ফসলি সন থেকে আজকের বৈশাখ
১৩ এপ্রিল ২০১৮ ২২:০২
পহেলা বৈশাখ। বাংলার উৎসব। বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। হাজার বছর ধরে নানা ঘটনা পরিক্রমায় পহেলা বৈশাখ আজকের এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এলো এই বৈশাখ? কে শুরু করলেন বাংলা সন গণনা? কিভাবেই বা ঝড়-বৃষ্টি আর প্রকৃতির রুদ্ররূপের বৈশাখ আমাদের সার্বজনীন আনন্দ-উৎসবের উপলক্ষ হয়ে উঠল?
কিছুটা অস্পষ্টতা আর বিতর্ক থাকলেও সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক বলা হয়। আকবরের শাসন আমলের শুরুর দিকে মুঘল সাম্রাজ্যে হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হত। কিন্তু সেই দিনপঞ্জিতে ফসল কাটা ও খাজনা আদায়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় তিনি তার নবরত্মের একজন, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরীর নির্দেশ দেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সিরাজী ইংরেজি ১৫৮৫ সালে বাংলা সৌরবর্ষ ভিত্তিক একটি দিনপঞ্জি তৈরী করেন। সম্রাট আকবর এই দিনপঞ্জি অনুমোদন করেন এবং তাঁর সিংহাসনে আহোরণের দিন অর্থাৎ ১৫৫৬ সাল থেকে কার্যকর করার ফরমান জারি করেন। ফলে বাংলা প্রথম বঙ্গাব্দ হয় খ্রিষ্ট্রিয় ১৫৫৬ সাল।
ঐতিহাসিকরা আরও উল্লেখ করেন বিশাল ভারতবর্ষে সম্রাট আকবরের সময়ই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছিল। আর তাই তিনি বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কাজ শুরু করতে পেরেছিলেন। যার অংশ হিসেবেই সম্রাট আকবর সন বা সাল সংস্কারের উদ্যোগ নেন। তিনিই প্রথম ভারতবর্ষে ভূমি জরিপ শুরু করেছিলেন। আর এ কাজ করতে গিয়েই খাজনা আদায়ে সমস্যার বিষয়টি সামনে চলে এসেছিল। সে সময় খাজনা আদায় করা হতো চন্দ্র সন (হিজরি ক্যালেন্ডার) অনুযায়ী। আর চন্দ্রসনে প্রতিবছর ১০-১১ দিন পিছিয়ে যেত। হিসেব অনুযায়ী তিন বছরে পিছিয়ে যেত এক মাস। আর ৩২-৩৫ বছরে বাড়তি একটি বছর বেড়ে যেত। আর এসব কারণেই সে সময় সারা বিশ্বের পণ্ডিতরা হিজরি সনের বিরুদ্ধে তাদের মতামত তুলে ধরতে থাকেন। দিল্লীর শাসকরাও এসব কথা জানতেন। এটা পরিবর্তনের পক্ষে তাদের মতও ছিল। ফতেহ্ উল্লাহ সিরাজী সম্ভবত হিজরি সনের কাঠামো বজায় রেখেই বাংলা সন প্রবর্তন করেন। তবে মূল পরিবর্তন হয় চন্দ্র সন থেকে পরিবর্তিত হয়ে বছর গণনা শুরু হয় সূর্য কেন্দ্রিক। খাজনা আদায় আর ফসল ফলানোর সাথে জড়িত বলেই সে সময় এই সনকে ফসলী সনও বলা হত। আর যেহেতু বৃহত্তর বাংলাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয়ভাবে সূর্যভিত্তিক মাস গণনা পদ্ধতি অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল সেহেতু এই নতুন পদ্ধতিটি বাঙালিরা সহজেই গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এই সালটি বাঙালির ঐতিহ্যে পরিণত হয়।
কিন্তু পহেলা বৈশাখকে ঘিরে যে উৎসবের আবহ তা একদিনে আসেনি। এর সাথে হালখাতা আর পুণ্যাহের সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এই হালখাতা বা পুণ্যাহ সব জায়গায় কৃষকদের কাছে খুব একটা আনন্দের উপলক্ষ ছিল না। কারণ এ দিন তাদেরকে জমিদার বা মহাজনের পাওনা পরিশোধ করতে হত। কিন্তু তারপরও এই দুই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে আনন্দের উপকরণ ছিল। মিষ্টি, মিঠাইসহ এই দুই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন আনন্দ আয়োজন রাখা হত। এছাড়া মেলার প্রচলন সেই প্রাচীন কাল থেকেই ছিল। নতুন বছরকে ঘিরে এই মেলার আনুষ্ঠানিকতাও ভিন্ন মাত্রা পায়। আর মুঘল আমলে নওরোজ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হত। তবে এই উৎসব ছিল শুধু সমাজের অভিজাত শ্রেণীর জন্য। এ উৎসব ঘিরেই মিনা বাজারের প্রচলন হয়েছিল। রাজপ্রসাদের এই উৎসবে জাঁকজমক থাকলেও এখানে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। কৃষক আর জন সাধারণের উৎসব উপলক্ষ ছিল মেলা, হালখাতা, পুণ্যাহসহ অন্যান্য উৎসব।
পহেলা বৈশাখকে ঘিরে পূর্ব বাংলায় জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরপরই পাঞ্জাবি প্রশাসন নানাভাবে বাঙ্গালীদের নিগৃহীত করতে থাকে। চলে উর্দু আগ্রাসন। চেষ্টা চলে সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের। এই সময় বাঙালিরা আরও গভীরভাবে তাদের শিকড়ের টান অনুভব করে। শুরু হয় পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পহেলা বৈশাখ পালনের স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সকারীভাবে প্রথম পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ১৯৫৪ সালে। বাংলার মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক প্রথম পহেলা বৈশাখে সরকারী ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তারপর সামরিক শাসন জারিসহ পাক প্রশাসনের আগ্রাসী নীতির কারণে সরকারীভাবে আর পহেলা বৈশাখ পালিত হয়নি। পহেলা বৈশাখ পালনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ১৯৭১ পর্যন্ত।
পহেলা বৈশাখ নিয়ে নতুন করে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে গত শতাব্দীর ৬০ এর দশকে। ১৯৬১ সালে রবি ঠাকুরের জন্ম শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে পাক সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। এছাড়া পাঞ্জাবিরা ‘হিন্দু’ রবীন্দ্রনাথের গানকে রীতিমত বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করতে থাকে। এমনই বাস্তবতায় সামনে এগিয়ে আসে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। শুরু হয় অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে পহেলা বৈশাখে গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন। বৈশাখে ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান হয় বলধা গার্ডেনে। এরপর তা স্থানান্তরিত হয় রমনা পার্কের বটতলায়। এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন ওয়াহিদুল হক, সন্জিদা খাতুন, কামাল লোহানী, ফরিদা হাসান আর সবার উপরে ছায়ার মত ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন খালাম্মা কবি বেগম সুফিয়া কামাল ।
রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রথম বর্ষবরণের গানের অনুষ্ঠান হয় ১৯৬৭ সালে। সেই সময় অশ্বত্থ (যাকে আমরা বট গাছ বলে থাকি) গাছ থেকে শুয়ো পোকা ঝরে পড়ত। অনেকটা জঙ্গলে ঘেরা সেই জায়গায় মানুষের চলাচল ছিল না তেমন একটা। তবে সেই অনুষ্ঠানে ছিল মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ। সামরিক শাসকদের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার অনাবিল আনন্দ। অনুষ্ঠান শুরু হত সকাল ছ’টায়। সেই ঐতিহ্যটা আজও বজায় রেখেছে ছায়ানট। সে দিনের সেই শুরু বাঙালি জাতির জীবনে নতুন দিনের সূচনা করে। বর্তমানে ছায়ানটের প্রধান আর সেই দিনের সেই শুরু সারথী সন্জিদা খাতুন এক নিবন্ধে লিখেছেন ‘নববর্ষের কান্ত প্রভাত আমাদের মুক্তিকামী করেছিল, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বাঙালি রাষ্ট্রীক স্বাধীনতার পথে।’
স্বাধীনতার পর নব উদ্যোমে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন থেকেই পহেলা বৈশাখ সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই দিনটি বাঙালির উৎসব আর আনন্দের দিন। তবে এ যাত্রাও খুব সহজ ছিল না। সামরিক শাসক আর নানা সাম্প্রদায়িক শক্তি বারবার ছায়ানটের অনুষ্ঠান আর বৈশাখ আয়োজনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। মানুষের আবেগ আর ভালোবাসায় পরাজিত হয়েছে অশুভ শক্তি। রক্ষা পেয়েছে সাংস্কৃতিক অধিকার আর স্বাধীনতা। তবে পহেলা বৈশাখ অনেক সময় মানুষের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। ৮০ দশকে স্বৈরাচার এরশাদের অপশাসনের প্রতিবাদে চারুকলা থেকে বের করা শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা এখন পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতার অন্যতম অনুষঙ্গ।
যুগে যুগে বৈশাখ উদযাপনে নানারকম বাঁধা এসেছে। ১৯৯৯ সালে ঘটেছে বোমা হামলার মত ভয়াবহ ঘটনা। ২০১৬ তে এসে হেফাজতে ইসলাম চোখ রাঙিয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা নস্যাৎ করতে। কিন্তু তারা পারেনি। কোথাও থেমে থাকেনি বাঙালির উৎসব আয়োজন। বরং বাঙালির শেকড় সন্ধান আর ঐতিহ্যের টানে বৈশাখ পেয়েছে নতুন মাত্রা। পরিণত হয়েছে দেশের বৃহৎ সার্বজনীন উসৎবে।
লেখক – প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়