বিলিতি মাস্টার্ডের ঝাঁঝ চাষাড়ে
২২ জানুয়ারি ২০২২ ১৪:৪৯
২০১৭ সালের এক হিসাব মতে, বাংলাদেশে একজন মানুষ নাকি বছরে ১৭৬ কেজি চাল খেয়ে থাকেন— যা বিশ্বের গড় হিসাবের তিনগুণ। এই জাতির জন্য চাষাভুষা তো দেবতার সমান হওয়ার কথা। ছোটবেলা আমাদের রাজিয়া চৌধুরানীর কবিতা মুখস্থ করানো হয়েছিল। কবিতার নাম ছিল ‘চাষী’
‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।’
শাবিপ্রবির একজন শিক্ষক ‘চাষাভুষাকে’ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার পর আমি বাংলা অভিধান দেখলাম। ‘চাষা’ বা ‘চাষাড়ে’ বলতে শুধু কৃষক বোঝায় না। মূর্খ, অশিক্ষিত, অমার্জিত, অসভ্য শব্দের সমার্থকও চাষা/ চাষাড়ে। এমনকি উগ্র, চড়া, ঝাঁঝালকেও বলে চাষাড়ে। সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন, বিলিতি মাস্টার্ডের ঝাঁঝ চাষাড়ে।
আমারও তাই মনে হচ্ছিল, আমরা যারা কৃষক নিয়ে রচনা লিখে বড় হয়েছি। কৃষক নিয়ে বাক্য গঠন করেছি: কৃষক বাংলার মাটিতে সোনা ফলায়। এমন জাতির তো মেটে মজুর চাষী নিয়ে বিরূপ হবার কথা নয়।
তাহলে কি আমাদের ভাষার ব্যবধান বাড়ছে? আর তা বাড়িয়ে দিতে দাঁড়িয়ে আছে ধনাত্মক প্রভাবকেরা?
শিক্ষক আর ছাত্রদের মধ্যে হয়ত দূরত্ব বাড়ছে। যেমন দূরত্ব বাড়ছে নেতাদের সঙ্গে জনগণের, বাসচালকের সঙ্গে যাত্রীর, সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার। আজ সকালেই দেখলাম টম হ্যাঙ্কস অভিনীত ‘দ্য টার্মিনাল’। একজন আরেকজনের কথা না বোঝায় কত করুণ হয় গেল একটা জীবন। আবার কথা বোঝার তাগিদ থেকে কত দূরত্ব ঘুচে গেল।
আমরা একজন আরেকজনের ভাষা বোঝার ব্যাপারে আরেকটু সহমর্মী হলে হয়ত, হয়ত অনেক দূরত্বই দূরত্বহীন হবে।
শাবিপ্রবি ভিসি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন। কোনোদিন তিনি কোনো ক্লাস মিস করতেন না। সদা হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। কোনোদিন আমাদের অসম্মান করেন নাই। দুর্বিনীত চাহুনী দেন নাই। বরং ক্লাসে কখনও ডিসিপ্লিনারি ইস্যুতে কঠোর হতে হলেও শেষে তিনি বলতেন, ‘মেয়েদের ব্যাপারে আমার কোনো অভিযোগ নাই। তাদের উদ্দেশ্যে আমি এগুলো বলছি না।’
উনি গার্মেন্টস ব্যবসায়ীও। নিশ্চয়ই বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে তার নিয়মিত যাতায়াত। যেখানে নারীর অংশীদারিত্ব, প্রতিনিধিত্ব, কর্মপরিধি নিয়ে তার অভিজ্ঞতা বেশ বিস্তৃত। বিজিএমইর সাবেক প্রেসিডেন্ট রুবানা হক সঙ্গে তার পেশাগত সুসম্পর্ক থাকার কথা। এত দেশি বিদেশি নারী সহকর্মী, নারী ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, অর্থনীতির অত্যন্ত মেধাবী নারী শিক্ষকদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আলোকিত ভদ্রলোক কেন নারীকে বিয়ের পিঁড়ির শেকলে বাঁধলেন তাও আবার সান্ধ্য আইনের বাঁধনে? যদিও এই একটি মাত্র মন্তব্যে তার মাত্রাহীনতায় নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে উঠছে।
সবচেয়ে বড় কথা পদত্যাগেই কি চরম সার্থকতা? মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারও শ্রেষ্ঠ বাঙালির জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আমেরিকাকে পদতলিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। লোকে বলেছিল শাহজালালের তীর্থভূমির উপর যে বিশেষ রহমত আছে তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। এখন তো দেখি তার ব্যাপারে একটা শব্দ মানেই কমেন্ট সেকশনে খিস্তির মহোৎসব। তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে স্বপ্নের সেই নায়ক—তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম?
আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ পড়লাম সম্প্রতি। আপনারাও পড়ুন। উপাচার্য বিত্তান্ত সম্পর্কে ভালো ধারণা পাবেন। আর মোটামুটি সুযোগ পেলে তো সব মেধাপাচারই হয়ে যাবে। অযথা এই অনাহারে স্বাস্থ্য নষ্ট করে কী লাভ? কাকে চান আপনারা? আমাদের দেশের সেই ছেলেটার কিংবা মেয়েটার নাম কী?
‘আমাদের গাধাগুলো ঘোড়া হয়ে গেলো
ঘোড়াগুলো গাধা,
আমাদের স্বপ্নগুলো ঘোর হয়ে গেলো
না কৃষ্ণ না রাধা।’
অনেক পুরনো কবিতা। কে লিখেছিলেন মনে নেই। অনেক আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম। কিছুই বদলায় নাই, তাই পুরনোই চিরসবুজ। মা বাবা বলে না? ‘অ্যাডজাস্ট করো’। অভিজ্ঞতার আলোকেই বলে। একদিন তাদের চরণতলাতেও মূর্ছে তুফান, ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়বাদল ছিল। সময়ের সঙ্গে তারাও থিতু হয়েছেন।
অতএব অ্যাডজাস্ট করে নিন— সংলাপে, সময়ে, সমঝোতায়। তাড়াতাড়ি পাশ করুন। জানি সুমন বলেছে, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে/দেখা হবে তোমার আমার অন্য গানের ভোরে।’ সেই ভোর হয়তো আসবে, কিন্তু অন্য টাইম জোনে।
লেখক: গ্রামীণফোন কর্মকর্তা
সারাবাংলা/আইই