড আদেশ দিয়েছি। আর যদি তা বলার মতো কিছু তাদের না থাকে, তবে সেই দিনটিও এদেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য সুখকর ছিল না। তাদের হাজার বার মাফ চাওয়াও একটি মেয়ের জীবন থেকে রিমান্ডে কাটানো কয়েক দিন ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
সাম্প্রতিক আলোচিত রেইনট্রি মামলায় নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয়। এ পর্যবেক্ষণ হাইকোর্টের আগের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। হাইকোর্ট যেখানে নির্দেশ দেয় ধর্ষণের ক্ষেত্রে পুলিশ দ্রুত মামলা নেবে, সেখানে এ পর্যবেক্ষণ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এ দ্বিধায় ফেলে দেয় ।
আইনমন্ত্রীর কথাতেই ফিরে আসি। যেদিন প্রিয়জন মারা যায় সেদিন সুখকর নয়। কিন্তু যেদিন সে প্রিয়জনের দুরারোগ্য ব্যাধি ধরা পড়ে সেদিনও সুখকর নয়। চিকিৎসা সেদিন থেকেই শুরু করা দরকার। নতুবা—পতাকা যাদের বহিবার কথা তাদের সে বহিবার শক্তি থাকবে না।’
সারাবাংলা/আইই