পাঠক টানতে বদলাতে হবে গ্রন্থাগারকেও
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৬:৪৯
জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস এলো আবার। ১৯৫৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির দ্বার উন্মোচিত হয়। এ দিনটিকেই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রন্থাগারকে জনপ্রিয় করা, গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণা করেন। ২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ বছর জাতির গ্রন্থাগার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সুবর্ণ জয়ন্তীর অঙ্গীকার, ডিজিটাল গ্রন্থাগার।’
জ্ঞানের আধার হলো বই, আর বইয়ের আবাসস্থল হলো গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি। একটি জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরির ভূমিকা অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই পুঁথি সংরক্ষণের প্রথা ছিল। এসব পুঁথি লেখা হতো তালপাতায়, গাছের বাকলে, পশুর চামড়ায়, আবার কখনো পাথরে ও টেরাকোটা পদ্ধতিতে। সাধারণত এই পুঁথিগুলো সংরক্ষণ করা হতো বিভিন্ন ধর্মগৃহে বা বিহারে অথবা উপসনালয়ে।
তবে বিশ্বের প্রথম লাইব্রেরির ধারণা শুরু করা হয়েছিল প্রাচীন মিশরে। তখন উপাসনার পাশাপাশি তাত্ত্বিক আলোচনা বা জ্ঞান প্রসারের জন্য পুরোহিতদের নিজেদের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস বা তথ্য সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সে থেকে মিশরের এক মন্দিরে শুরু লাইব্রেরি। সভ্যতার ক্রমশ অগ্রসর হওয়ার পথে মানুষ তার উপাসনালয়ে সংরক্ষণ করা শুরু করল। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া, ইরাকের বাগদাদ, দামেস্ক, প্রাচীন গ্রিস ও রোমে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের নিদর্শন পাওয়া যায়। এছাড়া উপমহাদেশের তক্ষশীলা ও নালন্দায় সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল।
আব্বাসীয় ও উমাইয়া শাসনামলে ‘দারুল হকিমা’ নামক গ্রন্থাগার ইউরোপকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছে। সমকালীন মিশরের ‘বাইতুল হিকমা’ও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেছে। যুগে যুগে গ্রন্থাগারগুলো গড়ে উঠেছিল রাজদরবার ও ধর্মীয় উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে।
পৃথিবীর বিখ্যাত গ্রন্থাগারসমূহের মধ্যে প্রথমেই আসে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে’র নাম। আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত এই লাইব্রেরিতে রয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ বইয়ের এক বিশাল সমাহার। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামও পৃথিবীর বিখ্যাত লাইব্রেরির মধ্যে অন্যতম। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বডলিন লাইব্রেরি’তে রয়েছে এক কোটিরও বেশি গ্রন্থ।
এছাড়া পৃথিবীর প্রাচীনতম লাইব্রেরির মধ্যে রয়েছে ‘ভ্যাটিকান লাইব্রেরি’। এ ছাড়াও ফ্রান্সের বিবলিওথিক লাইব্রেরি, মস্কোর লেনিন লাইব্রেরি ও কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি উল্লেখযোগ্য। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিও পৃথিবীর প্রাচীন লাইব্রেরির মধ্যে অন্যতম—যা এক সময় পৃথিবীর সপ্তাচার্যের মধ্যেও ছিল।
লাইব্রেরির বিভিন্ন প্রকারভেদের মধ্যে জাতীয় গ্রন্থাগার অন্যতম। জাতীয় গ্রন্থাগার সাধারণত দেশের সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। অন্যান্য গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার পেছনে যে সকল কারণ বিদ্যমান, এ ক্ষেত্রেও তার সবগুলো কারণ বিদ্যমান। তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আর এটি হয় এজন্য যে, জাতীয় পর্যায়ের গ্রন্থাগার অন্য আর দশটি অনুরূপ প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জাতীয় গ্রন্থাগার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার সংগ্রহের পরিধি জাতীয়ভিত্তিক, গুরুত্ব আন্তর্জাতিক এবং দেশ ও জাতি সম্পর্কে দেশি-বিদেশি সকল প্রকাশনা সংগ্রহ করে জাতীয় ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করাই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৯৭২ সালের ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ৫ লাখেরও অধিক বইয়ের সংগ্রহশালা রয়েছে। এ ছাড়াও ১৯৫১ সাল থেকে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং আঞ্চলিকসহ বিভিন্ন সংবাদপত্র ও দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা রয়েছে এ গ্রন্থাগারে।
২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর দেশব্যাপী জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালনের তাৎপর্য দেশের মানুষকে, বর্তমান প্রজন্মকে বইপড়ায়, জ্ঞানচর্চায়, মুক্তচিন্তার চর্চায় কতটুকু উদ্বুদ্ধ করতে পারছে; সার্বিকভাবে এ দিবস কতটুকু ফলপ্রসূ—সে প্রশ্ন না উঠে পারে না। দেশের বেশিরভাগ মানুষই এ দিবস সম্পর্কে অবগত নন। দেশের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে দিনদিন বইবিমুখতা বেড়েই চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও নেই বইপড়ার চর্চা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা। নেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ। শুধু গাইড মুখস্থ নির্ভর আর সরকারি আমলা হওয়ার প্রতিযোগিতায় বিভোর হয়ে আছে প্রজন্ম।
জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠন ব্যতীত আমাদের পরিপূর্ণ মুক্তি বা সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। বইবিমুখ সৃজনশীলতা বিবর্জিত একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে। এমন প্রজন্ম পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবার জন্যই অকল্যাণকর। বই ছেড়ে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেন অন্য কিছু নিয়েই আছে। অথচ বিপুল সংখ্যক এ প্রজন্ম নিয়ে যেন ভাবার কেউ নেই! তরুণ প্রজন্মই দেশ ও জাতির গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। তরুণ প্রজন্মের সঠিক পরিচর্যার উপর করে দেশের ভবিষ্যত।
গ্রন্থাগার আমাদের আলোর পথের নীরব পথপ্রদর্শক। সমৃদ্ধ জাতি গঠনে গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরির বিকল্প নেই। শূন্যতায় হাহাকার করা গ্রন্থাগারগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় আমাদের জ্ঞানচর্চার, মুক্তচিন্তার দীনতা। জ্ঞান, বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ আলোকিত প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য গ্রন্থাগারগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সোজা কথায়, পাঠক টানতে বদলাতে হবে গ্রন্থাগারগুলোকে। পুরনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করে গ্রন্থাগারগুলোকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করতে হবে।
প্রজন্মকে বইপড়ায় জ্ঞানচর্চায় মুক্তচিন্তায় উৎসাহিত করতে হবে এবং তার জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিটি জেলায় একটি মডেল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে অনেক মডেল মসজিদ মন্দির স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু একটিও কি মডেল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? অথচ এই লাইব্রেরি আমাদের বাতিঘর। আমরা আমাদের বাতিঘরকে হারাতে বসেছি বলেই আমাদের আজ এই করুণ দশা। আমাদের সমৃদ্ধির পথে এগুতে হলে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, লাইব্রেরির গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই