৭ই মার্চের ভাষণ- মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র
৬ মার্চ ২০২২ ২১:০০
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ আজ শুধু বাংলাদেশের একক সম্পদ নয়, এটি এখন বিশ্ব মানবতার মুক্তির প্রামাণ্য দলিল। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ হয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কী করণীয়, কী অকরণীয় তার দিক নির্দেশনা হয়ে বার বার মানব সভ্যতায় মাঝে এই ভাষণটির আবেদন চির অম্লান হয়ে থাকবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিল। সেই সময় থেকে বিশ্বব্যাপী দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ হিসেবে প্রশংসিত ও গবেষণা হয়ে আসছে। কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল’। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তখন বলেছেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ আসলে স্বাধীনতার মূল দলিল’। আবার গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে বলেছেন,‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চিরজাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা’।
৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-সংগ্রামের রূপরেখায় মানুষের কী করণীয়, যুদ্ধের রণকৌশলগুলো তার কথামালায় সুকৌশলে শুধু দিকনির্দেশনাই দেয়নি, মুক্তিযুদ্ধে শত্রু বাহিনীর অনুপ্রবেশ নিয়েও সবাইকে সাবধান করেছেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীনতার একটি নজিরবিহীন অলিখিত ঘোষণাপত্র।
এই ভাষণে তিনি সুকৌশলে শোষিত মানুষকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান করার পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলেছেন। আশা দেখিয়েছেন, স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করেছেন এবং শত্রুর মোকাবেলা করতে উদ্যমী করে গড়ে তুলেছেন।
বিশ্বের অন্যান্য ভাষণের সঙ্গে অনেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তুলনা কিংবা মেলানোর চেষ্টা করেন। আমি সবার মতামতকে শ্রদ্ধা করেই বলছি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর সেরা ভাষণ যা অন্য কারো ভাষণের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না।
বিশ্বের যতগুলো আলোচিত ভাষণ আছে তার সবকটি ভাষণ দেওয়া হয়েছিল সুরক্ষিত জায়গায় থেকে, নেতা নিরাপত্তা বেষ্টনী মোড়ানো অবস্থান থেকে ভাষণ দিয়েছেন। যেমন, মার্টিন লুথার কিং ভাষণ দিয়েছিলেন আব্রাহাম লিংকনের ভাস্কর্যের নীচে দাঁড়িয়ে। প্যাট্টিক হেনরি ভাষণ দিয়েছিলেন পার্লামেন্টের ভেতর। গাজী সালাউদ্দিনের জেরুজালেমের আক্রমণের ভাষণ দিয়েছিলেন লক্ষ-লক্ষ সৈন্য দ্বারা সুরক্ষিত অবস্থায়।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন মন থেকে। কোনো লিখিত নোট সঙ্গে ছিল না, ছিল না সৈন্যবাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনী। বরং শত্রু বাহিনীর হেলিকপ্টার আকাশে টহলরত অবস্থায়; যেখানে একটুর চেয়ে একটু ব্যতিক্রম ঘটলে হাজার-হাজার মানুষের প্রাণ নিঃশেষ করে ফেলত পাকিস্তান বাহিনী। আর ৭ মার্চের ভাষণে আমাদের শুধু ইতিহাস আর সংগ্রামের প্রেক্ষাপটই তুলে ধরেননি, এটি আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুরক্ষা এবং ভ্রাতৃত্ববোধের কথাও তুলে ধরেছেন।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শন ম্যাকব্রাইড বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। সাম্য নিশ্চিতকরণ ও সম্পদের বৈষম্য দূর করার মধ্যেই নিহিত স্বাধীনতার আসল সার্থকতা। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ই মার্চের ভাষণে’।
অন্যদিকে, টাইম ম্যাগাজিনের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘শেখ মুজিব ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল’ বলে উল্লেখ করেছে। আবার ১৯৭১ সালে রয়টার্স তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে এবং সঙ্গে-সঙ্গে দেশ পরিচালনার দিক-নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে’।
তৎকালীন রেসকোর্সের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে একাত্তরের সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু জানতেন যে, একটি জাতি শুধু স্বাধীন হলেই সে মুক্ত হয় না। স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক-ভৌগোলিক অবস্থান আর অর্থনৈতিক মুক্তি একান্ত প্রয়োজন যা তার ভাষণের মাধ্যমে উপস্থিত প্রায় ১০ কোটি বাঙালিসহ পুরো বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছেন।
৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। বঙ্গবন্ধু জানতেন, পাকিস্তানিরা হয়তো তাকে হত্যা করবে নয়তো গ্রেফতার করবে। আর বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে কী করতে হবে ‘জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে-বলেও ভাষণে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
পাকিস্তানের জান্তা সরকার তখনই বুঝতে সক্ষম হয়েছে, ৭ই মার্চের ভাষণে কী হতে পারে। ‘নাথিং অব শেখ মুজিবুর রহমান উইল গো অন দ্য এয়ার আনটিল ফারদার অর্ডার’-এইভাবেই সামরিক বাহিনীর গণমাধ্যম কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেক টেলিফোনে তার আদেশ দিয়ে রেডিওতে সরাসরি প্রচার করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। রেডিওর সবাই ওই আদেশের প্রতিবাদে কাজকর্ম বন্ধ করে অফিস ছেড়ে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে চলে যান। পরে বাধ্য হয়ে ৮ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টায় প্রচার করে বঙ্গবন্ধুর রেকর্ড করা ৭ই মার্চের ভাষণ।
৭ই মার্চের ভাষণ- আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মুখপত্র, যার কারণে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতাকামী বাঙালি। একটি ভাষণ, একটি তর্জনী, একটি আহ্বান কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ হলে মানুষ সহজভাবে গ্রহণ করে ত্রিশ লক্ষ যোদ্ধা শহিদ হয়েছেন, দুই লক্ষেরও বেশি নারী তাদের সম্ভ্রম বিনাশ করেছেন—এটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে চির অমলিন হয়ে থাকবে।
এই মানব সভ্যতা যতদিন থাকেব, ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে গবেষণা করবে। আরও নতুন নতুন অ্যাঙ্গেলে বিচার-বিশ্লেষণ করলে নতুন-নতুন তথ্য বেরিয়ে আসবে। মানুষ সাহস পাবে, উদ্যমী হবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এখনো একবার যে শুনে, সে বার বার শোনার চেষ্টা করে, বুঝার চেষ্টায় থাকে।
৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে আমাদের দেশে চলচ্চিত্র তৈরি করা থেকে আরম্ভ করে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্তিকরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাধীনতা সংগ্রামের মুল চালিকা শক্তি, স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব তুলে ধরা উচিত। যত বেশি আলোচনা করা হবে, মানুষ, বিশেষ করে এ প্রজন্ম তত বেশি জানবে এবং বুঝবে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তর-উপস্তরগুলো উল্লেখিত করা আছে। নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের আত্মকথা, দিক-নির্দেশনা, কী করণীয় আর কী অকরণীয়গুলো স্পষ্ট ও উদ্যোমীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রায় ১ ৮মিনিটের এই ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মূলত রচনা করেছিলেন আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রকৃত সংজ্ঞা। আর এই ভাষণটিতেই তিনি বপন করে গিয়েছিলেন আগামীর বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতি ইশতেহার হিসেবে। তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ তৎকালীন সময়ের হলেও ভবিষ্যতমুখী, স্পষ্ট অথচ ইঙ্গিতবাহী এবং রাজনৈতিক বিচারে সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনার। আর এটি যে শুধু বাংলাদেশ বিনির্মাণের ইশতেহার তা নয়; পঁচাত্তর পরবর্তী অন্ধকার সময় থেকে সংগ্রামে-ত্যাগে আবার আলোর দিকে ওঠে আসার প্রেরণাও এই ঐতিহাসিক মুখপত্র।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণসমূহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। পৃথিবীর জুড়ে অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের ভাষণ। এই ভাষণ শুধু হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা বাঙালি-অবাঙালির ভাষণ নয়, এটির মানবতার ভাষণ। মানুষের অধিকার আদায়ের দিক-নির্দেশনা। এটি যে কোনও জাতির বা গোষ্ঠীর সঙ্গে করা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মুক্তির মুখপত্র; যার আবেদন চির-অম্লান।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
৭ই মার্চের ভাষণ- মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র কবীর চৌধুরী তন্ময় মত-দ্বিমত