Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কোটা সংস্কার আন্দোলন, সাফল্য-ব্যর্থতার আদ্যোপান্ত


১২ এপ্রিল ২০১৮ ১৭:৫০

।। রফিকুল্লাহ রোমেল ।।

কোটা সংস্কার ও অন্যান্য বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী গতকাল যে ভাষণটি দিয়েছেন সেটি বাস্তবায়নের পথপরিক্রমার পুরো চিত্র বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে। এর আগে ছাত্রসংগঠনের নেতাদের বরাতে বলা হয়েছে, কোটা পদ্ধতি বাতিল হয়ে যাবে। বাতিল হয়ে যাক অথবা ব্যাপক সংস্কারই হোক— একটা পরিবর্তন আসছেই। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে এটি স্পষ্ট এবং শতভাগ পরিষ্কার।

দেশের প্রধানমন্ত্রী হুট করে কোনো কাজ করতে পারেন না। সংসদীয় ও সাংবিধানিক রীতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কাজের একটি পদ্ধতি আছে। তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী যথাসময়ে হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব।

প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার করে বলেছেন, সমাধান বের করাই তার উদ্দেশ্য। যে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি শুরুর দরকার ছিল, সেটা তিনি সংসদ নেতা হিসেবে নিয়েছেন। ভুলে গেলে চলবে না, সরকারি চাকরি এতটা আকর্ষণীয় হওয়ার পেছনে শেখ হাসিনার ভূমিকাই মুখ্য।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের শুভেচ্ছা। তাদের দাবির প্রতি সরকারের সর্বোচ্চ মহলের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। তবে সেটা গত কদিনের আন্দোলনের আগেই হয়েছে।

মাস চারেক আগেই আমি বলেছিলাম, কোটা সংস্কারের দাবিটা যৌক্তিক এবং সময়ের দাবি। এ দাবি আইন সংস্কার বা নতুন প্রজ্ঞাপন জারির দাবি রাখে। এটি অর্জন করার জন্য শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক ও আইনমাফিক প্রক্রিয়ায় এগোতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ ছিল এই আন্দোলনে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া, পরিস্থিতির যাতে অবনতি না হয়, সেটা খেয়াল রাখা। ছাত্র সংগঠন ও  সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের দায়িত্ব ছিল এ দাবির পক্ষে বিপক্ষে যারাই থাকুন— সবাইকে সম্পৃক্ত করা, আলোচনা ও দরকষাকষি করা এবং সেই প্রতিক্রিয়া ও ফলাফলগুলো পৌঁছে দেওয়া। গণমাধ্যমের কাজ ছিল নির্ভুলভাবে এই ঘটনাগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরা।

বিজ্ঞাপন

তবে এ আন্দোলনের শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব থেকে সরে গেছে বলে আমার ধারণা। আন্দোলনের ভেতরে আলামত যাই থাকুক, পুলিশ যে আন্দোলনকারীদের প্রতি বেশ নির্মম হয়েছিল সেটি স্পষ্ট। এদিকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত অতি উৎসাহী কিছু ছাত্রলীগকর্মী বা নেতা যা করেছেন সেটিও কোনো সূত্রে পড়ে না। মারামারি করা, আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হওয়া এবং হলে হলে আন্দোলনকারীদের ধরে ধরে পেটানো সেইসব নেতাকর্মীদের মানসিক সুস্থতা এবং তাদের রাজনৈতিক পারঙ্গমতাকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আর এই বিষয়গুলোই আন্দোলনের রূপরেখাকে অশান্তই করেনি চরম অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে। আর এ সুযোগে রাজনৈতিক ফায়দাবাজরা সক্রিয় হয়েছে।

আন্দোলনের এ ক’দিনে যেভাবে সংঘবদ্ধ প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে তার সঙ্গে `শেখ কামালের ব্যাংক লুট’, `বিডিআরে ২৫০ অফিসার হত্যা’, `৫ মে রাতে বিশ হাজার আলেম হত্যা’র গুজবের হুবহু মিল আছে।  প্রাথমিক অনুসন্ধানে ওই ঘটনাগুলোর সঙ্গে এটি যে একসূত্রে গাঁথা সেই প্রমাণও মিলেছে। এবার এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে।  প্রথম দিনেই লাশ পড়ে গেছে’। দ্বিতীয় দিন `লাইট বন্ধ করে ছাত্রীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে’। এর পরের দিন রাতে সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রীর `পায়ের রগ কেটে ফেলা হচ্ছে’- এ প্রোপাগান্ডাগুলো কোনো সংস্কার আন্দোলনের নয়।  আবার এই প্রোপাগান্ডা এই পর্যায়ে ছড়িয়ে যাওয়ার দায় কোনোভাবেই সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতারা এড়াতে পারবে না।

সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগের এক নেত্রী সাধারণ ছাত্রীদের নির্যাতন করেছিলেন বলে জানা গেছে। সেই রাতে গুজব ছড়ায় ছাত্রলীগের সেই নেত্রী সাধারণ ছাত্রীর কেটে দিয়েছেন। ওই রাতেই তাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং যাওয়ার সময়ে ওই নেত্রীর কাপড়চোপড়ও টেনে খুলে ফেলা হয়েছে। যারা এই ভাবে ‘শত্রুকে’ বিস্তৃত করতে পারে তারা যখন সরকারি চাকরিতে যাবেন, তখন কী ভুমিকায় থাকবেন আসলে!

বিজ্ঞাপন

আন্দোলনকারীদের কিছু অংশ মূল আন্দোলনের সীমারেখাও ভঙ্গ করেছে।  শ্লোগান এসেছে ও রাস্তায় প্ল্যাকার্ডেও দেখা গেছে অশালীন শব্দাবলি। ‘টিয়ার গ্যাস চুদি না’, ‘মিডিয়ার … মার’ প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে এই আন্দোলনে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক আন্দোলনেও এই অশালীন শব্দ দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের আন্দোলনে এই শব্দগুলোর ব্যবহার একেবারেই নতুন। যারা এই ধরনের স্লোগান অন্তরে ধারণ করেন, তিনি কি নিজেকে মেধাবী হিসেবে চাকরির যোগ্য মনে করেন? অগ্রজ একজন সাংবাদিক যার রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন থাকতেই পারে। তাকে বিশ্রী ভাষায় তুই-তোকারি করে গালাগাল কি ছাত্ররা বা আন্দোলনকারীরা দিতে পারেন? রাজনৈতিক কর্মীদের ভাষাও এতোটা আশালীন ও কদর্য হওয়ার নজির এ দেশে নেই।

এছাড়া সবকিছুই সরলীকরণ করে ফেলাটাও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে আজকাল। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দায় যেমন সকল মুসলমানের নয় তেমনি গত চার দিনে যা হয়েছে তার দায় ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগই কেন নেবে! আর যে সঙ্ঘবদ্ধ প্রচারণা চলছে, ‘আন্দোলনকারীদের সবই খারাপ’ এটাই বা কেমন কথা! পাশাপাশি গণহারে রাজাকার, দালাল এসব বলার প্রবণতাও বেড়েছে অনেক। বর্ষীয়ান নেতা মতিয়া চৌধুরীর একটি বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচার করে তাকে গালিগালাজ করাটাও এক ধরনের বালখিল্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

মোটাদাগে বলতে গেলে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে আমরা বিভাজিত এবং বিভৎস মাত্রায় স্বতন্ত্র ও নিজের মতামত প্রকাশে বিশ্বাসী। কোনোভাবেই অন্যপক্ষকে সহ্য করার প্রবণতাই আমাদের নেই। আমরা বলতে পছন্দ করি আন্দোলনমাত্রই অহিংস, অরাজনৈতিক। আসলেই তাই কী?

উনসত্তর, নব্বই, দুই হাজার তের–সব আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কি একইরকম? একটার সঙ্গে কি আরেকটার তুলনা করা যায়! শামসুন্নাহার হলে মেয়েদের হলে হলে ঢুকে পুলিশ যখন ছাত্রীদের উৎপীড়ন করেছিল, সেনারা যখন ঢাবির জিমনেশিয়ামে লাথি মেরেছিল নিরীহ ছাত্রদের— সেই ঘটনাগুলো আর সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো কি হুবহু এক? এইসব কি একই প্রতিক্রিয়ার দাবি রাখে?

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, আন্দোলনের শুরুতে দাবিগুলো কি স্পষ্ট ছিল? দাবির পেছনে যৌক্তিক বৈধতা কি ভিন্নমত বা যুক্তিকে ঠিকভাবে খণ্ডন করতে পারে? সরকারের কাছে দাবি পৌঁছে দেওয়ার মতো নেতৃত্ব কি এই আন্দোলন পেয়েছে? এই আন্দোলনকে যারা রুখতে এসেছিল তারা কি সরকারের কাছ থেকে কোনো নির্দেশ পেয়েছে? হঠকারীর মতো গুণ্ডামো কেন করতে গেল তারা?

একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে প্রশ্ন আসে, এটা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে পদচ্যুত করার ছদ্ম আন্দোলন? কারণ একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে, প্রশ্ন ওঠে ঢাবির ভিসি একজন ব্যর্থ প্রশাসক।  আবার স্লোগান ও কথা আসে, সরকারের অনেক ত্রুটি আছে।  এটা কি তবে সরকার ফেলার আন্দোলন? অনেক প্রশ্ন এখনো অমিমাংসিত।

কোটা সংস্কার আন্দোলনটির লক্ষ্য বারবার সরে গেছে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কাছে। এরা সরাসরি চাকরি প্রার্থী নয়। এই আন্দোলনের রেশ বেশিরভাগ মানুষের কাছেই সরকারবিরোধী।  এই কারণে আন্দোলনে একটি অংশ উৎসাহী, আরেক অংশ নিরুৎসাহী।  এই যে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু বারবার সরে যাওয়া এটি একটি ব্যর্থতা। এটি আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং অসততাও বটে।

সাদাচোখে দেখলে বোঝা যায়, দ্বন্দ্ববিহীন আন্দোলনে সহিংসতা সম্পৃক্ত করেছে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী।  আর একে চরম উৎসাহে প্রয়োগ করে গেছে আন্দোলনকারীরা। একপর্যায়ে আন্দোলনের কেন্দ্র থেকে সচেতনভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানও করা হয়েছে।!

এর কারণে এখন যা হবার তা-ই হয়ে গেছে হয়ত।  আমি আশ্চর্য হবো না, যদি এখন পুরো কোটা প্রথাই বাতিল হয়ে যায়। এতে আরেকটি আন্দোলনের সূচনা হবে। কোটা চালুর আন্দোলন। এবং সেই আন্দোলনও অনিবার্যভাবে ভুল রাস্তায় হাঁটবে। সেখানেও মারামারি থাকবে। এবার আর সরকার নয়, ত্রিপক্ষীয় মারামারি। সেখানেও দুইপক্ষেই রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী শক্তি জড়িত থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক সমাধান হবে।

আমি মনে করি না দাবি মেনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরে আন্দোলনকারীদের জয় হয়েছে।  নৈতিকতা বিবেচনায় এরা ছাত্রলীগের চেয়ে পিছিয়ে। কিন্তু খুব পিছিয়ে নেই। মিডিয়াকে গালি দিয়ে, প্রতিপক্ষের জামা ছিঁড়ে তার শরীর দেখানো, ক্রমাগত গুজবে বাহবা হাততালি দিয়ে সেই হাসিঠাট্টাগুলোকে ভাইরাল করা- কোনোখানেই এরা পিছিয়ে নেই।!

বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাম্যের কথা বলে যে ঘটনাগুলো ঘটল, সেই সাম্য আসবে কি না সেটা সময়ই বলে দেবে।  তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, তিনি বিরক্ত এবং ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন।

আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে ভাড়াটে লোক থাকবেই। একটা দল কানসাট, সুন্দরবন, শাহবাগ, কোটাসংস্কার- সব আন্দোলনই করে। এরা মূলত আন্দোলনের সময়কার সরকারবিরোধী রাজনৈতিক ভাড়াটে। কিন্তু আন্দোলনের মূল দলকে সব নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং নেতৃত্ব দিতে হয়। নেতৃত্ব ছুটে গেলে মূল দলটির কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ভাড়াটেরা নেতৃত্বে এসে মূল দলের কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন কোনোদিন করেনি করবেও না।  আর ফলাফল- মাৎস্যন্যায়!

কোটা সংস্কারের এই আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির ব্যবহার বেশ চমকপ্রদ।  আন্দোলনকারীদের হাতে শোভা পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।  কেউ, কেউ তার ঐতিহাসিক ভাষণ নকল ও ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না…’। আবার পরমূহুর্তেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, ‘আমাদের মারতে ঢাকা কলেজ থেকে গুন্ডা আসছে। শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন…।  কী অদ্ভুত বৈপরীত্য!

অদ্ভুত এই সময়ে এসে অনেকেই বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আর তাজউদ্দীন আহমদরা কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ সফল করেছিলেন।  যারা এমন বলেন ও অন্তরে ধারণ করেন, তাদের বশংবদরা উত্তরপ্রজন্মে সংখ্যায় বাড়ছে। এই বশংবদরা বোঝে না, অসংখ্য মিথ্যে প্রোপাগান্ডার বিপরীতে একটি তর্জনির কত জোর!

আন্দোলন আর সরাসরি যুদ্ধের মধ্যে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য না বুঝলে আন্দোলন আর যুদ্ধের মধ্যে টক্কর লাগবেই। ফলশ্রুতিতে সমান্তরাল ক্ষয়ক্ষতি হবে অপরিসীম।

তবে যাই হোক না কেন, যৌক্তিক দাবি কোটা সংস্কার হোক। যে কোনো অন্যায়ের প্রতিরোধ হোক। দীর্ঘজীবি হোক তারুণ্য। আরো পরিণত ও যৌক্তিক হোক তারুণ্যের শক্তি।

লেখক : ম্যানেজিং এডিটর, সারাবাংলা ডটনেট

সারাবাংলা/ এসবি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর