‘গণতন্ত্রের লাশ’-মাহবুব তালুকদারের বিদায় ও নিরপেক্ষতা
২ মার্চ ২০২২ ১৭:৫৭
পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন শেষে বিদায় নিয়েছে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শুরু থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ চারজনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারছিলেন না অপর কমিশনার মাহবুব তালুকদার। বিদায়ী ইসির অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ প্রায় ৬ হাজার ৬৯০টি নির্বাচন হয়েছে। সবকটি নির্বাচন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তুষ্টি ছিল সাবেক সচিব মাহবুব তালুকদারের। তাই কমিশনে নিজের মতো করেই কাটিয়েছেন শেষ দিনটিও। শেষ মুহূর্তেও তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে এসে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হননি। অর্থাৎ সিইসি সংবাদ সম্মেলনে যা বলবেন এরসঙ্গে তিনি একমত হতে পারবেন না, হয়ত এ ভেবেই আসেননি। বিদায়লগ্নে পৃথকভাবে পাঁচ বছরে দায়িত্ব পালনে অনেক বিষয়ে খোলামেলা কথা বলে গেছেন।
মাহবুব তালুকদারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য হলো, “ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, ওই নির্বাচনে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে। এই লাশ সৎকারের দায়িত্ব কে নেবে? কথাটা রূপকার্থে বলা হলেও এটাই সত্য। নির্বাচনের নামে সারা দেশে এমন অরাজকতা কখনো কাঙ্খিত ছিল না।” -অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের অবস্থানে অনঢ় ছিলেন। দায়িত্ব পালনে দেখা গেছে বেশ কয়েকটি ইসির বৈঠকে তাকে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে বেরিয়ে আসতে। শেষ দিনে তার মন্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে। কেউ বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। কেউবা সমালোচনা করছেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে আলোচনা বেশ। কারণ দায়িত্ব পালনের শুরু থেকেই করা বিভিন্ন মন্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচনা ছিল তিনি বিএনপির হয়ে কথা বলছেন। তাছাড়া বিএনপির প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকেই তাকে ইসিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল এমন কথাও শোনা গিয়েছিল।
বিদায়বেলায় মাহবুব তালুকদার গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসির সীমাবদ্ধতা, নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, সহিংসতা, ইসির নমনীয়তা সহ আরো যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন এর সবকিছুই কি অযৌক্তিক? কিংবা সব কথাই কি বিএনপির? যা বলেছেন এর কোন বাস্তবতাই কী নেই? যদি থাকে তাহলে নিরপেক্ষ জায়গা থেকে তার সু-পরামর্শগুলো মেনে নিয়ে কাজ করলে কি খুব ক্ষতি হবে!
সম্প্রতি দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, সরকারের সুবিধাভোগী নয় এমন সাহসী ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে নতুন ইসি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনদের অনেকেই। সার্চ কমিটির সঙ্গে দ্বিতীয়দিনের বৈঠক শেষে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে বলতে শুনেছি, ‘বাংলাদেশে কখনো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি পাওয়া যাবে না। এই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে ইতিহাসের এই অধ্যাপক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। তার মতো ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য না হন, এখানে আমরা এসব কথা বলি এটা কল্পনার রাজ্য হয়ে যাবে। তার মতে, কেউ নিরপেক্ষ নন’। ‘নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সুষ্ঠু ভোট করা সম্ভব নয়’ বলেও মনে করেন মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেছেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনে অনেক অংশীজন রয়েছেন, সেটা রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, স্থানীয় ভোটার আর নির্বাচন কমিশন সেটা পরিচালনা করতে পারে। সবকিছু ইসির একার ওপরে চাপিয়ে দিলে হবে না’।
অর্থাৎ বিশিষ্টজনরাও মনে করেন সবাই নিরপেক্ষ হতে পারেন না। সব মানুষের মধ্যে স্বতন্ত্র দর্শণ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে ঘটনার বিশ্লেষণ করেন। তাই সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক হওয়ার সুযোগ নেই। এসব বিবেচনায় নিয়ে যদি বলি- তাহলে মাহবুব তালুকদার যা বলে গেছেন তা একদিকে হতে পারে নিরপেক্ষতার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, অন্যদিকে কোন দলের হয়ে তার মতামত দিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনে বিএনপির ‘মুখপাত্র’ হয়ে কথা বলার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সেই মাহবুব তালুকদারকে বিদায় বেলা বলতে শুনেছি তিনি নাকি ‘বিএনপির ভাষা বোঝেন না’। তাই বিএনপির মুখপাত্র হয়ে কথা বলার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন ‘আমি যে বিএনপির মুখপাত্র, এটা প্রথম জেনেছি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের প্রেস বিফিং থেকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে- আমি যখনই দৃঢ়ভাবে কোনো বক্তব্য পেশ করি, তখনই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোক সমালোচনা করে বলে যে ‘সে তো বিএনপির সুরে কথা বলে। বিএনপির যে কী সুর, সেটা আমি বুঝি না। যারা এ ধরনের কথা বলেন, তারা হয়ত বা জানেন, আমি তো জানি না।’ এ প্রসঙ্গে বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার আরো বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আমি বিব্রত বোধ করেছি। নীরব জনগোষ্ঠীর ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছি। যাদের কথা সারফেসে আসে না, রাজনৈতিক দল বলে না, সেসব অশ্রুত ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি আমি তাদের মুখপাত্র। তাদের কাছ থেকে জেনে বুঝে বলার চেষ্টা করেছি’। তিনি কষ্টের সুরে আরো বলেছেন, ‘আমি পাঁচজনের একজন। গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে, গণতন্ত্রের জন্য সংখ্যালঘু হিসেবে আমি হেরে গেলাম’।
মাহবুব তালুকদারের আরো গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ছিল ইসির কর্মকাণ্ড নিয়ে। এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশনের বড় দুর্বলতা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব, জালিয়াতি- ইত্যাদি সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা যে সকল অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। লিখিতভাবে যে সব অভিযোগ পাঠানো হয়, তারও যথাযথ নিষ্পত্তি হয় না। অধিকাংশ অভিযোগই আমলে না নিয়ে নথিভুক্ত করা হয় বা অনেক ক্ষেত্রে নথিতেও তার ঠাঁই হয় না। আমাদের কার্যকালের শেষ পর্যায়ে এসে বিগত কয়েক মাসে অবশ্য এর কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে’। মাহবুব তালুকদারের এসব অভিযোগ কি অবান্তর বলার কোন সুযোগ আছে?
সেইসঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্র জনমানসের প্রতিফলন একান্ত অনুপস্থিত থাকার কথা বলেছেন তিনি। এসব নির্বাচনে বিশেষভাবে টাকার খেলাই প্রতিভাত হয় উল্লেখ করে আফসোসের সুরে বললেন, ‘রাজনীতি ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের করতলগত হয়ে যাচ্ছে।’ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাগুলো দূর করতে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন বলেও মত দিয়ে গেছেন তিনি। মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রে হয়ত পক্ষপাতমূলক বা সরকারকে বিব্রত করতে তিনি এমন মন্তব্য করে গেছে হয়ত এ কথাও বলাবলি হচ্ছে। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিদায় পর্বে যা বলে গেছেন, তার মধ্যেও কিন্তু ব্যর্থতার সুর ছিল। তিনি স্পষ্টত বলেছেন, ‘সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ থেকে আইনানুগভাবে সব নির্বাচন শেষ করেছি। রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপে এসেছে, সবাইকে সময় দিয়েছি। কিন্তু পরবর্তীতে তারা নির্বাচনে যাবে না, নির্বাচন করবে না, তাই সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি, আস্থা অর্জন করতে পারিনি।’ দায়িত্ব পালনে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে একথা উল্লেখ করে নূরুল হুদা আরো বলেন, ‘ …দায়িত্ব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিছু ভুল হয়েছে। শতভাগ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। নির্বাচনে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি’ -এ কথার স্বীকার করেছেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের সঙ্গে যদি নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের কিছু বক্তব্য মেলানো যায়, তবে উভয়ের ভাষাই এক। সংকট একই রকম ছিল বলেই কিছু বক্তব্য হয়ত মিলেছে। তবে উপস্থাপনের ভাষা ছিল ভিন্ন। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিয়ে বেশি প্রশ্ন উঠেছে। যেমন উঠেছে ২০১৮ সালেও। এরপর ধারাবাহিকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচন নিয়েও সমালোচনা বিস্তর। সর্বশেষ সাত পর্বে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা হয়েছে অনেক বেশি। এ নির্বাচনে মাত্রা ছাড়িয়েছে সহিংসতা। প্রকাশ্যে হয়েছে অস্ত্রবাজি। শেষ ধাপে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়ায় সাধারণ মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এ ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নামিয়েছে।
সব মিলিয়ে চার হাজার ১১১টি ইউপি নির্বাচনের বিনিময়ে প্রাণ দিতে হয়েছে ১৪০জনকে। অথচ শুরু থেকেই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে প্রায় সব মহল থেকেই দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল তা পাত্তা দেয়নি। এবারের ইউপি নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি। তবুও কথা না শুনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে গিয়েই ঘটেছে এতোসব বিপত্তি। সারাদেশে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যাই ছিল বেশি। তেমনি বিনা ভোটে বিজয়ীর সংখ্যাও অনেক, এ নিয়েও আছে বিস্তর প্রশ্ন। বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় বিজয়ীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নির্বাচন পদ্ধতিকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করে তেমনি নির্বাচিত প্রতিনিধির মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গাটিও দূর্বল হয়। তাই ইউপি নির্বাচন যে সব মহলের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেনি এ নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ থাকার কথা নয়।
বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ভালো পরামর্শগুলো ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা উচিত। ইউপি নির্বাচন প্রসঙ্গে রুপক অর্থে তার বলা কথাগুলো আমলে নিয়ে ভবিষ্যতে শোধরানো পথ বের করা যেতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণেই হয়ত তিনি বলেছেন, ‘গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে। এই লাশ সৎকারের দায়িত্ব কে নেবে?’ একথা শুধু তার নয়, বেশিরভাগ মানুষের।
পৃথিবীর কোনো সিস্টেমই শতভাগ নিখুঁত নয়। সবচেয়ে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও পদ্ধতিগত কিছু সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এখনো পৃথিবীতে গণতন্ত্রই বিকল্পহীন শাসনব্যবস্থা; জনগণের আস্থার একমাত্র জায়গা। এটি ধরে রাখার দায়িত্ব সবার। তাই আগামী ইসিতে যারা আসছেন তাদের দায়ভারের মধ্যে থাকবে মাহবুব তালুকদারের এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করে সমাধান নিশ্চিত করা। তেমনি বিশিষ্টজনদের কথার সুর ধরে যদি বলি, রাজনৈতিক সরকারও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দায় এড়াতে পারে না। সরকারের সহযোগিতায় ইসি যদি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারে তাহলে গণতন্ত্রের উন্নতি হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নতুন চর্চা বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদার সূচক বাড়াবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
‘গণতন্ত্রের লাশ’-মাহবুব তালুকদারের বিদায় ও নিরপেক্ষতা মত-দ্বিমত রাজন ভট্টাচার্য