এত ‘রাজাকারের বাচ্চা’ আছে দেশে?
১০ এপ্রিল ২০১৮ ২৩:১৮
বেগম মতিয়া চৌধুরীর মতো একজন বিশাল ব্যক্তিত্বের কোনো কথা নিয়ে আমার মতো নবিশ কোনোদিন সমালোচনামূলক কিছু লিখবে সেটি কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু লিখতে হচ্ছে, এটাই বাস্তবতা। জাতীয় সংসদে ‘অগ্নিকন্যা’ মতিয়া চৌধুরী চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের নিয়ে এমন এক মন্তব্য করেছেন যে, শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, সংস্কারের দাবি তোলা শিক্ষার্থীরা সব ‘রাজাকারের বাচ্চা’! অন্যপক্ষ বলছে, মতিয়া চৌধুরী এমনটা বলতে চাননি; তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, এই আন্দোলনে জামাত-শিবিরের অনুপ্রবেশ রয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যায় সংসদে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমানোর দাবির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা সুযোগ পাবে না, রাজাকারের বাচ্চারা সুযোগ পাবে? তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংকুচিত হবে?’
মতিয়া চৌধুরী কাদেরকে রাজাকারের বাচ্চা বলছেন? এদেশের ছাত্রসমাজের প্রায় সবাইকে কি উনি ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলছেন? ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এত রাজাকার ছিল দেশে? যে বাবা-মায়ের জন্ম ১৯৭১ সালের পরে, কিংবা যারা সে সময় শিশু ছিলেন তারাও কি রাজাকার এর ভূমিকায় ছিলেন? এও কি সম্ভব? আমরা যে জানি, মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণযুদ্ধ, সেটি কি ভুল? আমরা যে জানি, জনসাধারণের সমর্থন ছাড়া মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী স্বাধীনতার সংগ্রামে সফল হতে পারতেন না, সেটি কি ভুল? বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যে গত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিশাল বিজয় অর্জন করেছিল সেখানে কি শুধু সনদপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারাই ভোট দিয়েছিলেন? অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যাদের সনদ আছে কিন্তু তাঁরা এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা বিএনপি-জাতীয় পার্টি সাপোর্ট করেন; এরাও কি আওয়ামী লীগে ভোট দেয়? বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকি সেদিন বললেন, নারীকে ক্ষমতায় রেখে নাকি উন্নয়ন সম্ভব নয়! একজন মহাবীরের এই যে অধপতন, তাকে কি এখনো আমাদের শ্রদ্ধা করতে হবে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী আমলা আকবর আলী খান, লেখক, প্রবন্ধকার সৈয়দ আবুল মকসুদ, ডক্টর জাফর ইকবাল, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর ফারজানা ইসলামদের মত প্রগতিশীল মানুষ কোটা সংস্কারের দাবির প্রতি তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। এই বড় বড় মনীষীগণ কি রাজাকার ছিলেন? না তাঁদের ছেলে-মেয়েরা এখন ‘রাজাকারের বাচ্চা’? আমি নিজে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে কোটা প্রথার সংস্কার চেয়েছি। হতে পারি আমি নিজে ‘দুর্বৃত্ত’, কিন্তু মতিয়া চৌধুরীর কথা অনুযায়ী তো আমিও রাজাকারের বাচ্চা। যারা মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান না রেখেই গত কয়েক বছরে দু নম্বরি করে সনদ ম্যানেজ করেছেন, এদের বিষয়ে কী বলবেন আমাদের এতদিনের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার মানুষ মতিয়া চৌধুরী।
এতো ধ্বংসযজ্ঞের পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের সাথে মিটিং করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এক মাস পরে নিজেই সংস্কারের ঘোষণা দেবেন। তাহলে মতিয়া চৌধুরী কী করে এমন মন্তব্য করেন? ওবায়দুল কাদের কি তবে রাজাকারের বাচ্চাদের সাথে মিটিং করেছেন? কী বোঝাতে চাইলেন মতিয়া চৌধুরী? প্রধানমন্ত্রী যখন স্পষ্ট বার্তা দিলেন, তখন কেন সবাই একেক সময় একেক কথা বলে শিক্ষার্থীদের খেপিয়ে তুলছেন?
মতিয়া চৌধুরীর কথা শুনে আমার মনে হয়েছে তিনি কোটা সংস্কারের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। উনাকে স্বার্থান্বেষীরা ভুল বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। মতিয়া চৌধুরীর মত শ্রদ্ধাভাজনদের বুঝতে হবে, মুরুব্বীরা না জেনে, না বুঝে, আকস্মিক কোনো মন্তব্য করলে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা কষ্ট পায়। হঠাৎ ভুল বক্তব্য দিলে সাধারণ মানুষ যে তাদের আগের মত আর শ্রদ্ধা করবে না, সেটি তারা বুঝতে পারেন না। এমনিতেই দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো রাজনীতিবিদদের তেমন একটা বিশ্বাস করতে চায়না। দেশের সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কথা রাজনীতিবিদদের মন দিয়ে শুনতে হবে। এই রাজনীতিবিদরা ভুলে যান, তাঁরা যে শ্রদ্ধা পান, সে তো তাদের তারুণ্যের সময়কার অবদানের জন্যই। এখন বয়সে বেড়ে গিয়ে নিজের সেই বিপ্লবী সময়ের কথা ভুলে যান কেন? সজাগ থাকার চেষ্টা করুন, না হলে আপনাদের অবস্থা হবে সেই রাজার মত, যার গায়ে কোনো জামাছিল না, কিন্তু চাটুকাররা বলছিল,’ মহারাজা আজকের এই ফ্যাশনটা সেরা’!
নীতিনির্ধারকরা সাধারণ মানুষের চাহিদা, প্রয়োজন ও প্রত্যাশা সম্পর্কে ধারণা না রাখলে রাষ্ট্রে কীভাবে অরাজকতা সৃষ্টি হয়, তার উদাহরণ এই সংস্কার আন্দোলন থেকে উদ্ভূত অরাজক পরিস্থিতি। শিক্ষার্থীরা হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে গেছে দিনের পর দিন। কিন্তু সরকারের সুনজরে আসতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা স্থানে। পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ারশেল মারে, লাঠিচার্জ করে। এই অরাজকতার সুযোগ নিয়ে অন্ধকারের শক্তি ভয়ংকর হামলা চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে। এই ঐতিহাসিক স্থাপনায় এমন হামলা আগে কেউ দেখেনি।
আওয়ামীলীগ সরকার গত ৯ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা প্রকৃত অর্থেই উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি। মতিয়া চৌধুরীর কাছে একটি প্রশ্ন, আপনার সরকার এই দীর্ঘ সময়ে রাজাকারের তালিকা করতে পারলেন না কেন? ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চিহ্নিত করতে পারলেন না কেন? এই ব্যর্থতার দায় কি আপনি নিবেন?
পেশাদার সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলা দরকার বলে মনে করি। কতিপয় শিক্ষার্থী কর্তৃক সাংবাদিকদের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ ক্ষোভ থেকে বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কাভার করবেন না। আপনাদের বোঝা উচিত, চতুর্থ স্তম্ভ আর আগের জায়গায় নেই। পঞ্চম স্তম্ভ বলে পরিচিত সোশ্যাল মিডিয়া অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে মূলধারার অনেক গণমাধ্যম যথাযথ কাভারেজ দেয়নি। ভারতীয় মরা হাতি নিয়ে দেশের এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম যতখানি কাভারেজ দিয়েছিল, এর সিকিভাগও এত বড় আন্দোলনকে দেয়া হয়নি। এর জন্য কেউ কেউ যদি আপনাদের উপর ক্ষুব্ধ থাকে তাহলে তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তবে হ্যাঁ, সাংবাদিকদের উপর যারা হামলা করেছে তারা অপরাধ করেছে, এটা বিচারযোগ্য। এমন অস্থিতিশীল সময়ে রিপোর্টার, বিশেষ করে সম্প্রচার সাংবাদিকদের অনেক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ঝুঁকি নিয়েই তো রিপোর্টিং করতে হবে। এটা তো ভারতীয় হাই কমিশনে বা মার্কিন দূতাবাসে বসে করার মত আরামের এসাইনমেন্ট না। এমনকি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রেস কনফারেন্সও নয়, যে বড় বড় লিডাররা কাভারেজ ভালো পাওয়ার জন্য আদর করে কাছে ডেকে বসাবেন। গণমাধ্যমে কাজ করেন, একটু জনগণকে অগ্রাধিকার দেন। তবে তখনো কিন্তু আপনাদের উপর হামলা হবে, তখন হামলা করবে সন্ত্রাসী, মাস্তানেরা। সাংবাদিকতা কোনো প্রেম ভালোবাসা নয় যে অভিমান করে বসে থাকবেন। এই অভিমান ভাঙাতে কেউ আসবে না। মানুষ ফেসবুক পেয়ে আগের থেকে অনেক বেশি স্বাধীন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলছি, এক মাস কোনোভাবেই লম্বা সময় নয়। যারা সৎ ও যৌক্তিক অবস্থান থেকে কোটা সংস্কার চাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে এই লেখা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপর আমাদের ভরসা রাখতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে উনার মত সফল রাষ্ট্রনেতা আর কেউ নেই। তিনি এক মাস সময় নিয়েছেন, এই এক মাস তাঁকে শান্তিপূর্ণ ভাবে দিতেই হবে। এক্ষেত্রে আন্দোলনকারীরা শুধু শান্ত থাকলেই হবে না। যারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আছেন, আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে বড় পদে আছেন, দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক সকলের সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। এই একমাস বিষয়টি নিয়ে কেউ যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করতে সাহস না পায়। দ্রুত একটি কমিটি করে দিয়ে এই সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। খুব ভেবে চিন্তে চূড়ান্ত ঘোষণা দিতে হবে। সব কোটাই যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসে উপযুক্ত সংস্কার করতে হবে। বুদ্ধিজীবী, আমলা ও সাংবাদিকদের আরও দরদ নিয়ে কাজ করতে হবে। কোনো দফতর থেকে কেউ যেন নাশকতা করতে না পারে সে জন্য সরকারের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীদের সতর্ক সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। আর ছাত্রছাত্রীদের উচিত হবে শালীন ও যৌক্তিক ভাষায় ফেসবুক ও অন্যান্য মিডিয়াতে লেখালেখি অব্যাহত রাখা, জনমত বজায় রাখা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলতে চাই। ২০০৮ সালে এক বিশাল বিজয় নিয়ে আপনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। সহ্য হয়নি বিরোধী শিবিরের। প্রথমেই আপনাকে ধাক্কা দিল বিডিআর বিদ্রোহ দিয়ে। আপনি সে ধাক্কা সামলালেন এবং বাংলাদেশকে তিলে তিলে গড়ে তুললেন। আজ যখন সামনে আরেকটি নির্বাচন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সাধারণ ছেলে-মেয়েদের কি গুলি করে থামানো যায়? আর্মি পেরেছিল এরশাদের সময় কিংবা সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়? আপনার নির্দেশ পর্যন্ত অমান্য করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আপনি বলেছিলেন, কোটার শূন্য পদে মেধা তালিকা থেকে এনে পূরণ করা হবে। অথচ মন্ত্রণালয় সার্কুলার দিয়ে বলল, কোটা থেকেই পূরণ করা হবে! হচ্ছে কী বাংলাদেশে? সবচেয়ে সচেতন, শিক্ষিতছেলে-মেয়েগুলোকে এভাবে রাস্তায় গুলি করে আহত করার দরকার ছিল? অতি উৎসাহী এই কর্মকর্তারা আসলে কাদের উদ্দেশ্য পূরণ করছে? আপনার প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীদের চিনতে পারলেন না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দেশের ছাত্র সমাজকে সাথে নিতে হবে আপনার। আজ এই পরিস্থিতি দেখে কষ্ট পাচ্ছি আমরা, খুশিতে ডগমগ হচ্ছে বিরোধীরা।
মতিয়া চৌধুরীর কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনি প্রধানমন্ত্রীর কথা মন দিয়ে শুনুন। উনি কী চান সেদিকে নজর দেন। পারলে দেশের ছাত্রসমাজের প্রতি অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করুন। না পারলে চুপ থাকুন, কিন্তু লাখ লাখ ছেলে-মেয়েকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করবেন না। না হলে এই ছেলে-মেয়েরা সংকটের সময় আপনাদের কথা শুনবে না, নতুন প্রজন্ম আপনাদের ভালোবাসবে না। আর এর সুযোগ নিবে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র।
লেখক: শেখ আদনান ফাহাদ, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।