Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে যা জানা খুবই জরুরি

শামীম আহমেদ
৩১ ডিসেম্বর ২০২১ ২৩:৩৭

ওমিক্রন দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ডেল্টার চেয়ে মৃত্যুর হার কম হলেও এটি সংক্রমণের দিক থেকে করোনাভাইরাসের আগের যে কোনো ভ্যারিয়েন্ট বা ধরনকে ছাড়িয়ে গেছে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় সংক্রমণের আগের সব রেকর্ড ইতোমধ্যে ভেঙে গেছে। রোগীর অত্যধিক চাপে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা পড়েছে ঝুঁকির মধ্যে। ওমিক্রন নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা আছে আমাদের, তাই খুব সাদাসিধে ভাষায় অত্যন্ত জটিল কিছু বিষয় সবার জন্য তুলে ধরছি। চাইলে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। বিষয়গুলো জানা জরুরি। জনস্বাস্থ্য ও গবেষণালব্ধ এই তথ্যগুলো সবার উপযোগী করে উত্থাপন করলাম। তবে করোনা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, নতুন তথ্য জানলে আপনাদের জানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

বিজ্ঞাপন

কততম ভ্যাকসিন নিচ্ছেন, তার চেয়ে শেষ ভ্যাকসিন কবে নিয়েছেন সেটি বেশি জরুরি
ওমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সারা বিশ্বেই তৃতীয় ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এখানে মনে রাখা দরকার ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজের মধ্যে জাদুকরী কোনো উপাদান নেই, এবং তা আগের ভ্যাকসিনের চেয়ে রাসায়নিকভাবেও ভিন্ন বা শক্তিশালী নয়। ডেল্টা বা ওমিক্রনের জন্য আলাদা কোনো ভ্যাকসিন বানানো হয়নি। যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে আপনি শেষ ভ্যাকসিন কবে নিয়েছেন? আপনার শেষ ভ্যাকসিন যদি ছয় মাসের আগে নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আপনার জন্য আরেকটি ভ্যাকসিন নেওয়া খুবই জরুরি, কেননা এটি এখন নিশ্চিত যে করোনার যেকোনো ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ছয় মাস পর কমতে থাকে। তাই ছয় মাস আগে যদি আপনি শেষ ভ্যাকসিন নিয়ে থাকেন, তবে যত দ্রুত সম্ভব আরেকটি ডোজ নেওয়া আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি সুযোগ থাকে, তাহলে শেষ ডোজের তিন মাস পার হলেই আরেকটি ডোজ নেওয়া ভালো। এই নতুন ডোজটি আপনার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ যাই হোক না কেন।

বিজ্ঞাপন

তৃতীয় ডোজই একমাত্র বুস্টার ডোজ নয়
করোনার তৃতীয় ডোজকে অনেকেই বুস্টার ডোজ বলছেন। বুস্টার ডোজ আসলে কী সেটি সম্পর্কেও আমাদের মধ্যে ভুল ধারণা আছে। ‘Boost’ শব্দের অর্থ বৃদ্ধি করা বা বিকাশ করা। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বুস্টার বলতে বোঝায় প্রাথমিক ভ্যাকসিন দেওয়ার পর যে মাত্রার প্রতিরক্ষা গড়ে ওঠে সেটি একই মাত্রা বজায় রাখতে বা যদি তার প্রতিরক্ষা ব্যূহ কমে যায়, তাকে বাড়িয়ে তুলতে আবার ভ্যাকসিন দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ‘টিটেনাস’ ভ্যাকসিনের কথা।টিটেনাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা সমুন্নত রাখতে প্রতি ১০ বছর অন্তর বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ দেখা গেছে ১০ বছর অন্তর ভ্যাকসিন না দিলে টিটেনাসের প্রতিরক্ষা ব্যূহ নষ্ট হতে শুরু করে। করোনার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমনই। যেহেতু প্রতি ছয় মাস পর ভ্যাকসিনের কার্যকারীতা কমছে, তাই নতুন ধরনের করোনার উৎপত্তি হলেই আবার বুস্টার ডোজ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে নতুন ধরণটির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে।

এক্ষেত্রে আরেকটি বাস্তবিক উদাহরণ দেওয়া যায়। কানাডার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে করোনার চতুর্থ ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। যেহেতু প্রথমে ৮০ বছরের ঊর্ধ্বে মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছিল কানাডার, তাদের অধিকাংশের তৃতীয় ডোজ নেওয়া ৬ মাস আগে শেষ হয়েছে। তাই ওমিক্রনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে তাদের জন্য চতুর্থ ডোজ ভ্যাকসিন বুস্টার হিসেবে কাজ করবে।

করোনার ভ্যাকসিন কি প্রতি ৬ মাস পর পর সারাজীবন দিতে হবে?
যদিও এই বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু বলছেন না, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের শিক্ষা ব্যবহার করে বলা যায়—সম্ভবত সামনের দিনগুলোতে এত ঘন ঘন ভ্যাকসিন নিতে হবে না। কেন নয়, আসুক আলোচনা করা যাক।

ক) অধিক কার্যকর ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা: আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে বুঝব ভ্যাকসিন বা এন্টিবায়োটিক তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। স্মলপক্স, ইয়েলো ফিভারের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে লেগেছে শত বছর, পোলিও এবং টাইফয়েডের ভ্যাকসিন তৈরিতে লেগেছে প্রায় ৩০ বছর। ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন ২৫ বছরের মাথায় তৈরি করার ২ বছর পরই তা অকার্যকর ঘোষণা করা হয়। এখন ইনফ্লুয়েঞ্জার নতুন ভ্যারিয়েন্ট প্রায় প্রতিবছরই বের হয়, তাই প্রতিবছরই এর ভ্যাকসিন নিতে হয়। পশ্চিমা বিশ্বে এটি সিজনাল ফ্লু ভ্যাক্সিন হিসেবে পরিচিত। সুতরাং করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যে ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে একবছরেরও কম সময়ে, তার প্রাথমিক কার্যকারিতা কিছুটা কম হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এর গতিপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন এবং সামনের দিনগুলোতে করোনার নতুন যে ভ্যাকসিন আসবে তা অধিক কার্যকর হবে বলে প্রতীয়মান হয়।

খ। ন্যাচারাল ইমিউনিটি (প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা): ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা হয় মূলত ন্যাচারাল ইমিউনিটিকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ, মানুষ কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীর সেটিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে সেটার গঠন-প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত হয় এবং সেই অভিজ্ঞতা নিজের ‘মেমোরি সেল’ বা স্মৃতিকক্ষে সংরক্ষণ করে রাখে। ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে ওই ভাইরাস আবার আক্রমণ করলে শরীর নিজেই সেটিকে রুখে দিতে পারে। ভাইরাস যদি খুব শক্তিশালী হয় তাহলে শরীর তার স্মৃতি বেশি দিন সংরক্ষণ করতে পারে না, তখন তাকে বাইরে থেকে শক্তি জোগাতে হয়। কোভিড-১৯, তেমনই শক্তিশালী ভাইরাস, যা প্রতিরোধে শরীরকে বাইরে থেকে ভ্যাকসিনের সাহায্য নিতে হচ্ছে। তবে শরীর যখন করোনাকে নিজে প্রাথমিকভাবে মোকাবিলা করছে, তখন তার ভেতর কিছু রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। এর সঙ্গে একাধিক ডোজ ভ্যাকসিন যুক্ত হলে সেটি আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে। যেহেতু বিশ্বের অনেক মানুষই ধারণা করা যায় ইতিমধ্যে করোনায় একবার হলেও আক্রান্ত হয়েছেন, এবং সামনের কিছুদিনের মধ্যে অনেকেই দুই থেকে তিন ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে নেবেন, তাদের প্রতিরক্ষা অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

গ। মিউটেশন শ্লথ হবে: করোনাভাইরাস ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। এটি দিনে দিনে পরিবর্তিত হচ্ছে, যার কারণে প্রাথমিক সাফল্যের পরেও এটি নতুন করে আক্রান্ত করছে মানুষকে। একাধিকবার পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান ওমিক্রন তারই নিদর্শন। মিউটেশন (অর্থাৎ, ভাইরাস প্রথমে যেমন থাকে, রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে সেটি নিজের ধরন পাল্টে ফেলে) চলতে থাকলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমতির দিকে থাকবে এটাই স্বাভাবিক, কেননা নতুন ভ্যারিয়েন্ট পূর্বের ভ্যাকসিনের মাধ্যমে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করা নাও সম্ভব হতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এই মিউটেশন অধিকাংশ ভাইরাসের ক্ষেত্রেই অনন্তকাল ধরে ক্ষতিকর মাত্রায় চলে না। কিছু মিউটেশন চলতে থাকে, কিন্তু তা ক্ষতিকর হয় না। বেশিরভাগ ভাইরাসের ক্ষেত্রে তাই হয়। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন করোনাভাইরাস ফ্লু ভাইরাসের চেয়ে অর্ধেক মাত্রায় পরিবর্তিত হচ্ছে (করোনাভাইরাস বছরে ২৫ বার পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে, ফ্লু হচ্ছে ৫০ বারের মতো)। এইচ আই ভি-এইডস বা ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস কোভিড-১৯ ভাইরাসের চেয়ে অনেক দ্রুত পরিবর্তিত হয়। মিউটেশনের মাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণও কমবে। তাই মিউটেশন থামাতে ভ্যাকসিনেশন বাড়াতে হবে এবং ভাইরাস যাতে একজন থেকে আরেকজনের কাছে না ছড়াতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ভাইরাস ছড়াতে না পারলে মিউটেট করতে পারবে না (যদি না কেউ পরিকল্পিতভাবে ল্যাবেরটরিতে তা করে), আদতে আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে আসবে।

মৃত্যুর হার কম হলেও অধিক বিপজ্জনক
ওমিক্রনে প্রাথমিকভাবে মৃত্যুর হার অনেক কম হলেও এটি খুবই বিপজ্জনক একটি ভাইরাস। প্রথমত, এটি করোনাভাইরাসের অন্য ধরনগুলোর চেয়ে দ্রুত ছড়ায়। আর দ্রুত ছড়াতে থাকলে সেটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরির দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। নতুন ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা বা ওমিক্রন থেকেও ভয়াবহ হতে পারে, কোনো ভ্যাকসিন তখন কাজ নাও করতে পারে। তাই ওমিক্রনের সংক্রমণ প্রতিহত করা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, যেহেতু লাখ লাখ মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছেন; তাই যাদের শরীরে নানা রোগ-ব্যাধি আছে, বা যারা বয়স্ক তারা ভ্যাকসিন নিলেও এই সংক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে এখন বা পরবর্তীতে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়তে পারেন।

তৃতীয়ত, ওমিক্রনের রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা দিলে অন্য গুরুতর রোগীরা চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, যা বৈশ্বিক মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিতে পারে।

চতুর্থত, দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যকর্মী, ও জনস্বাস্থ্য গবেষকরা শারীরিক ও মানসিক অবসাদের শীর্ষে অবস্থান করছেন, যা ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক অবসাদের সৃষ্টি করতে পারে।

যদিও এখন পর্যন্ত ওমিক্রনে মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তির হার ডেল্টার অর্ধেক, কিন্তু যেহেতু সংক্রমণের হার ডেল্টার চেয়ে বেশি সুতরাং আদতে মৃত্যুর হার ও হাসপাতালে ভর্তির হার ডেল্টাকেও অতিদ্রুত ছাড়িয়ে যেতে পারে যা সারাবিশ্বকে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের দিকে ঢেলে দিতে পারে।

সুতরাং, যদি আপনার ভ্যাকসিনের শেষ ডোজ ৬ মাসের পুরনো হয়ে থাকে, তাহলে সুযোগ থাকলে নতুন ডোজ নিয়ে নিন। পরিবারের সদস্য ব্যতিরেকে অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন, সুযোগ থাকলে অফিস আদালত অনলাইনে চালু রাখুন, কারও ছয় ফুটের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা থাকলে মাস্ক পরুন।

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। নতুন বছর সুন্দর হোক। শুভ নববর্ষ ২০২২।

লেখক: সোশ্যাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ডক্টরাল রিসার্চার, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো

সারাবাংলা/আইই

ওমিক্রন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট করোনাভাইরাস শামীম আহমেদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর