শিক্ষকরা নির্বাচনে, শিক্ষার্থীরা নির্বাসনে!
৮ জানুয়ারি ২০২২ ১১:৫২
ভয়ঙ্কর বৈশ্বিক মহামারি করোনার মাঝেও ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের ধুম। লাল-নীল-সাদা ইত্যাদি রংয়ে নির্বাচনে ব্যস্ত শিক্ষকরা। উৎসাহ-উদ্দীপনায় ব্যাপক আয়োজনে হচ্ছে তাদের সিবিআই টাইপের এ নির্বাচন। এরইমধ্যে ঢাকা-জাহাঙ্গীরনগরসহ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবরের মতো ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত শিক্ষকদের জয়জয়কার। কেবল সমিতি নয়, শিক্ষকদের ক্লাব নির্বাচন পর্যন্ত হচ্ছে। সিনেট-সিন্ডিকেটসহ আরো নানান নির্বাচন তো আছেই।
কর্মকর্তা-কর্মচারী ইউনিয়নের নির্বাচনও হচ্ছে। কিন্তু, হচ্ছে না কেবল ডাকসুসহ ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো। শিক্ষক-কর্মচারীরা রাজনীতি বৈধ, শিক্ষার্থীরা অবৈধ? বা শিক্ষার্থীরা নির্বাচনের আওতামুক্ত-এমন কোনো হুকুম জারির খবর নেই। তাহলে কেসটা কী? কেন এই অন্যায্যতা? বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ‘ইতিহাস’ হয়ে যেতে বসেছে। অথচ স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলেও বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারের পতন হলো। গণতন্ত্র এলো, বিদায় নিলো ছাত্র সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের জন্য কম-বেশি আন্দোলন হয়েছে৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে একাধিকবার রিটও হয়েছে।
টানা ২৮ বছর না হওয়ার মধ্যেই ২০১৯ সালের ১১ মার্চের ডাকসু নির্বাচন কিছুটা হলেও আশাবাদ জাগায়। ওই নির্বাচনে ডাকসুর ২৫টি পদের ২৩টিই ছিল ছাত্রলীগের দখলে। শুধু ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে জয়ী হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেল থেকে নূর ও আখতার। ছাত্রলীগ সব ছিনিয়ে নিয়েছে অভিযোগের মধ্যেও মন্দের ভালো বিবেচনায় কারো কারো ধারনা হচ্ছিলো- অন্তত জট খুলেছে। সামনের দিনগুলোতে ডাকসুসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন একটু-একটু করে জমে উঠবে। বাস্তবটা আশাবাদের ধারেকাছেও নয়। ডাকসু নির্বাচন আর হয়নি। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নাম-গন্ধও নেই। তবে, শিক্ষকদের নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের বেশ খাটানো হয়। কী দাঁড়ালো অর্থটা? কী বার্তা মিলছে?
ডাকসু বা ছাত্র সংসদগুলো শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা এবং যৌক্তিক দাবি আদায়ের প্ল্যাটফর্ম। এর মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে নেতৃত্বের প্রকাশ ও প্রতিযোগিতা আসে। শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। জাতীয় রাজনীতিতেও নতুন নেতৃত্ব পাওয়ার আশা উঁকি দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের তা সহ্য হয় না? স্বার্থবাদী নানা গোষ্ঠীও কি মতলব নেই? নইলে শিক্ষক সমিতি, সিনেট, সিন্ডিকেট বা কর্মচারী ইউনিয়ন নির্বাচন ঠিকঠাকভাবে হয় কিভাবে? প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্সে ছাত্র সংসদের কথা রয়েছে। ছাত্র সংসদের জন্য আলাদা গঠনতন্ত্র আছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছাত্র সংসদের প্রেসিডেন্ট পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ পদাধিকার বলে ছাত্র সংসদের কোষাধ্যক্ষ। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাদের একক প্রশাসনিক ক্ষমতা খর্ব হয়।
জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়াদের বড় একটি অংশ অতীতে ছাত্র সংসদে প্রতিনিধি ছিলেন। রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, মুশতাক হোসেন, আমানুল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খোকনের মতো ডাকসুর আরো অনেক সাবেক ভিপি-জিএস জাতীয় রাজনীতিতে ফ্যাক্টর। আরো অনেকে আছেন প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হলেও নেতৃত্বের বিকাশ এসেছে। জেলা এবং স্থানীয় পর্যায়ের কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ থেকেও উঠে এসেছেন অনেকে। সেই বিকাশ নির্বাসনে বহুদিন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় রাজনীতি। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাতের কারণে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা যায় না-এমন একটি মত দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। ছাত্র সংসদ না থাকায় ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ কম, সেশনজট নেই– এমন মতও রয়েছে। নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে- বিপথগামী করে কিছু ছাত্রকে দিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ করানো হয়। শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করতে হাতিয়ার বানানো হয় তাদের। এই চর্চার লাগাম না টেনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠানো নিশ্চয়ই আরেক চাতুরি।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/ এসবিডিই