ভর্তুকির লাগাম টান: এরপর কোন ফরমান?
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১১:০৮
বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বিষয়ে শিগগিরই কোনো সরকারি ফরমান আসছে- উড়ো কথা বা গুজবের মতো কিছুদিন ধরে ভাসছিল কথাটি। বিশেষ করে সারের ভর্তুকি টানতে সরকার কাহিল হয়ে পড়ছে –গত সপ্তাহে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের এমন মন্তব্যে গুজবটা বাস্তবের আনুষ্ঠানিকতার দিকে যেতে বেশি সময় লাগেনি। এরপরই এলো প্রধানমন্ত্রীর বার্তা। অপচয় রোধ ও চুরি ঠেকাতে পর্যায়ক্রমে গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যিক খাত বিশেষ করে যেখানে বড় বড় শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে এসব স্থানে ধীরে ধীরে গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে। বাতকে বাত বা কথার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশটি দিয়েছেন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেকের সভায়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জানান দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান। প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে তিনি সোজাসাপ্টা বলেছেন, বড় বড় খাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবহারকারীরা গরিব নন। গুলশানে বসবাসকারীরা গরিব নন।
কথাবার্তা একদম পরিস্কার। প্রাথমিকভাবে বড় বড় শিল্প খাতের গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনার কথা জানানো হলেও এর আওতা বাড়বে। নির্দেশের মতো করে প্রধানমন্ত্রী আরো বিভিন্ন খাতেও ভর্তুকি কমানোর বুদ্ধি বের করতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বরাত ও উদৃতি দিয়ে বলতে-বলতে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেই ফেলেছেন, ভর্তুকি এক ধরনের ভিক্ষা। তা কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে না। ভর্তুকি কোনো সমাধানও নয়। তাই ধীরে ধীরে গ্যাস-বিদ্যুতের ভর্তুকি থেকে সরে আসতে হবে। তবে কৃষি ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি অব্যাহত থাকবে। তবে বড়লোকদের জন্য ধীরে ধীরে ভর্তুকি উঠে যাবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, বড় লোক- ছোট লোক বাছবিচারের প্রেক্ষিত থাকলেও নির্ণয়ের ব্যবস্থা নেই। কৃষি ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি অব্যাহত রাখার ইচ্ছার কথা পরিকল্পণামন্ত্রী জানালেও কৃষিমন্ত্রীর গত সপ্তাহের ইঙ্গিতে ভিন্নতা ছিল। ভর্তুকি নিয়ে সরকারের পেরেশানির কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এ বছর দেশে সারের ভর্তুকিতে লাগবে ২৮ হাজার কোটি টাকা। যা গতবছরের তুলনায় প্রায় চারগুণ। এও জানান, পৃথিবীর কোথাও এতো ভর্তুকি দেওয়ার উদাহরণ নেই। বছরে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে আরেকটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। ভর্তুকি কমাতে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপের কথাও বাদ রাখেননি কৃষিমন্ত্রী। কিন্তু, সময়টা খারাপ। বাস্তবতার সঙ্গে বেমানান। গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্গে বহু কিছুর সম্পর্ক। খাদ্য-ভোগ্যসহ সব পণ্যের দামের সঙ্গে এর সবিশেষ সম্পর্ক। পরিবহণ ভাড়াসহ আরো অনেক কিছুর সংযোগ গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্গে । এমনিতেই নিত্যপণ্যের দামের তেজিভাব। কেবল দেশে নয়, বিদেশেও। বা গোটা বিশ্বেই। সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তবে, চেষ্টা করছে। না কুলাতে পেরে হাল ছেড়ে দেয়ার মতো বাণিজ্যমন্ত্রী বলে বসেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, ডাল, চিনির দাম বেড়েছে। সমুদ্রপথে বেড়েছে জাহাজের ভাড়া। এ কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারেও এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বাজার অর্থনীতিতে এ ক্ষেত্রে সরকারের করনীয় কিছু নেই -এমন যুক্তিও ছাড়া হয়েছে নতুন করে। কিন্তু করনীয় না থাকলেও করার চেষ্টা করা হচ্ছে। হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। বাজার তদারকিতে মার্চ থেকে বিশেষ টিম নামানোর প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। কথার সঙ্গে কাজের এ ফারাক বাস্তবতার নিষ্ঠুরতার মতো।
খাদ্য-ভোগ্য সব পণ্যেরই বিশ্বজুড়ে বাজার চড়া। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ক্রেতামহলে। ক্ষোভ-বিক্ষোভও কোনো কোনো দেশে। মূল্যবৃদ্ধির সেই আঁচ বাংলাদেশেও। সময়টা বড় সঙ্গীন। এমনিতে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে টানা কয়েক মাস ধরে। তা চরম সংকটে ফেলেছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষকে। টিসিবির একটি ট্রাক দেখলেই পিছু নিচ্ছে শতশত নারী-পুরুষ। মাস্কের ঢাকনায় বোঝার উপায় নেই কে কোন বিত্তের। নিম্ন না মধ্য। নাকি উচ্চবিত্তের বলে কথিত কেউ কেউও মাথা নিচু করে লুকিয়ে আছেন টিসিবির ট্রাকের পেছনে। একসময় বিশ্বব্যাংকের চাপে রেশনিং বন্ধ করা হয়েছিল। এখন সেই প্রশ্ন ভর্তুকি নিয়ে। সামনে আরো কোন ফরমান অপেক্ষা করছে, সেটা ভবিষ্যত। সামনেই রমজান মাস। সংযমের মাস রমজান এলেই বাজারে নতুন করে আগুন লাগে। এবার তা লেগেছে আগাম লেলিহানে। নিত্যপণ্যের দাম এখন যে আকাশে চড়েছে, তা রমজানে কোন আসমানে উঠবে বা উঠতে পারে- ভেবে কুলকিনারা পাওয়া কঠিন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই
নিত্যপণ্যের দাম বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ভর্তুকি মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি মোস্তফা কামাল সংযমের মাস