চীনের ‘ফাঁদ’ অথবা শেখ হাসিনার কৌশল!
১৮ নভেম্বর ২০২১ ২১:৩৫
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীন অর্থায়ন করবে বলে সমঝোতা ও চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম— ‘আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত মিটার গেজ লাইনকে মিশ্র গেজে রূপান্তর’ এবং গাজীপুরের ‘জয়দেবপুর থেকে পাবনার ঈশ্বরদী পর্যন্ত মিশ্র গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ’। দুই সরকারের সমঝোতায় (জি-টু-জি) এই ঋণচুক্তির অন্যতম শর্ত ‘উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া যাবে না’। কারণ রেল প্রকল্প দু’টির ব্যয়ের মধ্যে নির্মাণ ক্ষেত্রের অধিকাংশ ব্যয় চীন সরকার নির্বাহ (ঋণ হিসেবে) করার কথা। তাই চীনের সরকারি অর্থায়নে অন্য দেশের ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই।
‘আখাউড়া-সিলেট মিটার গেজ লাইনকে মিশ্র গেজে রূপান্তর’ এবং ‘জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী মিশ্র গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ’— এই দুই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। গত বছর তথা ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকল্পের খরচ পুনঃপ্রাক্কলন/পুনঃনিরীক্ষার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত বছরের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকল্পে বাড়তি ব্যয় ধরার তথ্য উঠে আসে।
চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ব্যয় কমানোর বিষয়ে চীন সরকারকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে চিঠি দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এরপর চীন নিজেই স্বাধীন সংস্থা দিয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্য খরচ মূল্যায়ন করে ব্যয় বেশি ধরার বিষয়টি জানায়। ওই মূল্যায়নে প্রকল্পটি লাভজনক হবে না বলে উল্লেখ করে তারা। এই পরিপ্রেক্ষিতে রেলওয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে চীন সরকারের নিয়োগ করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্যয় কমালে কাজ করবে না বলে ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু বিষয়টি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ‘চীন সরকার এই প্রকল্পে অর্থায়ন না করে সরে যাচ্ছে’ বলে প্রচার পায় (যদিও চীন সরকার এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি!)।
বিষয়টি কি আদৌ তাই?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রকল্পের খরচ পুনঃপ্রাক্কলন করতে বলেছেন। সাধারণত কোনো দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান এটি করতে বলেন না। এর আগে এ ধরনের একটি ঘটনাই আছে ইতিহাসে। মালয়েশিয়ার সাবেক সরকারপ্রধান মাহথীর মোহাম্মদ নিজ দেশের একটি উন্নয়ন প্রকল্পের (রেলওয়ের) ক্ষেত্রে বলেছিলেন— চলমান প্রকল্পের বাজেট পুনঃনিরীক্ষা করা হোক। নিরীক্ষা শেষে ‘We can not afford it’ বলে প্রকল্প থেকে ১৭৭ কোটি রিংগিত (মালয়েশিয়ান মুদ্রা) খরচ কমিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ রেলওয়ের এই উন্নয়ন প্রকল্পে ‘বেশি বা কম’ খরচ হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে কিছুই বলেননি। শুধু বলেছেন— প্রকল্প বাজেট পুনঃপ্রাক্কলন করে দেখা হোক। একজন সরকারপ্রধান যখন নিজ থেকে প্রকল্প বাজেট পুনঃপ্রাক্কলনের নির্দেশ দেন, তখন বুঝতে হবে অবশ্যই অন্তর্নিহিত কোনো কারণ রয়েছে। এমনি এমনি তো আর সরকারপ্রধান এ কথা বলছেন না! এখন প্রশ্নটা হলো— সেই কারণটি কী?
প্রতিবেশী অন্যান্য অনেক দেশের (যেমন— শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ মধ্য-এশিয়া) চেয়ে বাংলাদেশের কাছে ডলারের শক্তিশালী রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা কিছু টাকা বেশি খরচ হওয়াকে আটকাতে চাইছেন কেন? একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন, এখানে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ‘ক্ষতি’ ঠেকিয়ে ‘লাভ’কে অগ্রাধিকার দিতে চাইছেন। ‘বাংলাদেশের লাভ’ অগ্রাধিকারে প্রথম রাখা সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা আরেকটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রাখতে চলেছেন। এখন বিরোধী দল বা অন্য কেউ যদি আঙুল উঁচিয়ে বলার চেষ্টা করে— ‘শেখ হাসিনা কি এই উন্নয়ন কাজটি করবেন না?’ এর উত্তর সহজ— নিজেদের কাছেও এই কাজটি করার মতো যথেষ্ট অর্থ রয়েছে।
আমরা অনেক পত্রিকা ও গবেষণাপত্রে বিভিন্ন সময় ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ সম্পর্কে পড়েছি। বিভিন্ন মাধ্যম মারফত বা আড্ডা-আলোচনাতেও শুনেছি। এই যে ‘ঋণের ফাঁদ’— আদৌ এরকম কিছু রয়েছে কি না, সে বিতর্কে যাচ্ছি না। অথবা কোনো দেশ এই ফাঁদে পড়েছে কি না, সেটিও বলছি না। কারণ অন্যান্য দেশের বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই (যদিও শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান এই ‘ফাঁদে’ পড়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি আছে)। আমাদের কৌশল ও উদ্দেশ্য থাকতে হবে— ‘ঋণের ফাঁদ’ থাকুক বা না থাকুক, বাংলাদেশকে যেন আমরা এই কথিত ফাঁদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে বা রক্ষা করতে পারি। আবারও বলছি— এ ধরনের কোনো ‘ফাঁদ’ আছে কি না, তা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। যদি ‘ঋণের ফাঁদ’ বলতে কিছু থেকেও থাকে তাহলেও বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের সর্বপ্রথম দায়িত্ব এই ‘ফাঁদে’ বাংলাদেশ যেন না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখা এবং কথিত ফাঁদ থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করা। মূলত এখানেই শেখ হাসিনা সুচারুভাবে দায়িত্বটি পালন করেছেন। এর আগে অনেক সরকারের ক্ষেত্রে ও আমলে আমরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাফকো কিংবা বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের মতো অনেক ঘটনা দেখেছি, যেখানে অনেক ক্ষেত্রে তৎকালীন সরকারগুলো রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় সম্পদ বন্ধক পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিল।
এই দুই রেললাইন প্রকল্পের বাজেট পুনঃপ্রাক্কলন করতে বলার কারণে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, এমনটিও নয়। চীন যেটি করে— সরকার-টু-সরকার (জি-টু-জি) ঋণ দেওয়ার সময় তারা উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করতে দেয় না। এর ফলে যেটি ঘটে— চীন সরকারের নিয়োগ দেওয়া কোম্পানিগুলো (ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) নিজেদের ইচ্ছামতো প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম বাড়তি নির্ধারণ করে। অনেক সময় এই বাড়তি দাম না ধরলেও এসব কোম্পানি ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’র ব্যয় মর্জিমাফিক নির্ধারণ করে বা অতিপ্রাকৃত দাম ধরে।
শেখ হাসিনা ঠিক এই জায়গাটিতেই এসে বললেন, ‘এই প্রকল্পের বাজেট পুনর্মূল্যায়ন করে দেখা হোক।’ শেখ হাসিনা যখন পুনর্মূল্যায়নের কথা বললেন, তখনই এই প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত চীনা ঠিকাদারি কর্তৃপক্ষ ধানাইপানাই শুরু করেছে বা তারা এই প্রকল্পের কাজ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে!
পয়েন্ট বা ইস্যুটা এখানেই। তাহলে চীনা কোম্পানি বা কর্তৃপক্ষ আগে কেন এ কাজটি করতে আগ্রহী ছিল বা কীসের ভিত্তিতে রেলওয়ের উন্নয়ন কাজটি করতে আগ্রহ দেখিয়েছিল— এই প্রশ্নটিই সামনে চলে আসে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এই কাজটিতে একটি ঝুঁকি উঁকি দিচ্ছিল। চীনের ঋণ নিয়ে কাজটি করতে অতিরিক্ত অনেক খরচ পড়ে যেত। অতিরিক্ত ব্যয় বহন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর (এই) অতিরিক্ত খরচের ফলে ঋণটি যদি আমরা যথাসময়ে শোধ করতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশের জন্যও প্রকল্প ব্যয়ের ঋণটি পরিণত হতো ‘ঋণের ফাঁদে’।
সম্ভাবনার খাতিরে ধরেই নিলাম, ব্যয় কমানোর অজুহাতে চীন সরকারের নিয়োগ করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ না করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং পুনঃপ্রাক্কলিত বাজেটে এই প্রকল্পে কাজ করতে আগ্রহী অন্য কোনো চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও আনা যায়নি; এবং এই বাহানাতেই চীন সরকারও প্রকল্পে অর্থায়ন করতে অপারগতা জানিয়েছে। কিন্তু চীন সরে গেলে বাংলাদেশের যে বিকল্প নেই, তাও কিন্তু নয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভারত খুবই ভালো বন্ধু। তাছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়েতে অর্থায়নে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ’ বিকল্প হিসেবে (যদি চীন শেষ পর্যন্ত প্রকল্প থেকে সরে যায়) জাপান বা জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা জাইকা, দক্ষিণ কোরিয়া, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ইত্যাদি দেশ ও সংস্থাকে এই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য আহ্বান জানাতে পারে। এসব দেশ ও সংস্থা অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে আসছে। এদের অর্থায়নে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করার অন্যতম সুবিধা হচ্ছে— প্রকল্পের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে সবদিক বিবেচনায় মান ঠিক রেখে সর্বনিম্ন দরদাতাকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের ফলে দেশ ও প্রতিষ্ঠানভেদে সবাই অংশ নিতে পারে বলে দরপত্র দেওয়া প্রতিষ্ঠান জাপানের হতে পারে, হতে পারে প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণ কোরিয়া বা ফ্রান্স বা ইতালির, হতে পারে ভারত বা খোদ চীনের। প্রতিযোগিতা থাকায় এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে যোগ্যতর প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া সহজ ও সম্ভব হয়। এতে করে প্রকল্প ব্যয় কমে আসে, কাজের মানও ভালো হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে জাপান এ ধরনের বহু দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কটা কৌশলগত। বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে যথাসময়ে ফেরত দিতে পারাটাই পরীক্ষিত বন্ধুত্বের উদাহরণ। এই পরীক্ষায় বাংলাদেশ উত্তীর্ণও। অন্যদিকে, চীন ও বাংলাদেশের জনগণের রক্ত পানি করা শ্রমের টাকাটাও শেখ হাসিনা অপচয় করতে দিচ্ছেন না এখানে। যদি খরচ করতেই হয়, তবে ন্যায্য পরিমাণ অর্থই খরচ করা হবে উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে। রেলওয়ের প্রকল্প দু’টির বাজেট পুনঃপ্রাক্কলন করার নির্দেশনার ফলে মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অন্যায্য আয়ের পথটিই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এর চেয়ে বেশি কিছু না!
বর্তমান পৃথিবী আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি বিশাল পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উন্নত অনেক দেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুত করা শুরু করেছে ভবিষ্যতে একটি সংকটময় সময় আসতে পারে— এই আশঙ্কাকে আমলে নিয়ে। এমন সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত অর্থ অযৌক্তিকভাবে খরচ করে ফেলবে— তা তো হয় না। এখানেই শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা। এই দুই রেল প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে প্রকল্পের খরচ পুনঃমূল্যায়ন করতে বলাটাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। কারণ, বাংলাদেশের প্রতি রয়েছে শেখ হাসিনার অকৃত্রিম মায়া, জনগণের জন্য রয়েছে নিখাদ মমতা। সবচেয়ে বড় কথা— শেখ হাসিনা কর্মে পুরোদস্তুর পেশাদার এবং খাঁটি একজন দেশপ্রেমিক।
লেখক: রাজনীতিবিদ ও গবেষক
তথ্যসূত্র:
১. 可惜!孟加拉近两百亿铁路大单未成功获得中国资金:
https://bit.ly/3x6q7dN
২. ‘চীন সরে গেলে বিকল্প কে’
কালের কণ্ঠ: https://bit.ly/3CysHua
৩.Mahathir: Malaysia Saves Billions in Renegotiated Railway Deal with China
rfa: https://bit.ly/3ozkXTO
৪. Malaysia-Singapore Rail Link Back on at Lower Cost: Mahathir
The Irrawaddy: https://bit.ly/3FrTrhY
৫. ‘রেল প্রকল্প থেকে সরে যাচ্ছে চীন, এগিয়ে এসেছে ভারত’
The Business Standard News: https://bit.ly/3qQ24Pk
সারাবাংলা/টিআর
কৌশলগত সম্পর্ক চীনের ঋণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক মুজাহিদুল হক সৌরভ রেলওয়ের উন্নয়ন রেলের দুই প্রকল্প