Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি

সুমিত বণিক
৮ মার্চ ২০২২ ১৬:২৭

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারী জীবনের প্রচেষ্টা, সাফল্য, অবদানের কথাগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যেই নারী দিবস উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য। নারীর কাজের ন্যায্য পাওনা ও বঞ্চনার অবসানের অভিপ্রায়েই এই দিবসটির যাত্রাটি শুরু হয়েছিলো ১৮৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। সেখানে সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের কাজের সময় ১২ ঘণ্টা থেকে আট ঘণ্টায় কমিয়ে আনার দাবিতে ও বৈষম্যহীন ন্যায্য মজুরি আদায়ের তাগিদে পথে নামেন। তাদের এ আন্দোলনে আটক হন অনেক নারী শ্রমিক। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে বস্ত্র শিল্পের নারী শ্রমিকরা কাজের সুস্থ পরিবেশ, সময় ও যোগ্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেন। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সে বছর সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নারীদের সম্মানে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক দল পরের বছর অর্থাৎ ১৯০৯ সালে ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ জাতীয়ভাবে নারী দিবস পালন করে।

বিজ্ঞাপন

এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এতে অংশ নেয় ১৭টি দেশ থেকে আসা ১শ জন নারী প্রতিনিধি। এতে ক্লারা জেটকিন প্রতি বছর ০৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন। এতো গেলো ইতিহাসের কথা। আর এই ইতিহাস সারা বিশ্বে সর্বত্র পঠিত ও উদযাপিত হয়। কিন্তু শতবছরেরও অধিক অতিক্রান্ত হওয়া নারীদের এই আন্দোলনের বর্তমান প্রেক্ষাপট আর সেখানে সীমাবদ্ধ নেই। নিউইয়র্কে নারীরা সেদিন রাস্তায় নেমেছিলো কাজের ঘন্টা ও নায্য মজুরীর দাবীতে। কিন্তু আজ বাংলাদেশের নারীরা ঐ একই কারণে বৈষম্যের ও সহিংসতার শিকার নয়! বরং নারীর প্রতি বঞ্চনার ও বৈষম্যের প্রকৃতি বর্তমানে আরো বেশি নতুন মাত্রায় সম্প্রসারিত হয়েছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যার শুরু হয়, জন্মের পর থেকেই! মেয়ে শিশু জন্মের কথা শুনে এখনো অনেক পরিবার হতাশায় ভুগেন। মনে করে ছেলে শিশু হলো তার পরিবারের প্রজন্মের ধারক। ছেলে শিশু পরিবারের সম্পদের উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণকারী, সেইসাথে উত্তরাধিকার রক্ষাসহ নানা বিষয়ে এখনো এসব বিষয় আমাদের মানসিকতায় শক্তভাবে গেঁথে আছে।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিকভাবে প্রতি বছর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করে একটি বিষয়কে প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্বাচন করা হয়। ২০২২ সালের জন্য প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “Gender equality today for a sustainable tomorrow,” এটিকে বাংলায় চিন্তা করলে দাড়ায়, ‘টেকসই আগামীর জন্য আজই প্রয়োজন জেন্ডার সমতা’। আভিধানিকভাবে ‘জেন্ডার সমতা’ এমন একটি ধারণা, যা বিশ্বাস করে নারী-পুরুষ এবং এর বাইরেও যারা আছে তাদের অধিকার রয়েছে স্বাধীনভাবে বিকাশের, সক্ষমতা প্রকাশের, প্রচলিত ধ্যানধারণার সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে বদ্ধমূল সনাতনী ভূমিকা থেকে বের হয়ে আসার। জেন্ডার সমতা বলতে নারী-পুরুষ, ভিন্ন আচরণ, স্বপ্ন এবং চাহিদার স্বীকৃতি ও যথার্থ মূল্যায়ন।

আসলে এই জেন্ডার সমতা কে আভিধানিক অর্থে প্রকাশ করা যত সহজ, বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় এর যথার্থ বাস্তবায়ন এখনো অনেকাংশেই অধরা! শুধু বাংলাদেশ কেন, বৈশ্বিকভাবেও যেকোন ধরণের সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হামলাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের যে নেতিবাচক প্রভাবগুলো ঘটে, তার অধিকাংশই বিষয়গুলোতেই নারীকে এর দুর্ভোগটা বেশি পোহাতে হয়। সেই সাথে স্বাধীনভাবে বিকাশের যে পথ, সেটা এখনো অনেক কন্টকাকীর্ণ। কারণ একটা মানুষ তখনই নিজের সক্ষমতাকে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়, যখন সে তার প্রতিভা বা দক্ষতা প্রকাশের জন্য সহায়ক ও অনুকূল পরিবেশ পায়, অর্থাৎ যে পরিবেশ নারীকে প্রতিনিয়ত নারীর ইচ্ছা শক্তিকে অবদমিত করে রাখতে চায়, সেখানে সক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশ কিছুটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সেখানে বাধা হয়ে দাড়ায় সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারণা। যুগের পর যুগ নারীর প্রতি সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গিগুলো নারীকে দমিয়ে রাখতে বেশ প্রভাবিত করছে। ধর্ম, বর্ণ, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে পুরুষ, নারী ও অন্যান্য লিঙ্গ বৈশিষ্ট্যের মানুষের স্বপ্ন, বিশ্বাস, চাহিদার স্বীকৃতিগুলো আমরা যথাযথ মূল্যায়ন আমরা এখনও করতে পারিনি। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের কিছু সূচকে অদ্যাবধি কিছু অগ্রগতি হয় নি, সে কথা বলছি না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যখন একটা প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ায়, নিজের চাহিদা অনুযায়ী পোষাক পরিধান করে, মনের ইচ্ছায় ছুটে বেড়ায় দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, তখন একজন নারীর ক্ষেত্রে সমাজ নানা শৃঙ্খলের কথা বলে নারীর জীবনের চলাচলকে সীমাবদ্ধ করতে চায়। নিরাপত্তার কথা বলে নারীর ইচ্ছাকে দমন করা হয়। কারণ নারীর জন্য পুরুষের মতো এদেশের সব জায়গা এখনো নিরাপদ না। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের হাত থেকে অবুঝ শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত মুক্তি পায় না! ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ও মানসিকতায় এখনো অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে আছে।

অবস্থাদৃষ্টে তখন মনে হয়, আমাদের উন্নয়নের সূচকে অগ্রগতি হলেও, বাস্তবে কোন অগ্রগতিই হয় নি! আধুনিক সভ্যতার ও প্রযুক্তির ছোয়া আমাদের জীবন ও যাপনে প্রভাববিস্তার করলেও, আমাদের মানসিকতায় ও চিন্তায় শুভবোধের উন্মেষ ঘটেনি, বরং পচন ধরেছে! সভ্যতার এ যুগেও বিকৃত যৌনাচারের অভিলাষ আর নারীর দেহের প্রতি লোলুপ দৃষ্টির মতো জঘণ্য কুচিন্তা আমাদের মানসিকতা থেকে বিতারিত হয়নি। বাংলাদেশে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনের নানাবিধ কারণও আছে। সামাজিক ও ধর্মীয় অপব্যাখা নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে জিইয়ে রাখতে আরো বেশি প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্বিক জনগোষ্ঠীর কিশোরী ও নারীদের জীবনে সহিংসতার কারণ ও নারীর স্বাধীন জীবন যাপনের পথগুলো আরো বেশি জটিল। এর অনেক কিছুই নানা অব্যক্ত সমীকরণে বাঁধা। যার কিছু উন্মোচিত হয়, বাকীগুলো হারিয়ে যায় কালের অতল গহব্বরে। আশার কথা হলো, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি নানা উদ্যোগে নারীর প্রতি এসব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তনের লক্ষ্যে বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগও পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি জেলায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর প্রায় ১২ হাজার কিশোরী ও যুব নারীকে সম্পৃক্ত করে ‘আমাদের জীবন, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ’ নামক শীর্ষক একটি সমন্বিত কর্মসূচি ২০১৯ সাল হতে পরিচালিত হচ্ছে। কিশোরী ও য্বুব নারীদের নারীত্বের পথে সহিংসতামুক্ত, নির্যাতনমুক্ত, সর্বোপরি একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।

নারীর প্রতি অসম্মান, লাঞ্ছনা, ধর্ষণ কি শুধু নারীকেই পিছিয়ে রাখে? সমাজ কে কুলষতি ও কলঙ্কিত করে না? একটি দেশে ও সমাজ কতটা গণতান্ত্রিক, কতখানি মানবকি তা বোঝার যতগুলো মাপকাঠি আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো নারীরা সেই সমাজে কতটা নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দে চলতে পারে। নারীর অবাধ ও স্বাধীন চলাফরো কি একটি রাষ্ট্রের কাছে মানুষ হিসেবে খুব বেশি চাওয়া? বেসরকারি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট এক হাজার ৩২১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন নয়জন।

নারীর প্রতি অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন আর সহিংসতার কথা বলার জন্য আন্তর্জাতিক নারী দিবস নয়, বরং নারী প্রগতির কথা বলার দিন। নারীর অর্থবহ অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার দিন। দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, মহান জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ দেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক, রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ পদে বর্তমানে নারীরা স্বমহিমায় কাজ করছেন, তবুও কেন নারীর প্রতি নেতিবাচক চেতনার এই আগ্রাসন? কেন নারীকে মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে মানসিক বৈকল্য? কাঙ্খিত মানসিতার এই পরিবর্তনে নারী পুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারী খুঁজে পাক জীবনের প্রকৃত অর্থ ও সাফল্যের নিগুঢ় স্বার্থকতা।

লেখক: জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মত-দ্বিমত সুমিত বণিক

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর