Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সারাবাংলা হোক সংবাদমাধ্যম জগতের শুকতারা

রফিকুল ইসলাম
৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৭:৫৫

আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন।/ অলক্ষণের তিলক-রেখা/ রাতের ভালে হোক-না লেখা—/ জাগিয়ে দে রে চমক মেরে/ আছে যারা অর্ধচেতন।

এমনি বজ্র পঙ্ক্তিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ধূমকেতু’র বিদ্রোহী সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামকে জানিয়েছিলেন পথচলার সংগ্রামী শুভেচ্ছা, যা পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে উৎকীর্ণ থাকত। এক্ষেত্রে অনলাইন নিউজ পোর্টালটির একজন কলামিস্ট ও লেখক হিসেবে নয়, একনিষ্ঠ পাঠক হয়ে সারাবাংলা’কে আগামীর নির্ভীক পথচলার প্রশ্নে বলব— মিথ্যার বেড়াজাল ভেঙে সত্যের সন্ধিতে এগোও বহুদূর।

মুজিব জন্মশতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতীয় সত্তা মহান বিজয় দিবসের লাল-সবুজের মহোৎসবের মহিমান্তিত লগ্নে পোর্টালটির চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে স্বাগত এবং পঞ্চম বর্ষে পদার্পণের আনন্দক্ষণে পত্রিকাটির চেয়ারম্যান, প্রকাশক, সম্পাদক, সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই লাল-সবুজের বিজয়ী শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

পত্রিকাটির জয়েন্ট নিউজ এডিটর কবীর আলমগীর এ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে লিখেই দিয়েছেন, ‘দুর্বার’ তাদের লক্ষ্য। সংবাদ প্রকাশে দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য কোনো শক্তির বশবর্তী নয় তারা। এখানে নেই কারও কোনো হস্তক্ষেপ। সংবাদ প্রকাশে ‘সবার আগে সব খবর নয়’, বরং খবরের বস্তুনিষ্ঠতা, তথ্য যাচাই, সঠিক ও নির্ভুল তথ্য দেওয়ায় লক্ষ্য। সংবাদ প্রকাশের নামে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি কিংবা উসকানি দেওয়া তাদের লক্ষ্য নয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উর্বর মানবজমিনে কৃষক হয়ে ন্যায্যতার ফসল ঘরে তুলতে চায় ‘সারাবাংলা’।

ধীমান পাঠক হিসেবেও নিরীক্ষণ করে দেখেছি, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ‘কালোকে কালো আর সাদাকে সাদা’ বলার দৃঢ়প্রত্যয় এবং গণমানুষের প্রত্যাশাকে ধারণ করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকের ভালোবাসায় ধন্য হয়ে উঠেছে ‘সারাবাংলা’।

এছাড়া মুক্তিমন্ত্রের কবি, স্বাধীনতার স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন, কর্ম ও গভীর আত্মত্যাগ এবং ৩০ লাখ শহিদ ও দুই লাখ মা-বোনের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে শক্তিশালী অবস্থানের মাধ্যমে সমৃদ্ধ চেতনাকে ঋদ্ধ করতে অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে ‘সারাবাংলা’।

শুধু তাই নয়, বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ও গণতন্ত্রের জয়যাত্রায় অবদান রেখে চলা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে জনসচেতনতা তৈরিতে সারাবাংলার দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা খুবই প্রশংসনীয়। পোর্টালটি রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি তথা জনমানুষের কল্যাণে অবদান রাখায় এরই মধ্যে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের মধ্য দিয়ে পাঠকের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। সৃজনশীল, আধুনিক ও উদার গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের চর্চাকে গুরুত্ব দেওয়ায় চার বছরের চারা গাছটি শেকড় মেলে আজ পোক্ত বটবৃক্ষ ‘সারাবাংলা’।

“…এ দেশের নাড়িতে নাড়িতে অস্থিমজ্জায় যে পচন ধরেছে, তাতে এর একেবারে ধ্বংস না হলে নতুন জাত গড়ে উঠবে না। … দেশের যারা শত্রু, যা কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামি, মেকি ইত্যাকার দূর করতে ‘ধূমকেতু’ হবে আগুনের সম্মার্জনী।”— এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট প্রকাশিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি উপমহাদেশীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে স্বরাজের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে সূচনা করেছিল অগ্নিযুগের। তেমনি ‘সারাবাংলা সারাক্ষণ’ স্লোগানে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের প্রত্যয় নিয়ে ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করেছিল অনলাইন পোর্টালটি। এর নীতি হোক সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনসেবা, উন্নয়ন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা এবং অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সত্য ও স্বাধীনতার পক্ষে জনগণকে সচেতন করে তোলা। এর জন্য আবশ্যক মা মাটি ও মানুষের বৃহত্তর কল্যাণে কলম ধরা। এছাড়া উপলব্ধিতে গণ্য হোক, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

১৯২০ সালে কবি নজরুল ছিলেন ‘সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাজনৈতিক নেতা কমরেড মোজাফফর আহমদ ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকও। সারাবাংলার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক) এবং বদরুল আলম খান। তারা নিশ্চয়ই চিনির ভালোবাসায় না মজে নুনের ভালোবাসায় সিক্ত হবেন। কেননা নুন তিক্ত হলেও ভাইরাস তাড়াই আর মিঠা কাছে ভিড়াই।

যে বস্তুর নাম সংবাদপত্র বা নিউজ পোর্টাল, তা কী জিনিস তা নামই বলে দেয়। কিন্তু আধুনিক সংবাদপত্র বা নিউজ পোর্টাল ঘটিত বা সংঘটিত বিষয়ের বিবরণই শুধু পরিবেশন করে না, তার ভূমিকা বিশাল ও বিচিত্র। সংবাদ পরিবেশন এখন আংশিক কাজ। তার বাইরেই তার কাজের বিস্তৃতি বেশি। নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষই বেশি। জীবন ও জগতের সবকিছুই তার উপজীব্য। জীবনের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো গুরুতর বিষয়ের দার্শনিক ভিত্তি যদি শক্ত না হয়, তাহলে তা দিয়ে মানুষের কল্যাণ হয় না। সংবাদমাধ্যমেরও দর্শন রয়েছে এবং রয়েছে সাংবাদিকতার নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি।

কী পশ্চিম ইউরোপে, কী ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের উদ্ভব ও বিকাশ সপ্তদশ থেকে উনিশ শতকের মধ্যে, সামন্তবাদী সমাজে। সমাজের একটি বড় অংশ বিদ্যমান অবস্থা মেনে নিয়ে চলতেই অভ্যস্ত। কিন্তু সমাজের প্রগতিকামী অংশ অর্থাৎ অগ্রসর অংশ বিদ্যমান অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন চায়। কায়েমি স্বার্থকে আঘাত করা সংবাদমাধ্যমের এখন একটি বড় দায়িত্ব। কায়েমি স্বার্থ সংঘবদ্ধ, সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিককে লড়তে হয় একা। নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে তার সঙ্গী না থাকলেও সমর্থক অজস্র। সেটিই সংবাদমাধ্যমের শক্তি। যে সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের নৈতিক অবস্থান বা দার্শনিক ভিত্তি শক্ত, জনকল্যাণে সেই সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

ঔপনিবেশিক সময়ে সংবাদমাধ্যমকে লড়তে হয়েছে স্বাধীনতার জন্য বা রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। সামন্তবাদী সমাজে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তাহলে কি স্বাধীন দেশের সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের কাজ কমে গেছে? না, তা মোটেও নয়, বরং বেড়েছে।

একটি সমাজ গঠনে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিককে এখন বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করতে হয়। রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তির মানবিক অধিকারের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়, রাষ্ট্রের উপাদানই তা নির্দেশ করে। একদিকে সর্বশক্তির অধিকারী রাষ্ট্র, অন্যদিকে একজন সহায়সম্বলহীন দুর্বল মানুষ। সেই দুর্বলের অধিকার যখন হরণ করে রাষ্ট্র, তার পাশে দাঁড়ায় সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যমকে লড়াই করতে হয় সবচেয়ে শক্তিধরের সঙ্গে। সাংবাদিকের কি সেই অস্ত্র আছে, যার দ্বারা তিনি প্রবল পরাক্রান্ত শক্তিকে মোকাবিলা করবেন? আমি উদ্দীপ্ত কণ্ঠ বলব, হ্যাঁ! আলবত আছে— তার নৈতিক অবস্থান। ইতিহাসও তো তা-ই বলে।

‘রংপুরবার্ত্তাবহ’ নামের পত্রিকাটি আজকের রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটার দূরে মফস্বলের জেলা রংপুর থেকে বের হয়েছিল ১৯৪৭ সালের আগস্টে। পত্রিকাটি সমকালিক রংপুরের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এক দর্পণের ভূমিকা পালন করে। এতে প্রকাশ পেত স্থানীয় অভাব-অভিযোগ এবং স্থানীয় সরকারি কর্মচারীদের দুষ্কর্মসহ সমাজের যতসব অসঙ্গতির সংবাদ। অধিকন্তু জনগণের পক্ষে কথা বলত। পত্রিকাটির বিষয়বস্তু সম্পর্কেও সরকারি নথিতে লেখা হয়েছিল— ‘A weekly paper of news and extracts.’ জনগণের পক্ষে কথা বলাসহ এটি সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিত। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই পত্রিকাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

একবিংশ শতাব্দীতে যখন আধুনিক সাংবাদিকতা বিজয়পতাকা উড়াচ্ছে প্রিন্ট, অনলাইন, ইলেকট্রনিক থেকে ডিজিটাল মিডিয়ায়; তখনো কিন্তু সাংবাদিকতা নিয়ে দেশজুড়েই নানা প্রশ্ন উত্তাপিত হচ্ছে। সাংবাদিকতার নৈতিকতা, পেশাদার হিসেবে সাংবাদিকের কর্তব্য এবং জাতীয়তাবাদী দায়িত্ব নিয়ে বিতর্কও কম নয়। ক্ষেত্রবিশেষে সাংবাদিকের ভূমিকা কতটা বস্তুনিষ্ঠ, কতটা কায়েমি স্বার্থ পরিচালিত— এসব আসছে সামনে। আবার পেশাদারি সাংবাদিকতার চলও এখন গোটা দেশে বেড়েছে। মফস্বলেও সাংবাদিকদের গুরুত্বও চোখে পড়ে পত্রিকাভেদে। এ দেশের গ্রামে গ্রামে বহু নাম না জানা সাংবাদিক আজও সাধ্যমতো গ্রামীণ সাংবাদিকতা করে চলেছেন। সামাজিক আন্দোলনে তাদের অবদান ফেলনা নয়, বরং উজ্জ্বল। ইতিহাসসিদ্ধও।

তা মানছি কি? শেকড় ছেড়ে শিখরের বড়ত্বে মজে আছি। নিচে তাকালে জাত যাবে যে! সেই জাতের মাথা খেয়েই কুর্নিশ করছি বেজাতকে, যাদের কাছ থেকে বিখ্যাত ব্যক্তিরাও নিচ্ছেন শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। তেমনি একজন কাঙাল হরিনাথ। আসল নাম কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। বাংলাদেশ শুধু নয়, ভারতের গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ এবং সাংবাদিকতার জগতে সম্ভবত প্রথম সফল কাণ্ডারী। জনকও বলা চলে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতায় নৈতিকতার প্রশ্নে নতুন প্রজন্মের ক’জনইবা জানি তার সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকাটি ছিল তৎকালীন গোটা ভারতবর্ষের তমসাচ্ছন্ন গ্রামজীবনের কণ্ঠস্বর।

কাঙাল হরিনাথের পথচলা বাস্তব তথ্যের সঙ্গে মেলানো যেতে পারে, যাকে আমরা সাংবাদিকরা বলে থাকি ‘ক্রস-চেক’। হরিনাথ নিজেই গ্রাম-গঞ্জ ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করতেন এবং পাঠকদের হাতে তুলে দিতেন একটি বলিষ্ঠ পত্রিকা। সাহসী এই কলমসৈনিক ১৮৭২ সালে দুঃখী মানুষের পক্ষে কালাকানুনের বিরুদ্ধে পত্রিকার মাধ্যমে তীর্যক প্রতিবাদ জানান। গ্রামে বসবাস করেও উনিশ শতকের বুদ্ধিজীবী কাঙাল হরিনাথ ১৮৬৩ সালে নীলকর সাহেব অর্থাৎ শিলাইদহের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর জমিদারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কৃষকদের পক্ষে প্রবন্ধ লিখে তোলপাড় তৈরির কারণে ঠাকুর জমিদার হরিনাথকে খুন করার জন্য ভাড়াটে গুণ্ডা পাঠান। তা প্রতিরোধে হরিনাথকে রক্ষা করেন সতীর্থ বাউল সাধক লালন ফকির নিজেই তার দলবল দিয়ে। এছাড়া প্রশাসনযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ভুল-বিচ্যুতি ও নীতি-আদর্শ স্খলনের কঠোর সমালোচনাও করতেন। কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে সেবাপরায়ণতার সম্পর্ক বজায় রাখতে না পারায় জটিলতর ও অসমাধানের রূপ নিত। ফলে প্রভূত ক্ষতি স্বীকার করেই পত্রিকা চালাতেন।

ওই সময় পাবনা জেলায় মফস্বল পরিদর্শনে যান এক ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। এক দরিদ্র বিধবার একটি দুগ্ধবতী গাভীর প্রতি লোভ হয় এবং জবরদস্তি করে নিয়ে যান। এ সংবাদ সাংবাদিক-সম্পাদক কাঙাল হরিনাথের কর্ণগোচর হলে তা যাচাইয়ের ভিত্তিতে তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এই অনৈতিক ও গর্হিত অন্যায় কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ফলাওভাবে খবর প্রকাশ করেন ‘গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট’ শিরোনামে। সংবাদটি রাষ্ট্র হলে সংক্ষুব্ধ ম্যাজিস্ট্রেট হরিনাথের প্রতি অতিশয় রুষ্ট হন এবং লিপ্ত হন ওই সাংবাদিককে সময়োচিত শায়েস্তা করতে। কিন্তু কাঙাল হরিনাথের সত্যসেবার অসামান্য চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে হরিনাথের সত্যসন্ধিৎসু অভিযাত্রাকে ঠেকানো সম্ভব হয়নি। বরং পরবর্তীকালে সত্যনিষ্ঠ স্বাধীন মতপ্রকাশের নির্ভীকতার জন্য ওই ম্যাজিস্ট্র ভূয়সী প্রশংসা করে গ্রামীণ সাংবাদিক হরিনাথকে লিখেছিলেন, ‘এডিটর, আমি তোমাকে ভয় করি না বটে; কিন্তু তোমার নির্ভীক সত্য লেখনির জন্য আমি অনেক কুকর্ম ত্যাগে বাধ্য হয়েছি।’

আমাদের স্বাধীন দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রত্যাশিত। সংবাদপত্রের সাথে অনেকেই সংশ্লিষ্ট। সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের এক বা একাধিক মালিক থাকেন। থাকেন সাংবাদিক ও কর্মীবাহিনী। থাকেন লেখক। বিজ্ঞাপনকর্মী। পাঠক। তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব বৃত্তের স্বাধীনতা থাকতে হবে সংবাদপত্রকে ঘিরেই। রাষ্ট্রের রয়েছে তিনটি স্তম্ভ— ১. জাতীয় সংসদ, ২. নির্বাহী বা শাসন বিভাগ এবং ৩. বিচার বিভাগ। এই তিনটি স্তম্ভের সঙ্গে ‘সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যম’ অপরিহার্যভাবে যুক্ত হয়ে চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্র। বিপদগ্রস্ত মানুষজন বিপদ থেকে প্রতিকার চাইতে সাংবাদিককেই খুঁজে। গ্রাম, শহর, বন্দরের যেকোনো বয়সের মানুষ গণমাধ্যমকেই দেখে তাদের ভরসা হিসেবে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি জনমত। এই জনমত প্রকাশের অবাধ অধিকার থাকতে হবে, যেন জনগণ ইচ্ছামতো সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করতে পারে। এতে কেউ বাধা দিতে পারে না। কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকার ভুল করলে সাংবাদিকরা সত্য বিষয়টি লেখনির মাধ্যমে তুলে ধরেন। এভাবে জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখে সংবাদপত্র। এটি সংবাদপত্রের অধিকার এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। সাংবাদিকরাও আইনের ঊর্ধ্বে না, না অন্য কেউ। জনগণেরও মৌলিক অধিকার রয়েছে তথ্য জানার। সত্যে সমাদৃত এ তথ্যসমুদ্র বাতিঘরের প্রয়োজন মেটায় সংবাদমাধ্যম। সাংবাদিকরা জনগণের বাইরে নন। সংবাদমাধ্যম ও সংবাদিকের দায়িত্ব ও কাজ হচ্ছে প্রতিকারের মানসে যতসব অসঙ্গতির তথ্যচিত্র রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকার বা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্য যেকোনো মূল্যে জনসম্মুখে তুলে ধরা। সাংবাদিকের কলম মুক্ত হলে সমাজ ও রাষ্ট্র উপকৃত হয়।

সাংবাদিকতা মানে যা সত্য, যা কঠিন, যা মানুষের জানা দরকার তা বস্তুনিষ্ঠভাবে তীর্যকভাবে তুলে ধরা। এতে কোনোটির সমাধান হয়, কোনোটি চলে সমাধানের পথ ধরে। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম জগতে সমাদৃত নীতিটি হচ্ছ— ‘Facts are Sacred, Commands are free, News is based on fact, fiction is not news.’ অর্থাৎ ‘’ঘটনাগুলো পবিত্র, আদেশগুলো নিখরুচে, সংবাদ তৈরি হয় সত্যের ভিত্তিতে, কল্পকাহিনী কোনো সংবাদ নয়।’ বোতল অর্ধেক ভরা কিংবা বোতল অর্ধেক খালি বলা গেলেও নেই দোসরা বলার সুযোগ। অর্থাৎ, সত্য-মিথ্যার লাবড়া হবে সাংবাদিকতার গায়ে হলুদ।

মরা সাপ পেটানো যেমন সাংবাদিকের কাজ নয়, তেমনি ‘সবার আগে সব খবর’ স্লোগান চাণক্যে বাহবা কুড়িয়ে পাঠকের তালুতে বসাও কাম্য নয়। সেহেতু, ‘থামো, শান্ত হও; জেনে-বুঝে খবর ছড়াও।’ তাই আসন গাড়তে হবে পাঠকের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটিতে। সুতরাং ‘মনেরে আজ কহ যে,/ ভালো-মন্দ যাচাই আসুক সত্যরে লও সহজে।’

সারাবাংলা’র সম্পাদকীয় দফতর থেকে যখন বলা হলো প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর লেখা দিতে, তখন প্রথমেই মস্তিষ্কে এলো— খবর কী? দীর্ঘদিনের রিপোর্টিংয়ে ক্রাইম ও পার্লামেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্যাল বিটে ছিলাম। কেননা খবর জানার আগ্রহ মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। ক্লাসের আগে দৈনন্দিন স্কুলমাঠে সমাবেশ হবে, স্কুলে ক্লাস হবে, স্কুলের মাঠে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করবে— এটি কোনো খবর নয়। একদিন দেখা গেল, কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে ২ নম্বর বগাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮৫ বছর ধরে দখলে থাকা স্কুলের প্রাচীন মাঠটি প্রভাবশালী মহল দখল করে নিয়েছে এবং বদলির জুজুতে শিক্ষকদের বানিয়ে রাখা হয়েছে গোমস্তা করে। সেটি নিশ্চয়ই একটি সংবাদ বা দুঃসংবাদ। দশ গ্রামের মানুষ শুধু নয়, দেশবাসীরও জানার দুর্বার আগ্রহ রয়েছে তাতে। কীভাবে ঘটনাটি ঘটল, কারা কারা জড়িত, নেপথ্য হোতা কে, গোমরটাই বা কী— নানা প্রশ্ন আসবে মানুষের মনে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে সেসব প্রশ্নের উত্তর থাকবে। সরকারও প্রতিকারে এগিয়ে আসবে।

আকাশেতে লাখো তারা। কিন্তু শুকতারা একটি। সারাবাংলা বস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভীক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পাঠকপ্রিয়তায় হয়ে উঠুক বাংলার সেরা, সংবাদমাধ্যমের জগতে শুকতারা— এমন প্রত্যাশা করাটা অতিশয়োক্তি হবে না নিশ্চয়।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কলামিস্ট; সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা

সারাবাংলা/টিআর

৪র্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ৫-এ পা রফিকুল ইসলাম সারাবাংলা ডটনেট সারাবাংলার ৫-এ পা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর