যুদ্ধ চাই না, চাই শান্তির জল
১ মার্চ ২০২২ ১৯:৫৯
‘চতুরঙ্গ’ থেকে ‘শতরঞ্জ’। ভারত থেকে প্রাচীন পারস্য। চীন ঘুরে স্পেন হয়ে বিশ্বে ছড়াল, কাঁপালও। চৌকুনে ময়দানে সজ্জিত সেনাদলের যুদ্ধংদেহী প্রস্তুতি। একমাত্র যুদ্ধ, যেখানে সাদায় শান্তি নামে না, যুদ্ধ থামে না বরং প্রস্তুত হয় সাদায়— কালোয় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার তুমুল আগ্রাসনে। এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার সূচনা হয় ভারতে। তখন বহরে এত উজির-নাজির না থাকলেও হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক সৈন্য এই চারটি স্তর ছিল। এজন্যই এর নাম ছিল চতুরঙ্গ। ভারতের সঙ্গে প্রাচীনকালে পারস্যের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল বেশ ভালো। পারস্যের বণিকরা যখন বাণিজ্য করতে ভারতে আসত, এই মজার খেলা খেলতে দেখেছিল। তাদের কাছেও খেলাটা ভালো লেগে যায়। এসব বণিকদের হাত ধরে চতুরঙ্গ একসময় পারস্যে চলে যায়। সেখানে এর নতুন নাম হয় ‘শতরঞ্জ’। এরপরে বহু সময় ধরে, বহু পথ ঘুরে পারস্যের শতরঞ্জ স্পেনে এসে Ajedrez নাম ধারণ করে। এর আগে চীন ঘুরে আসে ‘জিয়ানকি’ নাম ধরে। ইউরোপে আসার পরই এই খেলায় প্রথমবারের মতো ‘বিশপ’ যুক্ত হয়, আরও পরে যোগ হয় ‘কুইন’ (রানি), নাম বদলে হয় ‘চেজ’। বলছিলাম, দাবা খেলার কথা।
দাবার নেশা আমার অনেক আগে থেকেই। ছোটবেলায় যখন গ্রামে থাকতাম, নানা রকমের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। পাশা, ষোল গুটি আরো কতকি! মাটির উঠোনে দাগ কেটে পাশা– ষোলগুটির ঘর এঁকে খেলতাম। ছোট বেলায়ই আমার ‘মহাভারত’ পাঠ শেষ হয়ে গিয়েছিল। শুকুনী মামাকে চিনতামও বেশ। পাশা খেলতে খেলতে নিজেকে শকুনি চরিত্রে ভাবতে ভালোই লাগত। সে ছিল এক পৈশাচিক আনন্দ।
শহর থেকে একদিন এলেন বাহাদুর কাকু। আমাদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় নিমগ্নতা দেখে কিনে আনলেন একটা দাবার বোর্ড। হাত ধরে শেখালেন, ঘোড়ার চাল আড়াই ঘর, রাজার চারদিকে এক ঘর, এমন নানান কিছু। সেদিন থেকেই দাবায় প্রায় আসক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। স্কুল কম্পিটিশনে নামও লেখাতাম। কখনো কোনো গুটি হারিয়ে গেলে মিষ্টি আলু কেটে হারানো গুটির অবয়ব বানিয়ে খেলতাম।
বহুবছর পরে দাবাতে আসক্তিটা আবার ফিরে এসেছে। সেই আসক্তি বলতে গেলে নেশার পর্যায়ে এখন। যদি কখনো ওয়াইফাই এর লাইন না থাকে, কেমন যেন ছটফট করতে থাকি, কারণ এখন অনলাইনে খেলি। একটু সময় পেলেই দাবার পেইজে ক্লিক মারি। অফিসে লাঞ্চের পরে একটু আয়েশি ভাব- ক্লিক করি, সারাদিনের কাজ শেষ, অফিস থেকে ফেরার আগে একটু ক্লিক করি, রাতে লেখালেখি করছি, কোনো একটা লাইন বা শব্দ মাথায় আসছে না—আগে যখন মাঝরাতে চা বানাতে যেতাম, এখন দাবার পেইজে ক্লিক করি, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে তো অতি অবশ্যই। হেরে গেলে আবারো খেলি, বিজয়ী না হয়ে ঘুমুতে গেলে নিজেকে পরাজিত মনে হয়, ঘুম আসে না, কখনো কখনো মাঝ রাতেও টেবিলে গিয়ে বসি।
দাবার অনলাইন পেইজে নিজের প্রতিপক্ষ বাছাইয়ের ব্যবস্থা আছে। ছোট ছোট বক্সে অনেক প্রতিপক্ষের আবক্ষ ছবি, নিচে এদের পারফরমেন্স দেখাতে ৬০০ থেকে ৬০০০ গেইম জেতার রেকর্ড ও লেখা থাকে, এখান থেকে বাছাই করে খেলতে হয়। আমার পছন্দ জিমিকে। তার ছবির নিচে ৬০০ লেখা। তাকেই ডাকি বেশিরভাগ সময়ে। খেলতে খেলতে মনে হলো জিমি অনেকটা নিরীহ ধরনের প্রতিপক্ষ। প্রায়ই ভুলভাল চাল দেয়, ফলে তার হাতি-নৌকা যায় রসাতলে, ঘোড়া উল্টা-পাল্টা লাফাতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ময়দান থেকে আস্তাবলে জায়গা নেয়। আমার ভালোই লাগে, এই ভালোলাগাটা ছোটবেলার সেই পৈশাচিক ভালোলাগার মতো না হলেও, সে কথা মনে করিয়ে দেয়। জিমির একের পর এক সৈন্য-সামন্তকে কুপোকাত করি অনায়াসেই। এতেও আমার দানবীয় আনন্দ কমে না, বরং প্রবল আক্রোশে খেলি, জিতি আবারো খেলি আর জিমিকে হারাই। একে একে সব গুটিকে মেরে রাজাকে একা করে ফেলি, যেন রাজ্য হারা একঘরে রাজা। কখনো কখনো প্রতিপক্ষের আস্তানায় ৪-৫ টা রানি, নৌকা, সার বেঁধে দাঁড় (উইন) করাই, অসহায় রাজা শুধু এঘর-ওঘর পালিয়ে বেড়ায়, এক পর্যায়ে বান্ধবহীন রাজার কিস্তিমাত হয়। আমি খালি ঘরে একা একাই রাজ্য জয়ের আনন্দে মাতি।
গোটা বিশ্বে আজ কয়দিন ধরে যা চলেছে, যা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, নিউজ চ্যানেলরা রাতের ঘুম দিনের ঘুম হারাম করে ফেলেছেন, তা হলো রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ। কাল রাতে যখন জিমিকে হারালাম, তখন নিজেকে কেবলি পুতিন আর জিমিকে মনে হচ্ছিল ভলোদিমির জেলেনস্কি!
কিন্তু আদতে আমি যুদ্ধ চাই না, চাই শান্তির জল। নিজের শক্তির দাম্ভিকতায় মানবতাকে পিষে ফেলো না, প্রয়োজনে আর কখনোই দাবা খেলায় ইস্তফা দেব, দিব্যি করে বলছি।
সারাবাংলা/আইই