সর্বজনীন পেনশন, জনকল্যাণমুখী এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:৩৮
সরকারি চাকরিজীবীদের বাইরে দেশের নাগরিকদের পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে যাচ্ছে সরকার। দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে সরকার পরিকল্পনা হচ্ছে আগামী এক বছরের মধ্যে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা হবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে সরকার এরই মধ্যে কৌশলপত্র তৈরি করেছে। আইন ও বিধি প্রণয়ন এবং তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করবে সরকার।
সর্বজনীন পেনশনের সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক হলেও বর্তমান বাস্তবতায় এটি আওয়ামী লীগ সরকারের জনকল্যাণমুখী এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় মানুষের জন্য এটি একটি সুখবর। উন্নত অনেক দেশের মতোই এ ব্যবস্থা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ও অবকাঠামোবদ্ধ বিধির মাধ্যমে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক পরিবর্তনে একটি নতুন দিকের সূচনা হবে।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার ওপর একটি কৌশলপত্র তৈরি করে গত সপ্তাহে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে শিগগিরই আইন প্রণয়ন করতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশ দেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। এই কৌশলপত্রের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। মোদ্দা কথা ধরলে, জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব কর্মক্ষম নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরাও। আপাতত এই ব্যবস্থা থাকছে বেসরকারি নাগরিকদের জন্য। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের নতুন জাতীয় পেনশন ব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজনমাফিক সরকার তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্য হতে হলে প্রার্থীকে কমপক্ষে ১০ বছর ধারাবাহিকভাবে চাঁদা দিতে হবে। সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দেবে। পেনশনধারীরা আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর আগ-পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদা দানকারী মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে এ পদ্ধতি স্বেচ্ছাধীন থাকবে, যা পরবর্তী সময়ে বাধ্যতামূলক করা হবে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬ সালে বাজেট বক্তৃতায় এই পেনশনের কথাটি বলেছিলেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও পেনশনের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু আর বিষয়টি এগোয়নি। বিলম্বে হলেও সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে; তা যেন প্রক্রিয়াগত কারণে সময় আরও বয়ে না যায়, এ জন্য কাজের গতিশীলতা জরুরি। এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ জন্য প্রয়োজন আইন, বিধি প্রণয়ন ও যথাযথ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গঠন।
তবে, বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার ছিল। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারে। দেশে গড় আয়ু ও প্রবীণের সংখ্যা বাড়ায় সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি বাড়ছে। এ অবস্থায় সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রয়োজনীয়তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য এটি নতুন কোনো ধারণা নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ স্কিম চালু করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসসহ অনেক উন্নত দেশে এ স্কিম কার্যকর রয়েছে। বস্তুত, কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা থেকেই এ চিন্তার উদ্ভব।
দেশে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সরকারের আরও কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব ক্ষেত্রে কখনও কখনও সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল কারও কারও বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে। এ রকম দৃষ্টান্ত আরও আছে। অনেক ভালো উদ্যোগ অনিয়ম-দুর্নীতি-অস্বচ্ছতার কারণে মুখ থুবড়ে পড়ার নজিরও আমাদের সামনে কম নেই। তাই এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। ব্যবস্থা কিংবা প্রক্রিয়া ভালো হলে অবস্থা ভালো হতে বাধ্য।
আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধি নিয়ে অহরহ কথা বলছি। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টন যেমন হয়নি; তেমনি এর সুফলও অনেকে পাননি। যারা অনানুষ্ঠানিক কিংবা বেসরকারি খাতের সঙ্গে যুক্ত, তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা তেমন কিছুই পান না। আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেগুলো চলমান, সেগুলোর বেশিরভাগই বয়স্ক-দরিদ্রদের জন্য। সামগ্রিকভাবে এসব কর্মসূচির কোনোটিকেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বলা যায় না। এ পরিপ্রেক্ষিতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর চিন্তা সময়োপযোগী বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, এর উপকারভোগী যাতে সবাই হতে পারেন। এটি বড় চ্যালেঞ্জও। এ জন্য প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার; একই সঙ্গে পক্ষপাতহীনতা।
আরও একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে; মানুষ এ ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ করবে। তাই সুযোগের পরিধি একটু বিস্তৃত করতে হবে। কেউ যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাঁদা বা অর্থ জমা দিতে না পারেন, তাহলে এ জন্য যেন সময়সীমার সুযোগটা অবারিত থাকে। আমরা দেখছি, ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে কোনো কারণে একটা-দুটো প্রিমিয়াম দিতে বিলম্ব হলে অনেক ক্ষেত্রে পুরো ইন্স্যুরেন্সই বাতিল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে যেন এমনটি না হয়। মানুষ যেন তার ন্যায্য প্রাপ্য সহজেই পেয়ে যায়, তাও নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, সরকারি পেনশনভোগীদের নানা ক্ষেত্রে কত রকম বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। সেবা নিতে গিয়ে মানুষকে শিকার হতে হয় হেনস্তার। প্রক্রিয়াগত জটিলতা পদে পদে মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এর সঙ্গে আছে অসাধু দায়িত্বশীলদের অপতৎপরতা। অর্থাৎ অন্যের ন্যায্যতার পথে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে নিজেদের পকেট ভারি করার অপচেষ্টা। সরকারি পেনশন ব্যবস্থা এখনও কত জটিল হয়ে আছে, তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যদের বোঝা সহজ নয়। অতএব, এ ক্ষেত্রে যাতে এমন কিছু না হয়, লক্ষ্য থাকতে হবে সেটি। প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু সহজ করে দিয়েছে। প্রযুক্তির সহায়তায় অনেক কিছু করা এখন মোটেও কঠিন কিছু নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই প্রীতিকর নয়, সেহেতু এমন একটি ভালো ব্যবস্থা চালুর আগেই সবকিছু পরিস্কার করা বাঞ্ছনীয়।
কথা উঠেছে, এ ব্যাপারে বেসরকারি খাত অনাগ্রহ প্রকাশ করতে পারে। তা কোনোভাবেই চলবে না। এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তাদের এ ব্যবস্থার আওতায় আসতে বাধ্য করার বিধান নিশ্চিত করতেই হবে। আমাদের বেসরকারি খাত সরকারের কাছ থেকে অনেক রকম সুবিধা পায়। কিন্তু বেসরকারি খাতের কর্মজীবীরা সে অনুপাতে সুযোগ-সুবিধা পানই না। সরকারি চাকরিজীবীরা ব্যাংক ঋণসহ চাকরি ক্ষেত্রে নানারকম সুযোগ-সুবিধা পান। তাই বেসরকারি খাত বিষয়ে এ ব্যাপারে আরও বেশি জোর দিতে হবে। বেসরকারি খাত সুবিধা পাবে অথচ এ খাতের কর্মজীবীরা এর সুফল পাবেন না- তা তো মেনে নেওয়া যায় না। এত বড় উদ্যোগে বেসরকারি খাতের অনাগ্রহের ব্যাপারে অনমনীয় থাকতেই হবে।
আমরা দারিদ্র্য হ্রাসে মোটামুটি একটা স্বস্তির জায়গায় এসেছিলাম। করোনা দুর্যোগ দরিদ্র-হতদরিদ্রদের সংখ্যা স্ম্ফীত করছে। তাদের এ ব্যবস্থার আওতায় আনার ব্যাপারে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। তাদের উপকারভোগীর কাতারভুক্ত করার ব্যাপক পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন জরুরি। তা না হলে এর সুফল মিলবে না। তাদের ব্যাপারে সরকারকেই বাড়াতে হবে সহযোগিতার হাত। এ জন্য সরকারের যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, এর সামনে চ্যালেঞ্জও কম নয়। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কঠিন কিছু নয়, যদি প্রক্রিয়া কিংবা ব্যবস্থার সব পথ মসৃণ করা যায়। শেষ বয়সে মানুষ নানাভাবে অসহায় হয়ে পড়ে। এর মধ্যে আর্থিক অনটন অন্যতম।
আমাদের শ্রেণি-বিভাজনের দাগ অনেক মোটা। উদ্বেগের কারণ হলো, তা আজও মোটা হচ্ছে। সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে পুঞ্জীভূত হয়ে পড়ছে। বৈষম্যের ছায়া বিস্তৃত হচ্ছে। সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকার শুধু অঙ্গীকারেই বৃত্তাবদ্ধ।
বৈষম্যহীন কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর ৫০ বছর অতিক্রান্তেও আমরা কাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছাতে পরিনি। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা যে বিশাল কর্মযজ্ঞ- এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্নিষ্ট কারোরই নূ্যনতম উদাসীন থাকার অবকাশ নেই। যে কোন পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে দূরদর্শী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা-স্বচ্ছতার অভাবে অনেক নেতিবাচক দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। এর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। বাড়ছে বয়স্ক মানুষের হারও। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যদি এই ব্যবস্থা সুচারুভাবে করা যায় তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করা যাবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নাগরিকদের জন্য এ এক বড় সুযোগ। সর্বজনীন পেনশন তহবিলে যত অর্থ জমা হবে; এর অংশবিশেষ সরকার নানা খাতে বিনিয়োগ করবে। কাজেই সর্বাবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার যেমন বিকল্প নেই; তেমনি প্রক্রিয়াও সহজ করতে না পারলে এত বড় কর্মযজ্ঞের সড়ক প্রশস্ত করার সুযোগ সংকুচিতই থাকবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হবে, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
জুয়েল সরকার মত-দ্বিমত সর্বজনীন পেনশন জনকল্যাণমুখী এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ