সুবর্ণজয়ন্তীতে বিজয় হোক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের
১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:১৩
একাত্তরে শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি দেশ গড়তে যে মুক্তির যুদ্ধ হয়েছিল তার অন্যতম লক্ষ্যই ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি ধর্মনিরপেক্ষতার একটি চারা বাংলাদেশে রোপণ করিয়াছি, এ চারা যদি কেউ উপড়ে ফেলতে চায় তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।’
বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাস্তবায়ন ঘটাতে চেয়েছিলেন, যেখানে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার থাকবে। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন, এ দেশের মানুষ তার ধর্ম নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আনন্দের সঙ্গে পালন করবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহিদ হলে তার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯৭৮ সালের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয় এবং ১৯৮৮ সালে তৎকালীন অগণতান্ত্রিক সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের দলগুলো রাজনীতি ওই সময় ইসলামপন্থিদের, বিশেষ করে রক্ষণশীল ইসলামপন্থিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কারণে সমাজে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অসাম্প্রদায়িক শক্তির চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে পড়ে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে এখনো প্রশ্ন উঠছে— আমরা কি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পেরেছি? এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। তবে এখনো যে আমাদের অনেক দায়িত্ব, অনেক কাজ বাকি— সেটি স্পষ্ট। তবে আমি আশাবাদী— সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার পর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যেভাবে সবাই একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে আমি অভিভূত। এটাই তো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছিলেন।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শব্দটির অর্থগত বিশ্লেষণের জায়গায় যদি লক্ষ করি তাহলে দেখা যায়— ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সাধারণত রাষ্ট্র আর ধর্মকে পৃথক রূপে প্রকাশ করাকে বোঝায়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনো ধর্মের সঙ্গে পক্ষপাতমূলক আচরণ করে না। এই মত অনুযায়ী, সরকার কোনো ধরনের ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের বিশ্বাসী হবে না এবং কোনো ধর্মকে অতিরিক্ত সুবিধা দেবে না। কাউকে ধর্মপালনে বাধ্যও করা হবে না। সব ধর্মের মানুষ রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমান অধিকার ভোগ করবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো তথ্য ও প্রমাণের ওপর নির্ভর করবে।
যদি ধর্মনিরপেক্ষতা সর্বজনস্বীকৃত বিষয় হয়, তাহলে এ দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা কেন হবে— এই প্রশ্ন রয়েই যায়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যেকোনো ধর্মীয় উৎসব বা বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের প্রার্থনার জায়গায় পুলিশ পাহারা দিয়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। শুধু তাই নয়, বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখ উদযাপন, এমনকি এ দেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও মসজিদে বসাতে হয় নিরাপত্তা বলয়। সুতরাং এখানে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব তৈরি করে সুবিধা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে— একটি মহল বিষয়টি প্রমাণ করে। সুতরাং এ কথা বলা যায়, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মুখে মুখে অসাম্প্রদায়িক, কিন্তু ভেতরে তারা সাম্প্রদায়িকতার বীজ বহন করে চলেছে।
দেশ ৫০ বছর পেরিয়ে ৫১-তে পড়তে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির এমন আচরণে প্রশ্ন রয়ে যায়— যারা এ দেশের জন্য শহিদ হলেন তারা কেমন দেশ চেয়েছিলেন? গত ১০/১৫ বছর আগেও এই দেশে পাকিস্তানপ্রেমী মানুষের উল্লাস দেখিনি কোনোদিন, এখন দেখছি। কেন? এই প্রশ্ন করা কি অযৌক্তিক হবে? যদি একটু লক্ষ করি তাহলে এটি সহজে প্রতীয়মান হয়— গত ৫০ বছরে পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি আমরা এই প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে। এই দায় সবার। তবে দেশ যারা দেখছেন তাদের এই ব্যাপারে জবাবদিহিতা কোথায়?
অতীত না জানলে দেশের বর্তমান প্রজন্ম কোন চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যাবে? বিষয়টি নিশ্চয় গুরুত্ব বহন করে। উন্নয়নের পাশাপাশি নিজেদের শেকড়ের খোঁজও জানা জরুরি। একটা দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি সেই দেশকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বিশাল ভূমিকা রাখে। দেশের সংস্কৃতি ধরে রাখার অবিরত চেষ্টা করা মানুষগুলো বোধ করি একাত্তরেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এখন আর সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কারো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখি না। মনে হয় যারা আছেন ভাবনার জন্য, তারা এখন নিজেদের পকেট ভারী করতে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন। শহিদ মিনারে দিনভিত্তিক কিছু জ্বালাময়ী বক্তৃতা আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিষয়ভিত্তিক নিয়মিত টকশো’তে অংশগ্রহণের মাধ্যমে চেতনা বাস্তবায়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু প্রকৃত কাজ এটি নয়।
স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের বংশধরদের ঔদ্ধত্য আজ এতটা বেড়েছে যে তারা স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের বিজয় কামনা করে, বিজয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। তারা পাকিস্তানের জার্সি গায়ে জড়িয়ে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে মাঠে খেলা দেখতে যায়। টেলিভিশনে গ্যালারিতে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা দেখে প্রথমে আমি বিভ্রান্ত হয়েছি। ভেবেছি বাংলাদেশে থাকা কোনো পাকিস্তানি বা কূটনীতিকদের কেউ হয়তো মাঠে গেছেন খেলা দেখতে। অন্য দেশের খেলা থাকলে এমন দৃশ্য আমরা দেখি, যা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু জাতীয় পতাকার আধিক্য দেখে আমার ভুল ভেঙেছে। পরে ভেবেছি— খেলা যেহেতু মিরপুরে, তাই হয়তো বিহারি মানে শারীরিকভাবে আটকে পড়া পাকিস্তানিরাই হয়তো পুরোনো প্রেম ভুলতে পারেনি। কিন্তু আমার ভ্রমও কেটে যায় যখন খেলা শেষে স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের জয়ধ্বনি উচ্চকিত হয়, যখন মানসিকভাবে আটকে পড়া পাকিস্তানিরা রীতিমতো টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে জানায়— তারা বাংলাদেশের নাগরিক, কিন্তু ভালোবাসেন পাকিস্তানকে। পাকিস্তানের জার্সি পরা এক তরুণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করেন, জবাব বাংলায় দেবো না উর্দুতে!
উৎফুল্ল সেই ‘কুলাঙ্গার’ বলেন, ‘বাংলাদেশ বলতে তো কিছু নাই। চাই পাকিস্তান জিতুক।’ আরেক কুলাঙ্গারের ধারণা, বাংলাদেশ-পাকিস্তান ভাই-ভাই। পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়াটাই ভুল হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া কোনো তরুণ এমন দম্ভোক্তি করতে পারে— এটা অবিশ্বাস্য।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দু’টি ধারা আছে। নিজের কাছেই প্রশ্ন করি— বাংলাদেশ কবে ভেতরে ভেতরে এতটা পাল্টে গেল যে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যায়? চার দশক পরে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কিছুটা গ্লানিমুক্ত করেছেন। কিন্তু তলে তলে তাদের উত্তরসূরীরা বংশবিস্তার করেছে। আজ তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের পতাকা বহন করে! মনে হচ্ছে, কোথাও আমরা ভুল করছি। ক্ষমতার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে, আপস করা হয়েছে। তাদের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তক বদলানো হয়েছে। হয়তো এ সুযোগে ভুলভাবে বেড়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের একটি অংশ।
পাকিস্তান প্রসঙ্গ এলেই অনেকে খেলার সঙ্গে রাজনীতি না মেশানোর পরামর্শ দেন। পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানোর প্রসঙ্গে অনেকে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকার প্রসঙ্গ টানেন। ব্রাজিলের পতাকা আর পাকিস্তানের পতাকা এক নয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রাম আর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীনতায় মিশে আছে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত আর কোটি মা-বোনের নির্যাতনের হাহাকার।
পাকিস্তান এখনো একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি, শিমলা চুক্তিতে বিচারের কথা বলে নিয়ে যাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, আমাদের পাওনা ফেরত দেয়নি, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়নি। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো আপস নেই। স্বাধীন বাংলায় দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের পক্ষে বলার কোনো সুযোগ নেই।
মিরপুরে যারা পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে খেলা দেখতে গেছে, পাকিস্তানের পক্ষে গলা ফাটিয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভুল বলেছে— তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি— বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ফুটেজ দেখে এদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হোক। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হোক। বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আছে। রাজনীতিতে মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার বা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর কোনো অধিকার থাকতে পারে না।
এই বিজয়ের মাসে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা, স্বচ্ছতার মনোভাব, দায়িত্বশীল আচরণ ও পাকিস্তানপ্রীতিবিরোধী মনোভাবে জাতি একমত হতে পারলে আমাদের বিজয়ের স্বাদ পরিপূর্ণতা পাবে বলে বিশ্বাস করি। আমাদের সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরদ্ধে সোচ্চার হয়ে আবারও কঠোর হতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে বলে মনে করছি। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিস্তৃতি রুখে দিতে আমাদের যেমন সচেতন হতে হবে, একইসঙ্গে তরুণ প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণে ভূমিকা রাখবে তরুণ প্রজন্ম। বিজয়ের মাসে আমাদের প্রত্যাশা— মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশে বিজয়ের সুবাতাস বাংলার সবুজ মাঠের সোনালি ফসলে দোলা দিয়ে যাবে। প্রভাতে সূর্যের সোনালি আলোয় নিরাপদ হবে সকল ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান।
লেখক: উপ-তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি (আইটি) সম্পাদক, যুবলীগ
সারাবাংলা/টিআর
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এন আই আহমেদ সৈকত পাকিস্তানপ্রীতি বিজয় দিবস স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী