Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমারই বাংলা ভাষা

আঞ্জুমান রোজী
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৪:৫৩

পৃথিবীর প্রকৃতি আমার কাছে বাংলাদেশের প্রকৃতির রঙ রূপের মতো মনে হয়। যেখানেই যাই না কেন, বাংলাদেশের রূপ খুঁজি। কি জলে, কি স্থলে, গাছের ছায়ায়, সবুজ বনানীর তরুলতায়  বাংলাদেশের ঘ্রাণ নেই; যা অবচেতনভাবে মনে আসে। বাংলাদেশের সবকিছু আমার এতটাই মজ্জাগত যে, দেশের যেকোনো উছিলায় আবেগী হয়ে উঠি। হয়ে উঠি উত্তেজিত। দেশের বিশেষ বিশেষ জাতীয় দিনগুলো হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা সত্ত্বেও আমাকে আলোড়িত করে, করে আবেগতাড়িত। সেই সাথে টান পড়ে অনুভূতির শিকড়ে। আয়নায় নিজেকে না দেখে, দেখি বাংলাদেশকে। স্বপ্নে নয় বাস্তবেই অনুভব করি, আমি এখনো বাংলাদেশে আছি।

বিজ্ঞাপন

নিজ দেশের প্রতি দুর্বলতা দেখেছি আমার আব্বার মধ্যে। দেশকে বলেছিলেন, ‘আমার মা’। শৈশবের স্মৃতিগুলো হাতড়ালে এখনও বাবার কথা কানে ভাসে। চোখে ভাসে ছোট ছোট অনেক ঘটনা। বাবা বাংলা শুদ্ধ করে অর্থাৎ প্রমিত ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করতেন। বাসার মধ্যে কোনো আঞ্চলিকতা ছিল না। আমাদেরকে শুদ্ধ এবং পরিপাটি বাঙালি বানানোর জন্য সদা সচেষ্ট থাকতেন। কখনই  বুঝিনি, পৃথিবীর যে প্রান্তেই যা-ই না কেন, সেখানে আমার স্বকীয়তা নিজস্বতা বিকিয়ে দিতে হবে। কখনোই এমন শিক্ষা পাইনি, এমনকি অনুভূতিতেও আসেনি। পুরো বাঙালিয়ানায় আমার বাঙালিত্ব রয়ে গেল শিকড়জুড়ে।

বিজ্ঞাপন

দেশ ছেড়েছি অনেক অনেক বছর হয়ে গেলো। হয়েছি কানাডা প্রবাসী। থাকি পৃথিবীর  বিভিন্ন দেশের জাতিগোষ্ঠীর অভিবাসী শহর টরন্টোতে। আমার সৌভাগ্য যে এমন একটা শহরে থেকে পুরো বিশ্ব দেখি। বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিজেকে আবিস্কার করি। বুঝতে পারি, মানুষ মাত্রই একই আবেগতাড়িত প্রাণী। তাদের অনুভূতি যখন আমাকে ছুঁয়ে যায় তখন ভাবি নিশ্চয়ই সে ও আমাকে অনুভব করতে পারছে এবং এই সাড়া খুব সহজেই পেয়ে যাই। কথার ছলে সহকর্মী থেকে শুরু করে যে কোনো দেশের মানুষের সাথে পরিচয় হলে যতটা না তার নিজের দেশ সম্পর্কে জানি, তারচে দেশের কথা বেশি বলতে চেষ্টা করি। খুব অদ্ভুত বিষয় হলো এরাও মন দিয়ে শুনে, তখন ভীষণ গর্ববোধ করি।

কানাডায় প্রায় প্রতি মাসে একটা দীর্ঘ সপ্তাহন্ত থাকে, যাকে এখানে ‘লং উইকএন্ড’ বলে। কোনো কোনো মাসে ছুটিটাকে সোমবার করে লং উইক্যান্ড করে দেয়। তেমনি এ বছর (২০২২) ফেব্রুয়ারী মাসে ‘ফ্যামিলি ডে’ অর্থাৎ পরিবার দিবস নামে একটা ছুটি পড়ে যায় ২১ ফেব্রুয়ারিতে। বিষয়টা বাঙালি কমিউনিটির জন্য অবশ্যই আনন্দের ছিল। আর আমিও সেই সুবাদে কাজের জায়গায় বাংলা ভাষার ইতিহাস বলতে থাকি। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য কত যে তাৎপর্যপূর্ণ তা বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করি। আমার আবেগ, আমার উত্তেজিত কণ্ঠস্বরের উঠা-নামায় ওরা বুঝে নেয় দিনটি আমাদের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টা হল এমন, আমি আছি সবার মাঝে, সব দেশের মাঝে আছে আমার বাংলাদেশ। এমন অনুভূতি, বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে হলে, সেই বিষয় আত্মস্থ করার জন্য প্রথম শর্তই হলো মাতৃভাষার চর্চা করা এবং আমি তারই প্রতিধ্বনি।

মনের ভাব বুঝতে হলে বা প্রকাশ করতে গেলে অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক বিষয় বা মনন চর্চার বিষয় আসে মায়ের ভাষা থেকে। এ কথা গুণী বিদগ্ধজনেরা বিশেষভাবে বলে গেছেন। অর্থাৎ মাতৃভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিস্কার করার পথ তৈরি হয় এবং সেই আবিস্কারের অর্থ হলো আরও নতুন নতুন ভাষা, মানুষ, দেশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করা। কারণ, মানুষে মানুষে ভাব আদান-প্রদানের মনস্তাত্ত্বিক সেতুবন্ধন তৈরি করে দেয় মাতৃভাষার চর্চা। এক্ষেত্রে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছেন, ‘মাতা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি যারা অনুরাগহীন তারা পশু বিশেষ।  বিদেশী ভাষার মাধ্যমে শিক্ষায় তোতা পাখির মতো মুখস্থ শক্তি যেমন বাড়ে সে পরিমাণ মস্তিষ্কের শক্তি বাড়ে না।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা উক্তি এখানে না উল্লেখ করলেই নয়। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের মধ্যে যাহা কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা কিছু অমর করিবে সেই সকল মহাশক্তিকে ধারণ করিবার, পোষণ করিবার, প্রকাশ করিবার এবং সর্বত্র প্রচার করিবার একমাত্র উপায় যে মাতৃভাষা।’ রবীন্দ্রনাথের আরও একটি উক্তি এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। তা হল- “কোনো শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়। যে ভাষা দেশের সর্বত্র সমীরিত অন্তঃপুরের অসূর্যস্পশ্য কক্ষেও যাহার নিষেধ নাই, যাহাতে সমস্ত জাতির মানসিক নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিষ্পন্ন হইতেছে, শিক্ষাকে সেই ভাষার মধ্যে মিশ্রিত করিলে তবে সে সমস্ত জাতির রক্তকে বিশুদ্ধ করিতে পারে, সমস্ত জাতির জীবন ক্রিয়ার সহিত তাহার যোগ সাধন হয়।” তিনি আরো বলেন, “ইংরেজি হলো কাজের জন্য, মাতৃভাষা হল ভাবের।”

প্রাসঙ্গিকভাবে মাতৃভাষার উপর সকল বিজ্ঞ জনই জোর দিয়ে গেছেন। আমিও সেই আঙ্গিকে এবং বিশ্বাসে বাংলা শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে চলেছি। তাতে যদি দোষ হয় অর্থাৎ প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় বলি,“বাঙালি প্যাট্রিয়টিজমকে মনে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়াটা যদি দোষের হয় তাহলে সেই দোষে আমি চিরদিনই দোষী আছি।” আমিও সেই দোষে দোষী হয়ে বলি, আমি বাংলাদেশের বাঙালি। বাংলা আমার মাতৃভাষা। আমার বেড়ে উঠা, শিক্ষা এবং চিন্তা-চেতনার বিকাশ বাংলা ভাষা ও বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আবর্তে; এসব লালন করে বয়ে বেড়াই। সর্বাবস্থায় এবং সর্ব জায়গায় আমার পরিচয় বাঙালি বলে তুলে ধরি। শুধু আমি বাঙালি, এইটুকুতে থেমে যাই না। বুঝিয়ে দিতে চাই কোথা থেকে এসেছি। সেইসাথে আমার দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ইতিবৃত্তান্ত তুলে ধরি। অবশ্যই এসব বলার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। আমার বিশ্বাস প্রবাসে সকল বাঙালি এই ভূমিকা রাখেন।

সবশেষে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি দিয়ে উক্তি দিয়ে পরিসমাপ্তি টানছি। “মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোনো ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া পরাণ আকুল করে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোনো ভাষার ধ্বনির জন্য প্রবাসীর কান পিয়াসী থাকে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষার কল্পনা সুন্দর তাহার মন-মজান ভাবের ছবি আঁকে? কাহার হৃদয় এতো পাষাণ যে মাতৃভাষার অনুরাগ তাহাতে জাগে না? পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করিয়া দেখো মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত কোনো জাতি কখনো কি বড় হইতে পারিয়াছে?”

লেখক: কবি, সাহিত্যিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

আঞ্জুমান রোজী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর